এপ্রিল ২০: ফুকুশিমা বর্জ্য-পানি নিষ্পত্তির বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হলেও, জাপান নির্বিচারে সামনে এগুচ্ছে। সম্প্রতি আরও হাস্যকর যুক্তি দিয়েছে দেশটি, বলেছে, জাপানের বর্জ্য-পানি ব্যবস্থাপনার মান চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের চেয়ে ভালো, তাই এ দু’দেশের নিন্দা ‘অযৌক্তিক’।
এটা আসলে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার অপচেষ্টা মাত্র। ফুকুশিমা পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের দুর্ঘটনা এধরনের সবচেয়ে গুরুতর দুর্ঘটনা। এ থেকে উত্পাদিত বর্জ্য-পানি আর স্বাভাবিক অবস্থায় পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে উত্পাদিত বর্জ্য-পানি এক নয়।
গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ফুকুশিমা কেন্দ্রের বর্জ্য-পানি মোকাবিলা ‘এএলপিএস গ্রুপ কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এএলপিএস প্রক্রিয়া করার পরও ৭৩ শতাংশ বর্জ্য-পানি পরিবেশে নিঃসরণের অযোগ্য ছিল। গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় বলা হয়, এএলপিএস প্রক্রিয়ার সময় কোবাল্ট ও প্লুটোনিয়ামসহ বিপজ্জনক উপাদান বর্জ্যে থেকে যেতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে: যদি এ বর্জ্য-পানি সত্যিকার অর্থেই নিরাপদ হয়, তবে জাপান সরকার কেন একে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নিজ দেশের নদীতে বা জলাশয়ে নিক্ষেপ করলেই তো পারে! অথবা পারে কৃষিকাজে ব্যবহার করতে!!
বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এসব দূষিত পানি সমুদ্রে ফেলার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জার্মানির বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, যেহেতু ফুকুশিমার পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সমুদ্রস্রোত রয়েছে, সেহেতু সমুদ্রে ফেলার ৫৭ দিনের মধ্যে তেজস্ক্রিয় উপাদান সারা প্রশান্ত মহাসারগীয় অঞ্চলে ছাড়িয়ে যাবে। আর তিন বছর পর এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় দেখা যাবে; ১০ বছর পর এর প্রভাব সারা বিশ্বের সমুদ্রে দেখা যাবে। কেউ কেউ বলেন, জাপানের এ সিদ্ধান্ত যেন পৃথিবীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া।
আসলে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া ছাড়া জাপানের সামনে অন্যান্য নিরাপদ পদ্ধতি আছে। কিন্তু জাপান পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো, তা সবচেয়ে সস্তা। জাপান নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে নিজের জন্য নিম্নতম আর্থিক ক্ষতির উপায় বেছে নিয়েছে, কিন্তু বিশ্বকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিতে যাচ্ছে। এ মনোভাব দায়িত্বশীল ও নৈতিক নয়।
জাপানের সংস্কৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এটা হলো তাদের ‘লজ্জা সংস্কৃতির’ প্রতিফলন। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী রুথ বেনেডিক্ট তাঁর রচিত বই ‘দ্য ক্রিসান্থেমাম অ্যান্ড দা সোর্ড’-এ জাপানের সংস্কৃতির গভীর বিশ্লেষণ করেন। এ ‘লজ্জা সংস্কৃতি’ অনুসারে একজন ব্যক্তিকে অন্য মানুষের স্বীকৃতি পেতে হবে, নইলে তাকে আত্মঘাতী হতে হবে বা এ লজ্জা পরিষ্কারের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, জাপানের এসব আচরণের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটির সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেক মিল রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, জাপান জোর করে বর্জ্য-পানি সমুদ্রে ফেলার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তাদের উপনিবেশিক ও যুদ্ধাপরাধের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অস্বীকারের মনোভাব প্রতিফলিত হয়।
জাপানের উচিত আর কোনো ঐতিহাসিক দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ না করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরে তাদের আঘাতের দাগ এখনও শুকায়নি। আজ পারমাণবিক দূষিত পানি সমুদ্রে ফেললে তা মানবজাতির ভবিষ্যতের ওপর অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলবে। জাপানের উচিত এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা এবং মানবজাতির ভবিষ্যত ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দায়িত্বশীল মনোভাবের পরিচয় দেওয়া। (ইয়াং/আলিম/ছাই)