চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংর শাআনসি প্রদেশের লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের যুবক কালের অভিজ্ঞতা
2021-04-26 14:26:34

গেল সপ্তাহের অনুষ্ঠানে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের যুবকালে শাআনসি প্রদেশের লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে অস্থায়ী শিক্ষকতার গল্প শেয়ার করেছি। আসলে তিনি সেখানে টানা ৭ বছর ধরে জীবন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে অবশ্যই অনেক গল্প রয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা যুবকালের প্রেসিডেন্ট সি’র লিয়াংচিয়াহ্য জীবনের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরবো।

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংর শাআনসি প্রদেশের লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের যুবক কালের অভিজ্ঞতা_fororder_xjpy1

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আরেকবার লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে ফিরে যান। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে অতীতকালের স্মৃতিচারণ করেন। তখন তিনি মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনের প্রথম দিকে লিয়াংচিয়াহ্য থেকে অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পেয়েছি। এ গ্রাম ছোট হলেও, জীবনের অনেক দার্শনিক বিষয় সম্পর্কে এখান থেকে জানা সম্ভব।’

২০০৪ সালের অগাস্ট মাসে সি চিন পিং চীনের চেচিয়াং প্রদেশের সিপিসি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি শাআনসি প্রদেশের একটি টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দেন। যুবকালে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের জীবনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমি এমনি কান্নাকাটি কম করি। তবে সেখানে দু’বার কেঁদেছিলাম।’ এর কারণ স্মরণ করে সি বলেন, তখন বেইজিংয়ের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনি। তাই টানা ৭ বছর গ্রামের জীবন কাটানোর পর বেইজিংয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। স্থানীয় গ্রামবাসীরা তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য ভোরবেলা থেকে সি’র দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর জেগে ওঠার অপেক্ষা করেন। যখন দরজা খুলে দেখেন সুপরিচিত গ্রামবাসীরা বাইরে শান্তভাবে তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য দাঁড়িয়েছে আছেন, তখন তিনি কান্না সংবরণ করতে পারেননি।

আরেকবারের ঘটনা। সি’র বড় বোন হঠাত্ মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তিনি গ্রামের জন্য মাটির গুহা খনন করছিলেন। তখন বোনোর মৃত্যুর খবর শুনে তিনি কেঁদেছিলেন। অন্য কেউ তার কান্না দেখেনি।

ইয়ানআন জেলার লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের জীবন সি’র জন্য স্মরণীয় ব্যাপার। কারণ, তিনি বেইজিংয়ের শহরবাসী ছিলেন। হঠাত্ গ্রামে পিতামাতার কাছ থেকে দূর থাকে এবং এমন কঠোর পরিবেশে জীবনযাপন শুরু করা অনেক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল।

তিনি এ গ্রামের এক গ্রামবাসীর বাড়িতে বসবাস করতেন এবং পরিবারের ৮ জন সদস্যের সাথে খাবার খেতেন। তারা যা রান্না করতেন, সি-ও তাই খেতেন। তার এই সহজসরল মনোভাবের কারণে গ্রামবাসীরা তাঁকে বেশ পছন্দ করতেন।

এ সম্পর্কে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের সিপিসি’র সম্পাদক শি ছুন ইয়াং বলেন, সি চিন পিংয়ের যাওয়ার দিন গ্রামের সকলে তাঁকে বিদায় দিতে আসেন। একটি ট্র্যাক্টর দিয়ে তাঁকে গ্রামের বাইরে পৌঁছে দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে শি এ গ্রামের সিপিসি’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের অবকাঠামোও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তার হাত ধরে। যেমন, গ্রামে ৫টি বাঁধ নির্মিত হয়েছে, যার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত কাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষিজমিতে সেচের সমস্যার সমাধান হয়।

এ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সি বলেন, গ্রামে যাওয়া ও সেখানে জীবন কাটানো একটি বিশেষ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, যার মাধ্যমে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সেখান থেকে শহরে ফিরে এলে যেন নতুন করে চরিত্র তৈরি হয়। বহু বছর পর তিনি আবার লিয়াংচিয়াহ্য ফিরে যান এবং তাঁর সহায়তায় স্থানীয় গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল নির্মিত হয়েছে।

