হংকংয়ের বিখ্যাত পার্শ্ব অভিনেতা লিও খাই চি
2021-04-08 15:27:28

হংকংয়ের বিখ্যাত পার্শ্ব অভিনেতা লিও খাই চি_fororder_liao

সাম্প্রতিক এক আলোছায়া অনুষ্ঠানে আমরা ‘নগ ম্যান তাত: হংকংয়ের একজন সম্মানিত অভিনেতার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি গত ৭ ফেব্রুয়ারি রোগাক্রান্ত হয়ে হংকংয়ের ইউনিয়ন হাসপাতালে মারা যান। সম্প্রতি হংকংয়ের চলচ্চিত্রাঙ্গানে আরেকজন বিখ্যাত অভিনেতাও না-ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন। তিনিই হলেন লিও খাই চি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা হংকংয়ের বিখ্যাত এই অভিনেতার গল্প আপনাদের শোনাবো।

 

গত ২৮ মার্চ রাত ৮টা ৩২ মিনিটে হংকংয়ের বিখ্যাত অভিনেতা লিও খাই চি পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৬ বছর।

আসলে তার মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে লিও খাই চি’র পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এতে অসংখ্য নেট ব্যবহারকারী অবাক ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।

 

আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে, মৃত্যু হঠাৎ করে কত কাছাকাছি চলে আসে। গত বছরের অক্টোবর মাসে এক দোকানে লিও খাই চি’র কাপড় বিক্রয়ের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠে। ভিডিওতে তাকে অনেক চিকন দেখা যায়। তার সাদা চুল ও চেহারাও বয়স্ক দেখা যায়। তার এই অবস্থা দেখে অনেক নেটব্যবহারকারীর মন খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। পরে সবাই বুঝতে পারে যে, সেই সময় তিনি একটি টিভি নাটকে কাপড় বিক্রির অভিনয় করছিলেন। এ তথ্য জানার পর সবাই তার সুদক্ষ অভিনয়ের প্রশংসা করেন। তার অভিনয় দেখে অনেকেই মনে করেন যে, তিনি সত্যিই কাপড় বিক্রি করছিলেন।

তার প্রশংসা করার পাশাপাশি মানুষ আবিষ্কার করেন যে, সেই সময় লিও খাই চি হালকা পাতলা হয়ে পড়েছিলেন।

 

প্রবীণ অভিনেতা হিসেবে লিও খাই চি অসংখ্য ক্ল্যাসিকাল চরিত্রে কাজ করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক আমাদের তরুণ সময়ের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত।

লিও খাই চি’র বাস্তব জীবন অস্থিতিশীলতা ও অসুস্থতায় ভরপুর। এখন আমরা একসঙ্গে তার জীবনের ওপর নজর দেবো।

হংকংয়ের অনেক শীর্ষ পর্যায়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রশিক্ষণ ক্লাস থেকে স্নাতক পাস করেছেন। লিও খাই চিও তাদের মধ্যে একজন।

 

১৯৫৪ সালে লিও খাই চি হংকংয়ের খুব সাধারণ ও দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের পরিশ্রম দিয়ে তিনি অবশেষে একজন অভিনেতা হন।

১৯৭৬ সালে তিনি সাহস নিয়ে ষষ্ঠতম প্রশিক্ষণ ক্লাসে নাম তালিকাভুক্ত করেন। দুঃখের বিষয় হলো, সুদর্শন না হওয়ায় তিনি তাঁর পছন্দের ক্লাসে ভর্তি হতে পারেন নি।

তারপর তিনি অভিনয় নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। তিনি ভাবেন, সুন্দর চেহারা না থাকলেও তিনি নিজের অভিনয় দক্ষতার ওপর নির্ভর করতে পারেন। ১৯৭৮ সালে তিনি অষ্টম প্রশিক্ষণ ক্লাসে ভর্তি হন। ক্লাসে বছরব্যাপী লেখাপড়ার পর তিনি হংকংয়ের টেলিভিশন ব্রডকাস্টস লিমিটেড বা টিভিবি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এর মধ্যে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিনোদন অঙ্গনে পা রাখেন।

সেই বছর লিও খাই চি’র বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর।

 

১৯৮০ সালে তিনি নিজের প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন, আর এ টিভি নাটকের নাম হলো ‘শাংহাই বিচ’। তবে তিনি এতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

‘শাংহাই বিচ’ টিভি নাটক প্রচারের পর এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রী সারা চীনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে লিও খাই চি এ নাটক থেকে তেমন উপকৃত হতে পারেন নি। এর প্রধান কারণ হলো এ নাটকে তার চরিত্র তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। দ্বিতীয়ত তিনি দেখতে সত্যিই সুদর্শন ছিলেন না।

এরপর লিও খাই চি নিজের সুদীর্ঘ পার্শ্ব অভিনেতার জীবন শুরু করেন। তিনিই বেশিরভাগ সময় হংকংয়ের চলচ্চিত্র ও নাটকের অর্ধেক আকাশ ধরে রাখতেন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করা বড় তারকার সংখ্যা বাড়লেও তিনি বরাবরই সাধারণ কোনো পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে যেতে থাকেন। তবে তার অভিনয়ের দক্ষতা প্রধান চরিত্রগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই খারাপ ছিলো না।

