বসন্ত থেকে আবারও রওনা
2021-03-26 17:10:52

বসন্ত থেকে আবারও রওনা_fororder_31

 

চার বছর আগে চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উত্সবের সময়, চীনের মিডিয়াতে ‘বসন্তকালের দারিদ্র্যবিমোচনের ট্রেন’ নামে সিরিজ খবর প্রচার করা হয়েছিল। চীনের কুয়াংতুং প্রদেশে কাজ করা হু নান প্রদেশের হুয়া ইউয়ান জেলার মানুষ সি সিন, থেং চিয়ান হুই এবং ওয়েন লিং লিং-এর এই দারিদ্র্যবিমোচনের বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে দেশের বাড়িতে ফিরে বসন্ত উত্সব উদযাপনের গল্প জানিয়েছিলেন। যখন গল্পের প্রধান চরিত্র সি সিন দেশের বাড়িতে ফিরে যান, তখন তাঁর তিন বছরে ছেলে, মা চিয়া হুং বাসার সামনের ফল গাছের নিচে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। এই মুহূর্তের ছবি তুলেছিলেন সাংবাদিক এবং এই ছবির নাম দেওয়া হয়েছে ‘তিন বছর বয়সের অপেক্ষা এবং ৩৩ বছর বয়সের যাত্রা’। এই অর্থপূর্ণ ছবিটি কোটি কোটি নেট ব্যবহারকারীকে মুগ্ধ করেছে।

 

চার বছর পর সাংবাদিক আবারও হুয়া ইউয়ান জেলায় যান, সে বছরের খবরে উল্লেখ করা তিনটি চরিত্রের সঙ্গে আবারও সাক্ষাত্ করেন। তাদের জীবন পরিবর্তনের গল্প শোনেন। সি সিন এখনো বাইরে কাজ করছেন। থেং চিয়ান হুই জন্মস্থানে ফিরে নিজের কাজ শুরু করেছেন। ওয়েন লিং লিং কুয়াংতুং প্রদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভিন্ন পথে তাঁরা স্বপ্ন পূরণের দিকে ছুটে যাচ্ছেন।

 

১. সি সিনের গল্প

সি সিনের বাসার সামনে তাঁর ছেলে মা চিয়া হুং যে গাছের নিচে বসে বাবার অপেক্ষা করছিল, সেই গাছে বসন্তের ছোঁয়ায় ফুল ফুটেছে।

বাসার সামনে এক ছোট টেবিলে সি সিন ধৈর্যের সঙ্গে ছেলেকে লেখাপড়া করতে সাহায্য করছেন। যদিও এখন নতুন সেমিস্টার শুরু হয় নি, তবে তিনি ছেলেকে দ্বিতীয় বর্ষের নতুন বিষয় শেখানোর চেষ্টা করছেন।

সি সিন বলেন, আমার ছেলে খুব দ্রুত চার বছরের আগের তুলনায় অনেক বড় হয়েছে। এখন প্রায় আমার কাঁধের সমান উঁচু হয়েছে। তাঁর চোখে-মুখে ছেলের প্রতি ভালোবাসা দেখা যায়। চার বছর পার হয়েছে, এখন তাঁর ছেলে কিন্ডারগার্টেনের পাঠ শেষ করে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
 

বসন্ত থেকে আবারও রওনা_fororder_33

এবার বসন্ত উত্সবের সময় সি সিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন: তুমি কি চাও, আমি বাইরে গিয়ে তোমার জন্য টাকা উপার্জন করবো, নাকি বাসায় প্রতিদিন তোমার সঙ্গে খেলাধুলা করবো? তুমি কোনটা চাও?

ছেলে একটু চিন্তা করে বলে: বাসায় কয়েকটি দিন থাকুন।

বাসায় ফিরে আসি?

