চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ঢাকা স্টেশন থেকে প্রচারিত আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। কেমন আছেন আপনারা? আশাকরি সবাই সুস্থ আছেন, ভালো আছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের উদযাপন ও বঙ্গবন্ধুর ১০১ তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা চলছে।
এ উপলক্ষ্যে রয়েছে আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের বিশেষ আয়োজন।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী দেখতে পাচ্ছি এটাই জীবনের বড় প্রাপ্তি- বুলবুল মহলানবীশ
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী বুলবুল মহলানবীশ সিএমজি বাংলার ঢাকা স্টুডিওতে আলাপ করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী দেখতে পারছেন এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তিনি শিশুদের বন্ধু, মানবতার বন্ধু।’ বুলবুল মহলানবীশ ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় থেকেই সক্রিয় সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মার্চের ৯ তারিখ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংস্কৃতি কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নেন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সংগঠিত হতে থাকেন।
পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে পাকবাহিনীর গণহত্যার স্মৃতিচারণ করেন বুলবুল মহলানবীশ। তিনি বলেন, ‘সেদিন দুপুরের পর থেকে শহরের অবস্থা থমথমে ছিল।’ রাতে পাক সেনাবাহিনী শহরের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ‘দেখলাম আগুনের লেলিহান শিখা।’বলেন তিনি। তারা ঢাকা ত্যাগ করে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেসময় পোষা কুকুরকে বাড়িতে ফেলে আসার দুঃখজনক স্মৃতিচারণ করেন।
গ্রামের ভিতর দিয়ে পথ চলার ভয়াবহ স্মৃতি শোনান এই মুক্তিযোদ্ধা। জুলাই মাসে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একাত্তরে নির্যাতনের শিকার নারীদের কন্যার মর্যাদা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’
বুলবুল মহলানবীশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতিচারণ করেন।
বিখ্যাত চীনা নারী উদ্যোক্তা থাও হুয়াপি
থাও হুয়াপি হলেন চীনের একজন বিখ্যাত নারী উদ্যোক্তা। অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা থেকে তিনি বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নাম লাও কান মা। এটি চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় চিলি সসের ব্র্যান্ড। লাও কান মা শব্দের অর্থ বৃদ্ধা মা। ১৯৪৭ সালে কুইচোওর মেইথিয়ান জেলায় এক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে থাও হুয়াপির জন্ম। তিনি লেখাপড়া জানতেন না। ২০ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায় এবং তিনি দুই ছেলের মা হন। কয়েক বছর পর তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারের হাল ধরেন থাও। তিনি কুয়াংতুং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংচোও শহরে কাজের সন্ধানে যান। এর কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি নিজের শহরে ফিরে আসেন এবং নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন। তিনি বাজারে সবজি বিক্রি করাও শুরু করেন। এরপর তিনি কোল্ড নুডুলস ও চিলিসস বিক্রির একটি ছোট রেস্টুরেন্ট দেন। ধীরে ধীরে তার আয় উন্নতি হতে থাকে। ১৯৮৯ সালে তিনি শি হুই রেস্টুরেন্ট নামে একটি বড় রেস্টুরেন্ট খোলেন।
এরপরেই তিনি নিজের ফুড ব্র্যান্ড শুরু করেন। চিলি সসের জন্য তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার কোম্পিানির নাম হলো লাও কান মা স্পেশাল ফ্লেভার ফুডস্টাফ কোম্পানি। ১৯৯৬ সালে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তখন এর কর্মী সংখ্যা ছিল ৪০ জন। বর্তমানে প্রতিদিন ১.৩ মিলিয়ন বোতল সস উৎপাদিত হয়। চীনসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে এই সস বিক্রি হয়। থাও হুয়াপি এই কোম্পানির মালিক এবং তার ছেলে লি কুইশান প্রথম কোম্পানি প্রেসিডেন্ট। উইমেন অব চায়না পত্রিকার মতে ২০১১ সালে এই কোম্পানির সম্পদ ছিল ১.৩ বিলিয়ন ইউয়ান এবং কোম্পানির কর্মীসংখ্যা দুই হাজার। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। চীনা খাবারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহসৃষ্টিকারী চীনা বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর অন্যতম হলো লাও কান মা।
থাও হুয়াপি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য এবং ন্যাশনাল কংগ্রেসে একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্বও পালন করেছেন।
থাও হুয়াপি চীনের নারীর শ্রম ও ব্যবসা উদ্যোগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বিশেষ আয়োজনে বীর প্রতীক তারামন বিবির কথা
