মেয়ের সুপার মা, নারীদের সাহায্যকারী
2021-04-25 19:45:22

আমার মাকে আমি ভালোবাসি, আমার মা একজন সুপার-উম্যান।

 

সাত বছর বয়সী মেয়ে মুবারেকের সেই সুপার-উম্যান হলেন সিনচিয়াংয়ের কাশগার শহরের সাধারণ এক নারী। তিনি নারী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান মিরেনসা কারে। ২৮ বছর বয়সী মিরেনসা কারে গ্রামের বিখ্যাত ও সবচেয়ে ব্যস্ত নারী। গ্রামের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হল তাঁর দৈনন্দিন কাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নারী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে মিরেনসা ছিলেন একজন সাধারণ উইগুর মেয়ে। বাসায় তিনি ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বাবা মা ও দুই ভাইয়ের যত্নে তিনি আনন্দের সঙ্গে বড় হয়েছেন।

 

উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের পর মিরেনসা বাবা মা’র ছোট দোকানে সাহায্য করতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি ম্যান্ডারিন ভাষা ও কম্পিউটার শিখেন। পরে মিরেনসা গ্রামের সমিতিতে কাজ শুরু করেন। তিনি গ্রাম কার্যালয়ের একজন কর্মী হন।

 

কার্যালয়ের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিন বছর। এ সময় মিরেনসা খুব পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করেন এবং সবাইকে সাহায্য করেন। তাঁর আচরণ গ্রামের সবার মনে খুব সুন্দর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মিরেনসা গ্রামের নারী বিষয়ক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। খুব তাড়াতাড়ি, তিনি গ্রামের নারী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হন। তিনি প্রধানত নারীর স্বাস্থ্য, শিশু শিক্ষা এবং জনগণের দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের কাজ করেন।

 

সন্তান প্রসব করা গ্রামবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বড় ব্যাপার। মিরেনসা সবসময় গ্রামের প্রত্যেক মানুষের বাসায় যান, তাদের খোঁজ খবর নেন, গ্রামের নারীদের জন্য স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান শেখান। তিনি বলেন, দেশের চিকিত্সা বীমাসহ বিভিন্ন নীতি নারীদের জন্য সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তিনি বলেন,

 

 

নারীদের বিয়ের আগে শারীরিক পরীক্ষা করা, এবং অন্তঃসত্ত্বার সময় শারীরিক পরীক্ষা একদম ফ্রি। সন্তান প্রসবের জন্য বেশি টাকা লাগে না। তারা সবাই দেশের চিকিত্সা বীমায় অংশ নিয়েছেন, সরকার অধিকাংশ ফি বহন করে, তারা নিজে অল্প কিছু দেয়। সন্তান জন্মগ্রহণের পর বিনা খরচে বিভিন্ন টিকা নিতে পারে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন পুষ্টিকর পণ্য দেওয়া হয়।

 

মিরেনসা জানান, প্রতি বছর একবার বিনা খরচের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়া স্থানীয় সরকার নারীদের জন্য বিনা খরচে দুই ধরনের ক্যান্সার পরীক্ষার সেবা দেয়। যদি কোনো সমস্যা হয়, এবং যদি কোনো রোগ চিকিত্সা বীমার বাইরে থাকে, তাহলে নারীরা বড় রোগের জন্য বীমার আবেদন করতে পারে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের গরীব পরিবারের বীমার হার ৯৫ শতাংশ, তারা নিজে শুধু ৫ শতাংশ ফি দেয়। এর ফলে রোগাক্রান্ত গ্রামবাসীর চিকিত্সার বোঝা অনেক কমে যায়।

 

শিশুদের শিক্ষার ওপর গ্রামবাসীরা আরো বেশি গুরুত্বারোপ করে। মিরেনসার চোখে, এটি হল চিন্তাধারা পরিবর্তনের প্রতিফলন। এ থেকে বোঝা যায়, লোকজনের জীবন আরো ভালো হচ্ছে। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারে ২/৩টি সন্তান আছে। চীনারা শিশুদের শিক্ষার ওপর খুব গুরুত্ব দেয়। শিশুরা প্রতিটি পরিবারের ভবিষ্যত। গ্রামের বৃদ্ধ বৃদ্ধারা জানান, গত শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ দশকে, গ্রামের লোকজন মাধ্যমিক স্কুল, তথা প্রাথমিক স্কুল পাসের পর বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারত। ৮০ এবং ৯০ দশক থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা শিশুর সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। এখন গ্রামবাসীরা নিজের ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করছেন।

 

মিরেনসা বলেন,

আমি শিক্ষা খাতে কাজ করার সময় লক্ষ্য করেছি যে, গ্রামে ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬১জন। ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হয় ৯৩জন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশি ছিল। আমাদের গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বোঝা যায়, অনেক পরিবার শিক্ষা ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

 

স্থানীয় নীতি অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা যদি সিনচিয়াং-এর স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে, তাহলে প্রতি বছর ৩ হাজার ইউয়ান ভর্তুকি পায়। যদি অন্য প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাহলে প্রতি বছর ৬ হাজার ইউয়ান ভর্তুকি পায়।