জ্বি।

ছেলে দিন দিন বড় হচ্ছে, ধীরে ধীরে সে সব কিছু বুঝতে পারছে। সি সিন মনে করেন, বাইরে যত কষ্টই হোক না কেন, পরিবারের জন্য সব কিছুই সহ্য করা যায়। তিনি বলেন, যে কাজ হোক, দুই, তিন বছর পর পর আমি নিশ্চয় বাসায় ফিরে আসবো। ছেলে ও বাবা মার কাছে ফিরে আসবো।

 

চার বছর আগে, দারিদ্র্যবিমোচন নীতির কল্যাণে, সি চিন জেলায় পেইন্ট করার প্রযুক্তি শিখেছিলেন তিনি। তারপর তিনি কুয়াংচৌ শহরের একটি খেলনা কারখানায় কাজ করা শুরু করেন। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার ইউয়ান বেতন পান। তিনি বাসার প্রধান অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি। যারা সি সিনের সঙ্গে পেইন্টের কাজ করেন, তারা অনেকেই আর এই কাজ করছেন না। তবে সি সিন এখনও এই কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রযুক্তি আরো দক্ষ হয়েছে, এখন তিনি এই কাজে ওস্তাদ হয়ে গেছেন। ‘বড় মাস্টার্স’ হয়েছেন।

 

সি সিন এখন আগের কারখানা থেকে পদত্যাগ করে নিজেই পেইন্টের কাজ শুরু করেছেন। গত দুই বছরে সি সিন বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। তিনি একবার ভিয়েতনামে গিয়ে কয়েক মাস ধরে কাজ করেছিলেন। তবে, সেখানের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইতে না পারার কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে আরো বেশি টাকা উপার্জনের জন্য তিনি কাজটি করতে থাকেন। কখনই কাজ ছেড়ে দেন নি।

বসন্ত থেকে আবারও রওনা_fororder_32

১০ হাজার ইউয়ান সঞ্চয় করার পর জন্মস্থানে ফিরে নিজের কাজ শুরু করা হলো চার বছর আগের পরিকল্পনা। ২০১৮ সালের শুরুতে দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের কল্যাণে সি চিনের বাবা পশু পালন শুরু করেন। সেই বছরই কিছু মুনাফা অর্জন করেন। তবে ২০১৯ সালে পশুগুলো রোগাক্রান্ত হওয়ায় সেই কাজ সফল হয় নি।

যদিও পশু পালনের কাজ সুষ্ঠু হয় নি, তবে এসময় তিনি যে টাকা সঞ্চয় করেন, তা সি সিনের স্বপ্ন পূরণের জন্য যথেষ্ট। সি সিন আরো পরিকল্পনা করেছেন। তিনি একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে একটি ছোট ট্রাক কিনবেন। তারপর দেশের বাড়িতে পেইন্ট সম্পর্কিত কাজ করতে যেতে পারবেন।

 

 

. থেং চিয়ান হুই-এর গল্প

থেং চিয়ান হুই-এর বাসার সামনে তিনটি গ্রিনহাউসে মাশরুম চাষ করা হয়।

সাংবাদিক দেখেন যে, এখন গ্রিনহাউসের মাশরুম ততটা বড় হয় নি। পরিমাণও খুব বেশি না। থেং সাংবাদিককে জানান, তিনি প্রথমবারের মত মাশরুম চাষ করছেন। এ কাজে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এখন আবহাওয়া গরম হচ্ছে, তাপমাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ছত্রাক তেমন বেশি ও বড় হবে না।

 

সাংবাদিক জানতে চান, তুমি কি ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়ার কথা মাথায় রেখেছো?

থেং ব লেন: ব্যর্থতাকে ভয় পাই না, ব্যর্থ হলে আবারও শুরু করবো।

আগের কারখানার কর্মগ্রুপের প্রধান হিসেবে থেং প্রতি মাসে ৮ হাজার ইউয়ানেরও বেশি আয় করতেন। তবে তিনি জন্মস্থানের উন্নয়নের সুযোগের ওপর আরো গুরুত্বারোপ করেন। গত বছরের অক্টোবর মাসে থেং-এর স্ত্রী একটি মাশরুম কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করে মাশরুম চাষ শুরু করেন।

