এপ্রিল ২৪, সিএমজি বাংলা ডেস্ক:চীনের ৫৬টি জাতির মধ্যে ১০টি জাতির মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এদের অন্যতম হলো কাজাখ জাতি। চীনের উইগুর স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ সিনচিয়াংয়ের মধ্যে কাজাখ স্বায়ত্বশাসিত এলাকা ও কাউন্টিতে তারা বসবাস করেন। কানসু ও ছিংহাই প্রদেশেও কাজাখ জাতির মানুষের বসবাস রয়েছে।
কাজাখরা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভুত। আবহমান কাল ধরেই কাজাখরা মধ্যএশিয়া ও সিনচিয়াংয়ের স্তেপ চারণ ভূমিতে গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই কাজাখরা এ অঞ্চলে ছিল বলে ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা রয়েছে। তখন তারা শামানিজম মেনে চলতো। তাদের নিজস্ব গোত্র ধর্ম ছিল। মধ্য সপ্তম ও অষ্টম শতকে মধ্য এশিয়ায় যখন ইসলাম প্রসারিত হয় তখন তারাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তবে গোত্রের নিজস্ব সংস্কৃতিও তারা অনুসরণ করতো, এখনও কিছু কিছু রীতিনীতি তারা পালন করে। মোংগোল আক্রমণের সময় কাজাখদের অনেক গোষ্ঠি পূর্ব ইউরোপেও চলে যায়।
বর্তমান কাজাখস্তানে (যা অষ্টাদশ শতকে জারশাসিত রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল) অধিসংখ্যক কাজাখদের আদিভূমি বলে মনে করা হলেও সিচিয়াংয়ের তৃণভূমিতেও কাজাখদের অনেক গোষ্ঠি স্মরণাতীতকাল থেকে বাস করছে। জারশাসনের সময়ও অনেক কাজাখ পালিয়ে সিনচিয়াংয়ে চলে আসে।
কাজাখরা একসময় ছিল যাযাবর। তারা মূলত ভেড়া, ছাগল, গরু ও ঘোড়া পালন করতো। তারা গ্রীষ্মে ও শীতে স্থান বদল করে অভ্যস্ত ছিল এবং তাঁবুতে বাস করতো। গ্রীষ্মে তারা বিস্তৃত চারণভূমি, স্তেপে পশু চরাতো আবার শীতে ফিরে আসতো ডেরাতে। তাদের তাঁবুর নাম ইয়ুর্ট। পশমের তৈরি মজবুত ইয়ুর্ট হলো শীতকালের উপযোগী। সিনচিয়াংয়ের বরফশীতল শীতকালের তারা নিম্নভূমিতে ইয়ুর্টে বাস করে। আবার গ্রীষ্মে চলে যায় উঁচু পাহাড়ি এলাকায়।
সিনচিয়াংয়ের পার্বত্য অঞ্চল থিয়েনশান, আলথাই, থারপাগহাথাই পর্বতমালার চারপাশেই তাদের বসবাস। কাজাখদের মধ্যে শিকার ও পশুপালন হাজার বছরের সংস্কৃতি। তবে এদের একটি অংশ কৃষিকাজও করে।
অবশ্য আজকাল শিক্ষা বিস্তারের ফলে কাজাখরা অনেকেই শহরে বসবাস করেন, আধুনিক পেশা বেছে নিয়েছেন এবং আধুনিক বাড়িঘরে থাকেন, বড় চাকরি করেন।
কাজাখরা মুসলিম। তাই তারা নামাজ, রোজা পালন করেন অন্য মুসলিমদের মতো। তাদের বড় উৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। পাশাপাশি তারা নিজস্ব কিছু সাংস্কৃতিক রীতিনীতি মেনে চলেন। তাদের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হলো নওরোজ। এটি সাধারণত মার্চের ২২ তারিখের কাছাকাছি অনুষ্ঠিত হয়। নওরোজ হলো কাজাখ পঞ্জিকা অনুযায় নববর্ষ। কাজাখ ভাষার সঙ্গে তুর্কি ও উইগুর ভাষার বেশ মিল আছে।
কাজাখরা পশুর মাংস ও দুগ্ধজাত খাদ্য খেয়ে থাকে। গরু, ভেড়া ইত্যাদির মাংস তাদের প্রিয়। পনীর, মাখন, ঘোলজাতীয় পানীয়, মাংসের পুর দেয়া পিঠা, ভেড়ার রোস্ট ইত্যাদি তাদের খুব প্রিয়। তবে তারা মুসলিম বলে শুয়োর, গাধা খায় না। রক্তপানও করে না। এবং ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী হারাম-হালালের বিধিনিষেধ মেনে চলে। তারা অতিথি আপ্যায়ন করতে খুব পছন্দ করে। অতিথির সামনে রোস্ট করা ভেড়ার মাথা এবং ভালো মাংস পরিবেশন করে। ঘোটকীর দুধ দিয়ে তারা একধরনের ননীজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। তারা দুধ চা পান করতেও ভালোবাসে। ময়দা দিয়ে তারা প্যানকেক, হটকেক, পেস্ট্রি, রুটি ইত্যাদি তৈরি করে। তারা ভাতও খায়। তারা খাওয়ার আগে ও পরে মোনাজাত করে।
কাজাখরা গানবাজনা খুব পছন্দ করে। তাদের অনেক লোকগাঁথা রয়েছে যা তারা সুর করে গায়। বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলে তারা লোককাহিনী গায়।
কাজাখরা উৎসবে অনুষ্ঠানে সিল্কের পোশাক খুব ভালোবাসে। কাজাখ পুরুষরা সাদা সিল্ক বা সাটিনের লম্বা শার্ট (কুর্তা ধরনের) পরে। কুর্তার কলার ও হাতায় নকশা করা থাকে। এর উপরে কালো কোটি পরে। ভেলভেটের তৈরি ওভারকোট পরে। কুচি দেয়া সালোয়ার বা ট্রাউজার এবং সঙ্গে থাকে উচুঁ বুট জুতা। তাদের টুপি তৈরি হয় পশুর চামড়া থেকে।
নারীরা রঙিন লম্বা কুর্তি এবং কোটি পরে। তাদের পোশাকে থাকে বিশেষ ধরনের এমব্রয়ডারি যা গোলাপ ও নানা রঙের ফুল তোলা। মেয়েদের টুপি থাকে নকশা করা ও রঙিন।
সাধারণ সময়য়ে নারী পুরুষ উভয়েই সুতির কাপড় পরলেও উৎসবে তারা সিল্ক, সাটিন, ফারের তৈরি নকশাদার পোশাক পছন্দ করে।
কাজাখদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিকার। ঈগল ও কুকুর তাদের খুব প্রিয় পোষ্য। ঈগলকে বাচ্চা বয়স থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শিকারী করে গড়ে তোলে। কুকুরকেও। কাজাখদের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি ঈগলের অনেক দাম।
কাজাখদের নিজস্ব মসজিদ রয়েছে।তারা সুন্নি মুসলিম। তবে তারা প্রয়োজনে অন্য জাতির(উইগুর, হুই) মসজিদেও নামাজ পড়ে।
রোজার সময় তারা রোজা পালন করে এবং ঈদে আনন্দ উৎসব, গান বাজনা ও খানাপিনার আয়োজন করে।
শান্তা মারিয়া
ছবি: ইন্টারনেট