ইয়ানআন টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় চেচিয়াং প্রদেশের সিপিসি’র সম্পাদক ছিলেন সি। চেচিয়াং সমুদ্রের কাছে অবস্থিত, তাই নিয়মিত টাইফুনের আঘাত সহ্য করতে হয়। তিনি সবসময় স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে কাজ করতেন এবং ছোট জাহাজে বসে বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের দেখাশোনা করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। সিপিসি’র সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জনগণকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা দায়িত্ব। তাঁর ৪০ বছরেরও বেশি রাজনৈতিক জীবনে এ নিয়ম অনুসরণ করছেন তিনি এবং তার পিতার শিক্ষা ও লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিশেষ জীবনের অভিজ্ঞতা জনগণের স্বার্থকে মনে রাখতে তাকে সাহায্য করেছে।

যুবকালে সি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যা শিরোনাম ‘আমি হলুদ মাটির ছেলে’। এ প্রবন্ধে সি উদাহরণ দিয়ে লিখেন যে, তিনি শাআনপেই মালভূমিকে নিজের রুট মনে করেন, যার মানে সবসময় জনগণের জন্য বাস্তব কাজ করা। এ সম্পর্কে সি বলেন, ভবিষ্যতে আমি করবো, কি করতে হবে, শাআনপেই গ্রামের জীবন থেকে অনেক জানতে পেরেছি।

লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে পৌঁছার সময় সি’র অনেক হতাশা ছিল। কারণ, গ্রামের জীবন অনেক কঠিন। একা থাকা, সারাদিন ধরে পরিশ্রম করা তাঁর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। প্রতিদিন গ্রাম থেকে পাহাড়ে আরোহণ করতে হতো তাকে। পাহাড়ে ওঠা-নামা তাঁর জন্য অতি ক্লান্তিকর ব্যাপার ছিল। তবে সেখানে কৃষিকাজ করতে হবেই। সেই ধরনের শ্রম সি’র জন্য ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ভোরবেলা জেগে ওঠা ও দুপুরবেলা একবার বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ করা। বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। শ্রমিকরা শুধু সিগারেট খেয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন, তাই একটু বিশ্রাম নেওয়ার কারণে সি-ও অন্যান্যদের মতো সিগারেট খেতে শুরু করেন। আসলে সে বিশ্রামের সময় ভারী শ্রমের তুলনায় খুবই কম। সারাদিনের কাজশেষে শরীরও ব্যথা করে। তবে এমন কষ্টকর কাজের মাধ্যমে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন সি। লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের একটি কথা রয়েছে, যা ব্যাপক প্রচলিত: জানুয়ারি মাসে সমৃদ্ধি, ফেব্রুয়ারি মাসে গরীবী, মার্চ ও এপ্রিল মাসে ভিক্ষুক। যারা কৃষিকাজ করতে পারেন, তাদের জন্য কিছু খাবার রাখা যায়; নারী বা বাচ্চারা অন্যান্য জেলায় ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হয়। সেই ধরনের জীবন সি’র মনে গভীর ছাপ ফেলে।

তিনি গভীরভাবে গ্রামবাসীদের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করেন। শহরবাসী হিসেবে গ্রামাঞ্চলের মাছি তাঁর জন্য বড় সমস্যা। মাছি কামড়ালে চামড়ায় এলার্জি দেখা দেয়। ধীরে ধীরে চামড়ায় ঘা হয়ে যায়, যা খুবই কষ্টের ব্যাপার। এমনভাবে ৩ বছরেরও বেশি সময় সহ্য করেছেন সি, পরে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

খাবার সমস্যা তাঁর জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। গ্রামাঞ্চলে সুস্বাদু খাবার পাওয়া অসম্ভব। ভুট্টার পিঠা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবার।  চাউল পাওয়া মুশকিল। টক স্বাদের শাকসবজি স্থানীয় গ্রামবাসীদের সবচেয়ে ভালো খাবার। তারা মাঝে মাঝে সি-কে উপহার হিসেবে তা দিতেন, যা সি’র স্মৃতিতে সবচেয়ে মজার খাবারগুলোর অন্যতম। কয়েক মাস পর খানিকটা মাংস পেয়ে রান্না না-করেই খেয়ে ফেলার ঘটনাও আছে। তাও সি’র মনে গভীর দাগ ফেলেছে।

জীবনযাপনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। কাপড়চোপড় বা মোজা সবই নিজেকে সেলাই করতে হতো। সি অন্য গ্রামবাসীদের কাছ থেকে উলের সূতা তৈরির পদ্ধতি শিখে ফেলেন এবং ধীরে ধীরে মোজা তৈরির চেষ্টা করেন। কয়েক বছরের চর্চায় কাপড়চোপড়, কুইল্টসহ বিভিন্ন জিনিস বানাতে সক্ষম হন তিনি। বড় হলেও তিনি অনেক ঘরের কাজ করতে পারতেন, যা তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