থেং নিজে হিসাব করে দেখেছেন যে, যদি ভালোভাবে চাষ করা ও ফসল তোলা যায়, তাহলে প্রতি মু (এক মু ৬৬৬ বর্গমিটার) ছত্রাকের মাধ্যমে প্রতি বছর ২০ হাজার ইউয়ান আয় করা সম্ভব। যদি দশ মু ছত্রাক চাষ করা যায়, তাহলে প্রতি বছর অন্তত এক লাখ ইউয়ানেরও বেশি মুনাফা পাওয়া যায়।

থেং-এর জন্মস্থান বিয়ান ছেং থানা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানকার পর্যটন শিল্প অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। থেং ভাবছেন, কীভাবে গ্রামীণ পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে নিজের মাশরুম বিক্রি করা যায়।

চার বছর আগে থেং সাংবাদিককে বলেছিলেন, বাইরে কাজ করার কারণে ভালোভাবে পরিবারের যত্ন নিতে পারেন না। তিনি বলেন, প্রতিবার বাসায় ফিরে এসে দেখতে পারি যে তারা সবাই ব্যস্ত। তবে তাদেরকে কোনো কাজে সাহায্য করতে পারেন না। এখন বাসায় তিনটি শিশু আছে, আমার স্ত্রী একা সব কাজ করতে পারে না। থেং বলেন, তিনি বাবার দায়িত্ব পালন করতে চান।

 

থেং পরে কারখানার কাজ ছেড়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। তিনি ও স্ত্রী থানায় একটি বাড়ি ভাড়া নেন; যাতে আরো ভালোভাবে শিশুদের যত্ন নেওয়া যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামের পরিবর্তন থেংকে আস্থা দিয়েছে। প্রতিটি পরিবারে টয়লেট আছে, গরম পানির ব্যবস্থা আছে, গ্রামের পথ খুব সুন্দর, জেলা আরো বেশি প্রযুক্তিগত সাহায্য দিচ্ছে।

থেং বলেন, গ্রাম কর্তৃপক্ষ জানে যে আমরা মাশরুম চাষ করছি। তাই তারা জেলার কৃষি ব্যুরোর বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানায়। যাতে তারা আমাদের প্রযুক্তি শেখাতে পারে। থেং বলেন, ভালোভাবে পরিশ্রম করলে নিশ্চয় সফল হতে পারবে।

 

৩. ওয়েন লিং লিং-এর গল্প

‘তোমাকে মিস করি, তোমাকে মিস করি, তোমার সঙ্গে থাকতে চাই...’। হুয়া ইউয়ান জেলায় নিজের বাসায় ওয়েন লিং লিং নামের এক নারী সাত মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে গান গাইছেন। তিনি হাসতে পছন্দ করেন, গান গাওয়ার সময় তাঁর চোখে হাসি দেখা যায়। যেন তাঁর মেয়ের ডাক নাম ‘ছোট চাঁদ’।

২০১৯ সালের জাতীয় দিবসের সময় ওয়েন লিং লিং বিয়ে করেন। গত বছরের জুলাই মাসে তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। এই পরিবারে নতুন সদস্য সে।

এবারের বসন্ত উত্সবে ওয়েন আগের মত ট্রেনে যাতায়াত করেন নি। বরং স্বামীর সঙ্গে নিজের গাড়ি চালিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন।

ওয়েন মা হওয়ার পর তাঁর জীবনে নানা অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, তাঁর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল, তাঁর মন স্থির হয়েছে। তিনি মনে করেন, আগে জীবন সম্বন্ধে তাঁর নানা রকম চিন্তাভাবনা ছিল। তবে, এখন তিনি শুধু সুন্দর জীবনের জন্য কাজ করেন, মেয়েকে আরো ভালো জীবন দিতে চান তিনি।

 

বর্তমানে সাধারণ চীনাদের স্বপ্ন আরো সুন্দর হয়ে উঠছে। তাদের তিন জনের ছোট ছোট স্বপ্ন, যেন রাতের আকাশের তিনটি উজ্জ্বল তারা। এই যুগে সবাই স্বপ্নের পথে ছুটে চলেছে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)