চীনা বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে বিদেশে দারিদ্র্যবিমোচন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
2021-03-31 13:38:06

ফুচিয়ান কৃষি ও বনবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাশরুম গবেষণালয়ের অধ্যাপক লিন চান সি ১৯৮৬ সালে  আবিষ্কার করেন চুনচাও (এক ধরনের ঘাস) চাষ প্রযুক্তি। তখন থেকে এ প্রযুক্তি চীনের বাইরে ব্যাপকভাবে  প্রচলিত হয়। এটি উন্নয়নশীল দেশসমূহের দারিদ্র্যবিমোচন, পানি ও ভূমি হ্রাস, মরুকরণ মোকাবিলা, এবং পশুপালন উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ২৬৬ বারের মতো চুনচাও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছে এবং ১০ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশক্ষিণ দেওয়া হয়েছে। নানা অঞ্চলের ১২টি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চুনচাও প্রযুক্তি দৃষ্টান্ত কেন্দ্র। চুনচাও প্রযুক্তি ১৫টি ভাষায় অনূদিত এবং ১০০টি দেশ ও অঞ্চলে প্রচারিত হয়েছে।

                                            

পাপুয়া নিউ গিনির পূর্ব পার্বত্য প্রদেশের গৃহিনী জাকাবরি প্রতিদিন নিজের চুনচাও ক্ষেতে গিয়ে মাসরুম বাছাই করেন। গেল বছরে মাশরুশ চাষের মাধ্যমে তিনি ১৫ হাজার কিনা (স্থানীয় মূদ্রা) অর্জন করেন। স্থানীয় পরিবারগুলোর অধিকাংশই কফি ও সবজি চাষ করে এবং তাদের বার্ষিক আয় মাত্র দুই থেকে এক হাজার কিনা। জাকাবরি জানিয়েছেন, চুনচাও ও মাশরুমের চাষে কোন সার এবং কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না এবং পরিবহন সহজ বলে এ ব্যবসার আয় সবজি চাষের  চেয়ে ২০-৩০ গুণ বেশি। মাশরুশ চাষের মাধ্যমে তার জীবন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। উপার্জিত টাকা দিয়ে সে তার শিশুকে স্কুলে পাঠতে পারে এবং নতুন পোশাক কিনতে পারে।

পূর্ব পার্বত্য প্রদেশের গভর্নর বলেছেন, তাঁরা চুনচাওকে চীনের উপহার হিসেবে মনে করেন। বর্তমানে প্রদেশটিতে মাশরুশ চাষি ৭০০ পরিবারের আছে এবং এর ৭০ শতাংশ নারী। তিনি বলেন, এ ঘাস আমাদের দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য এক বিশেষ উপহার।

 

পাপুয়া নিউ গিনি বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যতম। ১৯৯৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের আমন্ত্রণে চীনের একটি বিশেষজ্ঞ দল সেখানে গবেষণা করেন। পরে তাঁরা সেখানে একটি চুনচাও চাষ দৃষ্টান্ত স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটির কার্যক্রম ২০ বছর ধরে অব্যাহত রাখেন। চীনা বিশেষজ্ঞ লিন ইং সিং জানিয়েছেন, চীনা বিশেষজ্ঞদের প্রচেষ্টায় এখন পূর্ব পার্বত্য প্রদেশে কফির পর চুনচাও চাষ দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প। এ পর্যন্ত চীনা বিশেষজ্ঞরা সেখানে ১৮বারের মতো প্রশিক্ষণ ক্লাস নিয়েছেন। এবং মোট ১,৩৩৭জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

 

ফিজিতে এক হেক্টর চুনচাও ৩০টি গরু বা ৩০০টি ছাগলকে খাওয়ানো হয়। চুনচাও খেলে গরু ও ছাগলের শারীরিক বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। আফ্রিকান দেশ লেসোথোয় চুনচাও চাষকে দারিদ্র্যবিমোচনের কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে মনে করা হয়। কারণ এর উতপাদন ব্যয় কম এবং ৭-১০ দিনের মধ্য উত্পাদনের ব্যয় উসুল করা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষকরা ১০ বর্গমিটার একটি ক্ষেতে প্রতি বছর ১.২টন মাশরুম উত্পাদন করে। স্থানীয় নারীরা ফসল উঠানোর সময় নেচে-গেয়ে একে উদযাপন করে।

 