শ্রমের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আগেই বলেছি। এ সম্পর্কে সি বলেন, কাজের ওপর ভিত্তি করে খাবার দেওয়া হতো। তাই শুরুর দিকে বেইজিংয়ের যুবক ছাত্ররা স্থানীয় মেয়েদের সমান খাবার পেতেন। কারণ তারা বেশি কাজ করতে পারতেন না। পরে তারা বেশি খাবারের জন্য সারাদিন ধরে কাজ করতে চেষ্টা করেন। প্রায় এক বছর পর ঘাঁস কাটার কৌশল শিখতে পেরেছেন সি এবং গ্রীষ্মকালে এক কাঁধে ১০০ কেজির বেশি গম বহন করতে পারতেন। তা টানা ৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হাঁটতেও পারতেন তিনি।

চিন্তাভাবনার পার্থক্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ের গুহায় থাকা এবং কোনো বিনোদন না থাকা—এমন জীবন টানা ৭ বছর কাটিয়েছেন সি। তখন স্থানীয় গ্রামবাসীরা নিয়মিতভাবে সি’র গুহায় চলে আসতেন এবং তাঁর সাথে কথাবার্তা ও আড্ডা দিতেন। কারণ, সি’র কাছ থেকে অনেক মজার গল্প শুনতে পারতেন তারা। সবাই তাঁর গল্প শুনতে আগ্রহী। বেইজিং থেকে নিয়ে আসা বইগুলোর গল্প সহজ ভাষায় গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে দিতেন তিনি, যা গ্রামবাসীদের স্মৃতি।

লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের জন্য বায়ুগ্যাস চালু করার ক্ষেত্রে সি অবদান রেখেছেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি গ্রামের শ্রমিক দলের সিপিসি’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে বায়ুগ্যাস চালুর জন্য গবেষণা করেন এবং সিছুয়ান প্রদেশে গিয়ে স্বচোখে এ বায়ুগ্যাস নির্মাণের পদ্ধতি শিখে ফেলেন। সিছুয়ান থেকে ফিরে এসে গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রথম সেপটিক ট্যাংক তৈরি করেন তিনি। তবে ট্যাংকে শুধু পানি দেখা যাচ্ছিল, কোনো বায়ুগ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল না। সি’র জন্য আশ্চর্য্য ব্যাপার ছিল সেটা। অবশেষে কারণ খুঁজে পেলেন তিনি। দেখলেন একটি এয়ারওয়ে ব্লোকড হয়েছে। তিনি নিজে এয়ারওয়ে পরিষ্কার করলেন। ফলে গোবরের তাঁর মুখ মাখামাখি হয়ে যায়। তিনি রাগ করেননি, মনোযোগ দিয়ে বায়ুগ্যাস জ্বালিয়েছেন। তখন থেকে এ গ্রাম শাআনসি প্রদেশের প্রথম বায়ুগ্যাসচলিত গ্রামে পরিণত হয়। কম সময়ের মধ্যে গ্রামবাসীদের জীবনে হিটিং ও রান্নার সমস্যার সমাধান করা হয়।

১৯৭৫ সালে সি চিন পিং ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন  লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামও তাকে ত্যাগ করতে হয়। স্নাতক হওয়ার পর তিনি হ্যপেই প্রদেশের চেংতিং জেলায় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। পরে ফুচিয়ান প্রদেশে টানা ১৭ বছর কাজ করেছেন। তাঁর স্ত্রী পেং লি ইউয়ান চীনের জনপ্রিয় ও সুবিখ্যাত গায়িকা। দু’জনই ব্যস্ত। অনেক সময় একসাথে থাকতে বা দেখা করতে পারেন না। তবে প্রতিদিন সি স্ত্রীর সাথে ফোনালাপ করেন, তাদের দাম্পত্য সম্পর্কও খুবই ঘনিষ্ঠ। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে সি বলেন, ‘যদিও আমরা দু’জন ব্যস্ত, তবে পরিবারের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেই। তাই প্রতিদিন একবার ফোন করতে হয়। আমার মেয়ের হোমওয়ার্ক করতে সহায়তা দিতে পারি না, তবে তার বড় হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দেই।’

লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের উন্নয়ন সম্পর্কে সি বলেছিলেন, সেখানকার গ্রামবাসীরা আরো সুখী জীবন কাটাতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন। এ গ্রাম শাআনসি প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এখন চীনের গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। ভবিষ্যতে ইয়ানআন জেলার লোকদের জীবন অবশ্যই আরো সুখী হবে।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে,যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)