টিকা প্রাপ্তিতে সামনেও অনেক চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের
আজহার
প্রথম ধাপের টিকা কার্যক্রমে ধাক্কা খাওয়ার পর একাধিক উৎস ও দেশ থেকে টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনা টিকার চাহিদার প্রেক্ষাপটে এরপরও বিরাট চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য । তারা বলছেন, টিকা কার্যক্রমের লক্ষ্য হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য সহায়ক সংখ্যক টিকার ডোজ পেতে দরকার দেশের মাটিতে টিকার উৎপাদন। আর এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে এগিয়ে থাকতে সরকারকে সতর্ক ও সার্বজনীন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কুটনীতিকরা।
আমাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো ঢাকার ইস্কাটনের বাসিন্দা শাহিন রিজভীর সঙ্গে। বাংলাদেশে চলমান টিকা কার্যক্রমে প্রথম ডোজ বন্ধ হওয়ার মাত্র একদিন আগে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন তিনি। জানাচ্ছিলেন, প্রথম ডোজের সময়ই দ্বিতীয় ডোজের টিকাদানের তারিখ উল্লেখ করা হলেও তার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
তিনি বলেন, “এটা একটা টেনশনের ব্যাপার না। রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীতে ডোজটা পাবো কি পাবো না। কারণ আমি তো অন্য কোন কোম্পানির অন্য কোন ডোজ নিতে পারবো না। এগুলো ভেবে আসলেই অনেক টেনশন হচ্ছে কী হবে।”
শাহিন রিজভী
ভারত থেকে টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার পর এমন শঙ্কা করছে অনেকেই। কারণ সরকারের হাতে মজুদ আছে ২২ লাখের মত ডোজ। অপরদিকে প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন ৫৮ লাখের বেশি টিকাপ্রার্থী। পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে, টিকার জন্য নতুন করে সবধরনের নিবন্ধন বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
এর পরের কয়েকদিন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে টিকার জন্য বেশ দৌড়ঝাপ লক্ষ্য করা যায়। সরকার বাংলাদেশের যে কোম্পানির মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা আমদানি করতো, সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে আলোচনা জন্য অনুরোধ জানানোর খবরও বের হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানায়, ভারত থেকে প্রতিশ্রুত টিকা না পাওয়ায় রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এরপরই ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে, আসছে মাসেই রাশিয়ার তৈরি করোনা টিকার স্পুতনিক ভি’র ৪০ লাখ ডোজ পাচ্ছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এসব উদ্যোগ কতটা স্বস্তি দিচ্ছে বাংলাদেশকে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিষয়ক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক বলেন, হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ টিকার ডোজের প্রয়োজন তার ৮ ভাগের একভাগ টিকারও বন্দোবস্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ।
অধ্যাপক মুজাহেরুল হক
মুজাহেরুল হক বলেন, “বাংলাদেশের স্বস্তির কোন অবকাশ নেই। কারণ এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আশ্বাস আছে ৩ কোটি ডোজের। কিন্তু বাংলাদেশের লাগবে ২৫ কোটি ডোজ। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। তাহলে সাড়ে কোটির দুই ডোজ করে ২৪ কোটি টিকা প্রয়োজন। সে জায়গায় কোন একক দেশের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন ঠিক না, পাশাপাশি রাশা ও চায়না যে অফার দিয়েছে উই আর টু ওয়েলকাম। উই আর টু এক্সপ্লোর মোর পসিবিলিটি”
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট সমাধান দেশের মাটিতে টিকা উপাদনের ব্যবস্থা করা। আর এজন্য দুটি দেশের টিকা উৎপাদনের নীতিগত অনুমোদন দিতে দেখা গেছে সরকারকে। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান মনে করেন, দেশীয় কোম্পানিগুলোর টিকা উৎপাদনের সক্ষমতাও আছে। কিন্তু টিকা বিশেষজ্ঞ মোশতাক আহমেদ মনে করেন, প্রচলিত অনেক টিকা ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা থাকলেও করোনা টিকার মত স্পর্শকাতর টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তগত সক্ষমতা কিংবা অভিজ্ঞতা নেই বাংলাদেশের।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোস্তাক আহমেদ বলেন, “আমরা যতটা জেনেছি এই ভাইরাসটি পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেও পরিবর্তন আনতে হতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যাশা এখানেই যাতে একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাঠামো তৈরি হয়। আমাদের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কাঠামো আছে। আরও দুয়েকটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চেষ্টা করছে ভ্যাকসিনের কাঠামো তৈরি করার। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, পুরোপুরি ভ্যাকসিন তৈরি করার অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে সীমিত। এ ক্ষেত্রে বিদেশি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যদি জয়েন ভেঞ্চারে আমাদের সঙ্গে কাজ তাহলে হয়তে আমাদের সরকার ও জনগণের আকাঙ্খা হয়েতো পূরণ হবে।”
এমন অবস্থায়, সাবেক কুটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন টিকার জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রযুক্তি পেতে বাংলাদেশকে সক্রিয় হতে হবে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে। আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুজাহেরুল হক বলেন, টিকা উৎপাদনের জন্য সর্বোত্তম পছন্দ হতে পারে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশই এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন দিতে পারে নি। আমরা ইতোমধ্যে তো প্রায় ৫৭ লক্ষ দিয়েছি প্রথম রাউন্ড। দ্বিতীয় রাউন্ডেও প্রায় ২৬ লক্ষ দেয়া হয়ে গেছে। কাজেই সামগ্রিক বিবেচনায় ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে আমরা যে খুব বেশি খারাপ করেছি তা বলা যাবে না। তবে এটা বললাম আমাদের সামনে অনেকদূর যেতে হবে। কারণ একটা জিনিস তো সত্য আমাদের প্রতিটি মানুষ নিরাপদ না হলে কিন্তু সকলে আমরা নিরাপদ হচ্ছি না।”
বিশ্বব্যাপী এরই মধ্যে ১০০ কোটিরও বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এর ১ শতাংশ টিকাও পায় নি দরিদ্র ও কম আয়ের দেশগুলো। তাই সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের মত দেশগুলোর টিকার প্রাপ্তি যে টিকা কুটনীতিতে পেরে ওঠার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
আজহার লিমন। চীন আন্তর্জাতিক বেতার।