লেসোথোর রাজধানী মাসেরুর উত্তর দিকে একটি পাহাড়ে ফল গাছ ও ব্লুবেরি চাষ করা হতো। চীনা বিশেষজ্ঞরা এখন সেখানে স্থানীয়দের চুনচাও চাষের প্রযুক্তি চাষ শিখিয়ে দিচ্ছেন। লেসোথো একটি পাহাড়ি দেশ এবং পশুপালন দেশটির স্থানীয় প্রধান শিল্প। তবে, পশুপালন জমি ও পানির স্বল্পতা সৃষ্টি করে। স্থানীয় একজন কৃষক চুনচাও চাষ কেন্দ্রে প্রবেশ করেন এবং চীনা বিশেজ্ঞদের সঙ্গে পরিচিত হন। তখন থেকে তিনি চুনচাও চাষ শিখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, চুন চাও ব্যাপকভাবে চাষ হবার পর স্থানীয় পরিবেশ অনেক ভাল হয়েছে। পাশাপাশি চুনচাও সবুজ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বায়োগ্যাস বিদ্যুত সৃষ্টি করে। বিদ্যুত দিয়ে সেচ করাযায়। এবং বায়োগ্যাসের অবশিষ্টাংশ সার হিসাবে ফল গাছের চাষে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে একটি ভাল প্রাকৃতিক বাস্তুচক্র তৈরি হয়।

 

ত্রিশ বছর বয়সি চেপোখোয়া একজন মাশরুম চাষী এবং চুনচাও ব্যবহার করে তিনি পশুপালন করেন। ২০১৮ সালে তিনি চীন সফর করেছেন এবং তখন তিনি বুঝেছেন চুনচাও মরুকরণ মোকাবিলার পাশাপাশি অর্থনৈতিক আয় সৃষ্টি করতে পারে এবং এ শিল্পের বড় সম্ভবনা রয়েছে।

 

লেসোথো কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যা অনুযায়ী, সেদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাত্র ৭.৬ হেক্টর জমি চাষের উপযোগি। তবে এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ জমিতে পানি হ্রাসের সমস্যা ছিল। প্রতি হেক্টর জমিতে খাদ্যের উত্পাদন পরিমাণ মাত্র ০.৫ টন। যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত হয়, তাহলে ফসলের পরিমাণ ৩ টনে বাড়তে পারে। চীনের চুনচাও যেমন জমির পানি হ্রাস মোকাবিলার মাধ্যম। তেমনি পশুপালনের জন্য ভাল পশুখাদ্য। লেসোথোর মালভূমিতে আরও বেশি চুনচাও চাষ করলে চাষ জমি পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক হবে।

 

রুয়ান্ডা সারা দেশে চুনচাও ও ফল গাছ, ভুট্টা এবং সয়াবিনের যৌথ চাষের  প্রচলন করেছে। পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, মধ্য আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মাদাগাস্কার, এবং লাওস চুনচাও চাষকে পরিবেশ সংরক্ষণ ও মরুকরণ মোকাবিলার গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

 

ফিজির একটি পশুপালন বিষয়ক কোম্পানির ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কোম্পানির ৩০০০ একর চারণভূমিতে শুকনো মৌসুমে অপর্যাপ্ত ঘাস সমস্যা ছিল। ২০১৬ সালে চীনা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তারা চুনচাও চাষ শুরু করে এবং শুরুতে ৭ একর বড় ভূমিতে পরীক্ষা করে। তিন মাস পর চুনচাও খাওয়া গরু ও ছাগলের খুব ভাল শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে। তাই কোম্পানি চুনচাও চাষের আয়তন বৃদ্ধি করে। পশুখাদ্য হিসেবে ফিজিতে চুনচাওয়ের ব্যবহার প্রসারিত হচ্ছে। এখন ১০০০জনের বেশি পশুপালক চুনচাও চাষ করেন এবং শুকনো মৌসুমে পশুর মৃত্যু কম হয়।

 

পাশাপাশি, ফিজির আবহাওয়া গরম। তা মাশরুম চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। চীনা বিশেষজ্ঞগণ গবেষণার মাধ্যমে এ সমস্যা সামধান করেন। ফিজি ইতিহাসে প্রথম বারের মতো মাশরুম চাষ করতে পারে। এখন ৬০০টির বেশি পরিবার মাশরুম চাষ করছে। ফিজির কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, চুনচাওয়ের সাহায্যে মহামারির সময়ে পশুপালন শিল্প অব্যাহত ছিল। ফলে মাংসের সরবরাহ নিশ্চিত হয়।

 

২০১৭ সালে চুনচাও প্রযুক্তি জাতিসংঘ ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তাবয়নের কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশেও এর চাষাবাদ করে ভাল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ দারিদ্র্যবিমোচন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এক্ষেত্রে চীন-বাংলাদেশ সহজোগিতা জোরদারে উভয় দেশ লাভবান হতে পারবে।  (শিশির/এনাম/রুবি)