ধীরে ধীরে সময় চলে যায়। বিনোদন অঙ্গনে প্রবেশের এক দশকে পা রাখেন তিনি। টানা ১০ বছর ধরে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। খুব একটা বিখ্যাত না হলেও তিনি হংকংয়ের বিনোদন জগতের প্রবীণ মুখ হয়ে ওঠেন।

১৯৯২ সালে নিজের দক্ষ অভিনয় কৌশল দিয়ে লিও খাই চি’র ক্যারিয়ারে সবচে উজ্জ্বল সময় আসে। ‘ক্যাগম্যান’ নামক চলচ্চিত্রে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্রে অভিনয় দক্ষতার কারণে তিনি ১৯৯৩ সালের হংকং ফিল্ম অ্যাওয়াডর্সের শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার খেতাব অর্জন করেন। সেই বছর তার বয়স ৩৯ বছর ছিলো। সেই সময় তিনি নীরবে টানা ১৩ বছর ধরে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

 

১৯৯৩ সালের পর থেকে তার অভিনীত ক্ল্যাসিকাল চরিত্র যথাক্রমে চ

২০০০ সালের পর লিও খাই চি’র ক্যারিয়ার আবারও উন্নত হতে থাকে। নানা প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি, তিনি বারবার পুরস্কারের তালিকায় মনোনয়ন পেতে থাকেন। পরবর্তী ১৫ বছরে তিনি চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি হংকংয়ের চলচ্চিত্র ও টিভি অঙ্গনের খুব পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে দর্শকেরা বুঝতে পারেন যে, তার তৈরি চলচ্চিত্র বা নাটক নিঃসন্দেহে ক্ল্যাসিকাল শিল্পকর্মের মানে উন্নীত হয়।

 

গোটা জীবনে তিনি অভিনয়কে নিজের সবচে পছন্দের কাজ হিসেবে মনে করতেন এবং এক একটি ক্ল্যাসিকাল চরিত্র  তৈরি করতেন।

ক্যারিয়ারে চমত্কার সাফল্যের পাশাপাশি লিও খাই চি’র বাস্তব জীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়।

 

প্রশিক্ষণ ক্লাসের সময় তিনি বারবারা চান ম্যান ইয়ে’র সঙ্গে পরিচিত হন। তাকে প্রথমবার দেখে লিও খাই চি তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে, সেই সময় লিও খাই চি খুব ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন। আর চান ম্যান ইয়ে ইতোমধ্যেই টিভিবি’র বিখ্যাত অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তাদের দু’জনের পরিচিত হওয়ার মাত্র ৩ সপ্তাহের মাথায় লিও খাই চি সাহস নিয়ে চান ম্যান ইয়েকে জিজ্ঞাস করেন যে, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? চান ম্যান ইয়ে তাকে উত্তর দেন, হ্যাঁ। এভাবে তারা দু’জন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৭ সালে তাদের প্রেমের ৭ বছর পর তারা বিয়ে করেন। বিয়ের আগে ও পরে তারা দু’জন একে অপরকে খুব ভালোবাসতেন এবং সবার ঈর্ষণীয় দম্পতি হয়ে ওঠেন।

 

তারা ৩টি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। তৃতীয় সন্তান জন্মগ্রহণের পর স্ত্রী চান ম্যান ইয়ে বিনোদন অঙ্গন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি পরিবারে আরো বেশি মনোযোগ দিতে চান।

বিয়ের পর লিও খাই চি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে ওঠেন। আগের চেয়ে তিনি আরো বেশি ব্যস্ত ও পরিশ্রমী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করা ছাড়াও, তিনি মাঝেমাঝে নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন।

২০০৩ সালে দুঃখজনক একটি ঘটনা  ঘটে। মাত্র দুই বছর বয়সী ছোট ছেলে লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই খবরে তার পরিবার জীবনের অন্ধকার সময় ঘনিয়ে আসে।

সেই দু’বছরে লিও খাই চি অভিনয় করে চিকিত্সার টাকা রোজগার করা ছাড়াও, ছোট ছেলের চিকিত্সায় বিভিন্ন জায়গায় যান। তারপর স্ত্রী চান ম্যান ইয়ে বিষণ্ণতা-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং তার মানসিক অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

 

তাই তিনি সব অভিনয়ের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন। প্রতিদিন তিনি বড় ছেলে ও দ্বিতীয় ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর পর হাসপাতালে ছোট ছেলে ও স্ত্রীর দেখভাল করতেন। আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, তিন বছর ধরে চিকিত্সা করার পর ৫ বছর বয়সী ছোট ছেলে মারা যায়। প্রিয় ছোট ছেলের মৃত্যুর পর স্ত্রীর মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয়। সারা দিন তিনি সন্তান হারানোর বেদনায় বিষণ্ণ হয়ে থাকতেন। পরিবারের শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে লিও খাই চি বিশাল বেদনা বুকে চেপে রেখে মন দিয়ে অভিনয়ের কাজ করে যান।

 

তবে, এখন লিও খাই চি-ও আমাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তিনি এখন আমাদের মাঝে স্মৃতি হয়ে বেঁচে রয়েছেন।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)