তারামন বিবি ৷ এক বীরত্বপূর্ণ নাম ৷ একই সাথে এক ইতিহাস ৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন নানা ভূমিকায় ৷ ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামে জন্ম নেওয়া তারামন বিবি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা মুহিব হাওলাদার ১১ নম্বর সেক্টরের একটি ক্যাম্পে তারামন বিবিকে ‘ধর্মকন্যা’ মেনে রান্না-বান্নার কাজে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি নানা কৌশলে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে পাক শিবিরে গেছেন বহুবার। কখনো পাগল বা কখনো প্রতিবন্ধী বা কখনো ভিখারী এমন নানা ছলে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন তিনি। নিজের জীবনের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করেন ৷ কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের অদম্য, দামাল কিশোরী তারামন বিবি ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ৬২ বছর বয়সে চিরবিদায় নেন।
বিশেষ প্রতিবেদন ‘অদম্য প্রাণ নারী চিয়াং শান’
এক প্রলয়ংকরী বন্যায় পরিবারের সবাইকে হারিয়েছিলেন চিয়াং শান। তখন তিনি ছোট্ট শিশু। ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৮ সালে চীনের হুবেই প্রদেশের চিয়ায়ু জেলায়। তিনি ছিলেন এক সুখী সংসারের মেয়ে। একরাতে গ্রামে দেখা দেয় ভয়ংকর বন্যা। বন্যার পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। পরিবারের সবাই ভেসে যায় জলের স্রোতে। চিয়াং শান ও তার দাদীমা আশ্রয় নেন একটি গাছে। কিছুক্ষণ পর সেই গাছটি ভেঙে পড়ে স্রোতের টানে। চিয়াং শানকে আরেটি গাছে তুলে দেন দাদী। কিন্তু নিজে ভেসে যান পানিতে। দীর্ঘ ৯ ঘন্টা সেই গাছটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকে ছোট্ট চিয়াং।
এখনও ভয়ংকর ঘটনাটি তার স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে।
তিনি বলেন, ‘ বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের বাড়ি, আমার আত্মীয় ও অনেক গ্রামবাসীকে। দাদীমা আমাকে বলেন গাছের ডাল শক্ত করে ধরে রাখতে। কিন্তু তিনি নিজে ভেসে যান পানিতে।’
তাকে উদ্ধার করেন ওয়াং মিংহুয়া নামে একজন পুলিশ সদস্য যিনি পিপলস আর্মড পুলিশ বাহিনীর একজন অফিসার। উদ্ধারকারী দল যখন তাকে উদ্ধার করে তখন সিসিটিভির সেই ঘটনার টিভি ফুটেজ সারা দেশে আলোড়ন তোলে। শিশু চিয়াংয়ের জীবন যিনি রক্ষা করেন সেই ওয়াং মিংহুয়া বর্তমানে জননিরাপত্তা বিভাগের একজন সিনিয়র সার্জেন্ট। সেদিনের উদ্ধার অভিযানের ঘটনা মনে আছে তার।
বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ২ আগস্ট, ভোর পাঁচটার দিকের ঘটনা। আমাদের দল তখন ১০জন দুর্গত মানুষকে উদ্ধার করেছে। হঠাৎ আমি দেখতে পাই গাছ থেকে কিছু একটা ঝুলছে। তীব্র স্রোতের মধ্যে চারবারের বার আমরা তাকে উদ্ধার করতে সফল হই। আমি শিশুটিকে শক্ত করে ধরে নৌকায় তুলে নেই।’
সেই বন্যায় ২৯টি প্রদেশ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল ও শহরে ২১.২ মিলিয়ন হেকটর জমি প্লাবিত হয়।
জীবন রক্ষা করায় পুলিশবাহিনীর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা থেকে নিজেও বড় হয়ে পুলিশ হওয়ার সংকল্প করেন চিয়াং।
চিয়াংয়ের সেই সংকল্প সফল হয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে ন্যাশনাল সিভিল সারভেন্ট পরীক্ষায় পাশ করে একজন পুলিশ অফিসার হন। ২০১৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন।
গত বছর করোনা প্যানডেমিকের সময় তিনি তার দায়িত্বপালনের সময় অনেক মানুষকে সহায়তা করেছেন। দেশ ও জনগণকে সেবা দেয়ার প্রতিজ্ঞা তিনি মনে প্রাণে পালন করছেন।
একবার ভূমিকম্পের সময় তিনি ডিউটি শেষ হওয়ার পরও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি আমার কর্তব্য পালন করি। আমি শুধু আশা করি অন্য মানুষদের সাহায্য করতে পারবো যেমন আমাকে অনেকে সাহায্য করেছেন। যিনি আমাকে বন্যার সময় জীবন বাঁচিয়েছিলেন ঠিক তার মতোই কাজ করতে চাই।’
অদম্য প্রাণ নারী চিয়াং শান এইভাবে একজন মানব কল্যাণী হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
প্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। অনুষ্ঠানটি কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আমাদের অনুষ্ঠান আপনারা সবসময় শুনতে পাবেন, ঢাকায় এফ এম ১০২ এবং চট্টগ্রামে এফ এম ৯০ মেগাহার্টজে এবং অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজে। জেনে নিন আমাদের ইমেইল অ্যাডরেস, cmg.bangla@gmail.com আমাদের ফেসবুক পেজ facebook.com/CRIbangla এবং facebook.com/CMGbangla এবংআমাদের সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে দেখতে পাবেন। youtube.com/CMGbangla.
আজ এ পর্যন্তই। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। আবার কথা হবে। চাই চিয়েন।
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
তারামন বিবি সম্পর্কে কথিকা: রওজায়ে জাবিদা ঐশী
ছবি: হোসনে মোবারক সৌরভ
অডিও সম্পাদনা: তানজিদ বসুনিয়া