জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবে ভোগান্তি চট্টগ্রাম বন্দরে
2021-04-01 20:58:05

 বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম বন্দর ‘চট্টগ্রাম বন্দর’। আমদানি-রফতানির ৭০ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় একমুখী চাপ তৈরি হচ্ছে এ বন্দর দিয়ে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কনটেইনার জট, ভোগান্তি বাড়ছে ব্যবসায়ীদের, সম্মুখীন হচ্ছেন আর্থিক ক্ষতির। তারা বলছেন, কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয়হীনতাই এর প্রধান কারণ। যদিও কার্যক্রমে ধীরগতির জন্য জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবকে দায়ী করছে কাস্টমস। অন্যদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, চলমান সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে সুফল মিলবে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে।

চট্টগ্রাম বন্দরে গেলেই চোখে পড়বে রাত-দিন বিরতিহীন চলছে কাজ। বিশাল বিশাল জাহাজ থেকে মালামাল বোঝাই কনটেইনার নামাতে ব্যস্ত যান্ত্রিক ক্রেন। আর সেসব কনটেইনার পরিবহনের কার্গোবাহী ট্রাকের চিত্কার।

খাদ্যশষ্য, দুধ-চিনি-তেলসহ ভোগ্য পণ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতিসহ এ বন্দর দিয়ে আমদানি হয় নানা পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় মাছ ও চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্য, ফল-সবজি ও তামাকসহ কৃষিপণ্য, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্যসহ বিপুল সামগ্রী। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি এই ৭ মাসে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। একই সময়ে রফতানি হয়েছে ২ হাজার ২৯১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নানা পণ্য।

দেশের এই আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। বিশেষ করে আমদানি হওয়া পণ্যের ৯০ ভাগই আসে এ বন্দর হয়ে। ব্যবসায়ীরা বলছেন,  চট্টগ্রাম বন্দর বছরে যে ৩০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে তাতে প্রতিদিন নিষ্পত্তি করতে হয় গড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার নথি। দিন দিন এ সংখ্যা আরো বাড়ছে। তবে তাদের অভিযোগ, নানা সংকটে ব্যহত হচ্ছে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বিশেষ করে পণ্য খালাস করতে কাস্টমস যে সফটওয়্যার –অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড ব্যবহার করে তা হালনাগাদ হয়না। আবার বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দেড় ডজন সংস্থা ও দফতরের নেই এ সফটওয়্যার ব্যবহারের সক্ষমতা। ফলে নথি নিষ্পত্তি পুরোপুরি অনলাইন না হওয়ায় কনটেইনার জট লেগেই থাকে।

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান দায়িত্ব দেশের শিল্পোদ্যোক্তা, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ও ব্যবসার খরচ কমাতে সহযোগিতা করা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা সঙ্গে নিয়ে এ বন্দর সে দায়িত্ব কতোটা পালন করতে পারছে?

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের ৫০ শতাংশ পোশাকখাতের কনটেইনার। আর মোট রফতানির ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক হওয়ায় ৯০ শতাংশ কনটেইনারই থাকে পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট। চট্টগ্রাম এলাকার পোশাক খাতের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন চৌধুরী। পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসিয়েশন -বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহসভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। জনাব নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলছিলেন, যে হারে বাণিজ্য বেড়েছে, সে হারে সক্ষমতা বাড়েনি চট্টগ্রাম বন্দরের। তাই কনটেইনার জটসহ নানা সমস্যা পিছু ছাড়ে না চট্টগ্রাম বন্দরের। 

বন্দরের ধারণক্ষমতার স্বল্পতার কারণে এখানে বাড়তি কন্টেইনার জমে যায় কিছু কিছু সমস্যা ডিও পাওয়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে বন্ধের দিনগুলোকে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় সেজন্যে পণ্য খালাসে সমস্যা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর তো আর একা সেবা দেয়না এর সঙ্গে কাস্টমস গভীরভাবে সংযুক্ত শিপিং এজেন্ট, ফরওয়ার্ড এজেন্সি, সি এন্ড এফ এজেন্ট, ব্যাংক সবার সমন্বয়েরই কিন্তু আমরা সেবা পাই সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এজেন্সিগুলো একইসঙ্গে কাজ করতে হবে সফটওয়ারের ত্রুটির কারণে ব্যবসা যদি দুই চার ঘণ্টা বন্ধ থাকে সেক্ষেত্রে আমিতো আটকে গেলাম সেই জায়গায় দশ বছর আগের সফটওয়্যার দিয়ে তো কাজ চালানো যাবে না আজকের বিশ্বে প্রতিদিন নতুন নতুন পরিবর্তন আসছে, নতুন নতুন উন্নয়ন হচ্ছে যেখানে যে প্রযুক্তি আসছে বা পরিবর্তন হচ্ছে এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাস্টমসকে সমন্বয় করতে হবে যত খরচই হোক”  -নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক প্রথম সহসভাপতি, বিজিএমইএ

জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবে ভোগান্তি চট্টগ্রাম বন্দরে_fororder_caijing1111

নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক প্রথম সহসভাপতি, বিজিএমইএ

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি'র সভাপতি মাহবুবুল আলমের মতে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাস্টমস এর কাজের সমন্বয়ে ঘাটতি আছে। আর এর ফলেই সহজ হচ্ছে না পণ্য খালাস থেকে শুরু করে নথিপত্র নিষ্পত্তিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। পাশাপাশি কাস্টমস এর নানা ভোগান্তির কথাও তুলে ধরেন তিনি।

বন্দরের সঙ্গে কাস্টমসের, এনবিআর এর একটা বড় ধরনের সমন্বয় থাকতে হবে কারণ, বন্দর কর্তৃপক্ষ মালামাল আসলে ডেলিভারি দেবে আর কাস্টমস এসব মালামালের নথিপত্র ঠিক করে নিষ্পন্ন করবে এই কাস্টমস এর সাথে যদি বন্দরের নিবিড় সম্পর্ক থাকে তাহলে অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়”  - মাহবুবুল আলম

জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবে ভোগান্তি চট্টগ্রাম বন্দরে_fororder_caijing2222

মাহবুবুল আলম, সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

যদিও চট্টগ্রাম কাস্টমস বলছে, অনলাইনে কাগজপত্র দাখিল করার সুযোগ থাকলেও অনেক ব্যবসায়ী এ সুযোগ নেননা। কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম জানান, বন্দরের ৬০-৭৮ শতাংশ নথি নিষ্পত্তি হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। বাকি নথিগুলো নিষ্পত্তি হতে কখনো ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি ও সমন্বয় দায়ী, কাস্টমস নয়, সাফ জানান এ কর্মকর্তা। পাশাপাশি পণ্যের মান পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই এর জন্য যে সময় লাগে তাতে কাস্টমস এর দায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, রাজধানীতে যেসব পরীক্ষাগারে পণ্যের মান যাচাই করা হয় সেই প্রতিবেদন পাঠানোর কাজ এখনো অনলাইন হয়নি, তাই ক্ষেত্র বিশেষে বাড়তি সময় লাগে।

২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা প্রায় ৬৮-৭০ শতাংশ নথি নিষ্পন্ন করে থাকি বাকি ৩০ শতাংশ নথির কাজ ২৪ ঘণ্টায় শেষ করা যায় না সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে দিন, দিন বা ক্ষেত্রে বিশেষ ১০-১২ দিনও লেগে যায় এই বাড়তি সময়ের জন্য কোন ভাবেই কাস্টমসকে দায়ী করা যাবে না এই বিলম্ব আমাদের ব্যবস্থাপনা বা নীতিগত কিছু বিষয়ের কারণে হয়

- মোহাম্মদ ফখরুল আলম

জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবে ভোগান্তি চট্টগ্রাম বন্দরে_fororder_caijing3333

মোহাম্মদ ফখরুল আলম, কাস্টমস কমিশনার, চট্টগ্রাম বন্দর

 

চট্টগ্রাম বন্দরের নানা সমস্যা থাকলেও, এর সংস্কারের পথও কম দীর্ঘ নয়। সাধারণ একটি কার্গো বন্দর থেকে কনটেইনার বন্দর হয়েছে এ চট্টগ্রাম বন্দর। এরপর বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হয়েছে। জাহাজ থেকে মালামাল বোঝাই কনটেইনার নামাতে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ১০ টি কী গ্যান্টি ক্রেন। পাশাপাশ তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয় করাসহ সন্নিবেশ করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা। আছে ব্যস্ততম ও সক্ষমতার সূচকে কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও।

২০২০ সালে লয়েডস লিস্টে বিশ্বের সেরা ১০০ কনটেইনার হ্যান্ডলিং বন্দরের তালিকায় ৫৮তম অবস্থানে জায়গা করে নেয় চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোভিড পরবর্তী সময়ের ব্যস্ততা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতোটা সক্ষম হবে এ বন্দর?

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য মো. জাফর আলম মনে করেন, আরো যেসব নতুন সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তার বাস্তবায়ন হলে শুধু কোভিড পরবর্তী সময়ে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যাবে সুফল।  

 

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একটা ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো সফটওয়্যার তৈরি করছে সেখানে একই বিষয়য়ের এন্ট্রি হবে একবার, এর জন্য আর অন্য কোন অফিসে যেতে হবে না এক জায়গা থেকে সব কাজ শেষ করে দ্রুত পণ্য খালাস করা যাবে এটার জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এটা সম্পন্ন হতে হয়তো আরো এক বছর সময় লাগবে এটা হয়ে গেলে বন্দরের সামগ্রীক কার্যক্রম উন্নত হবে” - মো. জাফর আলম

জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাগারের অভাবে ভোগান্তি চট্টগ্রাম বন্দরে_fororder_caijig4444

মো. জাফর আলম, সদস্য, প্রশাসন পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

 

তিনি বলছেন, শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নির্ভরতা এসব সমস্যার সমাধান নয়। বরং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ চট্টগ্রামের বে টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ হলে ২০২৬ সাল নাগাদ আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে নতুন বাংলাদেশ দেখবে বিশ্ব।