 

গ্রামবাসী আইসান মামাতের পরিবারে তিনটি সন্তান আছে। ছোট ছেলে উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। দুই মেয়ে পৃথক পৃথকভাবে থিয়ানচিন নর্মাল ইউনিভার্সিটি এবং নানচিং ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আনন্দের পাশাপাশি আইশান ও তার স্ত্রী মিরেনসাকুরি আক্সিমু লেখাপড়ার ফি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন। কারণ, তাদের পরিবারের অবস্থা ততটা ভালো না।

মিরেনসা আইশানের পরিবারে পরিদর্শনের সময় লক্ষ্য করেন যে, আইশানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাই তাদের মেয়েদের লেখাপড়ার ফি’র সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করেন। তিনি তাদের জন্য শিক্ষা ভর্তুকির আবেদন করেন। এর ফলে তার দুই মেয়ে প্রতি বছর মোট ১২ হাজার ইউয়ান ভর্তুকি পাওয়া শুরু করে। যা আইশান পরিবারের আর্থিক বোঝা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিবার মিরেনসার সঙ্গে দেখা হলে মিরেনসাকুলি তাকে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের কথা  জানায়। আইশান পরিবার সরকারের এই চমত্কার নীতির জন্য খুব কৃতজ্ঞতা জানায়। স্ত্রী মিরেনসাকুলি বলেন,

 

 

আমি কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সিপিসি ও সরকারকে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। আমি আশা করি, আমার ছেলেমেয়ে ভবিষ্যতে সমাজের জন্য ভালো অবদান রাখতে পারবে। এটা হল আমার আশা ও আকাঙ্ক্ষা।

 

মিরেনসার গ্রামে ৭৮৯টি পরিবার আছে। এই গ্রামের লোকসংখ্যা ৩৭০০ জনেরও বেশি। মিরেনসা নারী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন মাত্র এক বছর আগে। তবে এই সময়ে প্রতিটি পরিবারে তিনি গিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি হলে তিনি প্রতিদিন ১৫টি পরিবারে যান, তাদের জীবনযাপনের অবস্থা সম্পর্কে জানেন। এর মাধ্যমে তিনি সরকারের বিভিন্ন নীতি প্রতিটি পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন এবং তাদের কাছে সরকারি নীতি ব্যাখ্যা করেন। যাতে কোনো গ্রামবাসীর প্রয়োজন হলে, সময়মত সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পেতে পারে।

 

এ ছাড়া মিরেনসা মন দিয়ে গ্রামবাসীদের সমস্যা এবং চাহিদার কথা শোনেন। কোনো সমস্যা থাকলে গ্রামের কার্যালয় তাদের সমস্যা সমাধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। যদি গ্রামের কার্যালয় তা সমাধান করতে না পারে, তাহলে তাদের সমস্যা উচ্চ পর্যায়ের সরকারকে অবহিত করেন। এটাই নিয়ম। তিন দিনের মধ্যে গ্রামবাসীদেরকে তার জবাব দিতে হয়।

 

মিরেনসার কাজের স্বীকৃতি দেয় গ্রামের বাসিন্দারা। আস্তে আস্তে গ্রামবাসীদের মধ্যে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। গ্রামে কোনো দম্পতির ঝগড়া হলে অথবা প্রতিবেশীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে, সবাই মিরেনসার কাছ থেকে সাহায্য চান।

 

মিরেনসা উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। কাজ করতে করতে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁর জ্ঞান কাজের জন্য যথেষ্ট নয়। তারপর তিনি অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স করেছেন। লেখাপড়ার কারণে মিরেনসা পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারেন নি। তবে তিনি এতে অনুতপ্ত হন না। তার দৃষ্টিতে, নিজের পরিশ্রম এবং চেষ্টা করা মানে নিজের দুই মেয়ের জন্য ভালো দৃষ্টান্ত রাখা।

 

কাজ করতে হয়, পাশাপাশি লেখাপড়াও করতে হয়। তাই তাঁর বড় মেয়ের চোখে মিরেনসা একজন ‘সুপার-উম্যান’। মিরেনসার স্বামী আবুদু স্ত্রীর এত পরিশ্রম দেখে তাঁকে অনেক সাহায্য করেন। আবুদু বলেন,

 

 

নারীদের অবদান ছাড়া সিনচিয়াং-এর উন্নয়ন সম্ভব না। আমি সিনচিয়াংয়ের নারীদের সম্মান করি, আমি তাদের কাজে সমর্থন দেই।  

 

সিনচিয়াংয়ের অন্যান্য নারীদের মত, মিরেনসার প্রতিদিনের কাজ ও জীবন খুবই সাধারণ। কিন্তু তারা প্রতিটি পদে পদে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কখনই আশা ছেড়ে দেন নি। তারা আশা করেন, নিজের চেষ্টার মাধ্যমে পরিবার ও  সমাজের জন্য আরো বেশি অবদান রাখতে পারবেন।