বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
2021-03-22 16:11:27

আপনারা অবশ্যই জানেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন বিশেষ করে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে ও ঘটছে এবং এখন প্রায় সবাই তা ব্যবহার করে থাকেন। ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্কুলের ছাত্র ও ছাত্রীও রয়েছে। তবে বাচ্চাদের জন্য মোবাইল ফোন বা আইপ্যাড ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করা একটি কঠিন ব্যাপার। তাদের চোখ ও মেরুদণ্ড রক্ষায় প্রতিদিন মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। কম্পিউটারে অতিরিক্ত গেমস্‌ খেলাও তাদের দৃষ্টিশক্তির মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। চীনের ছাত্রছাত্রীরাও একই অবস্থার শিকার। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ ব্যাপার নিয়ে চীন সরকারের কিছু উদ্যোগ আর চীনের সিছুয়ান, ফুচিয়ান ও হুনানসহ বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ও আইপ্যাড ব্যবহারের চালচিত্র তুলে ধরবো।

বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?_fororder_mb2

সর্বপ্রথমে চীনা পরিবার ও মোবাইল ফোনের গল্প শেয়ার করি। ম্যাডাম ফেং ইংয়ের পরিবারে প্রতিদিন সদস্যদের মধ্যে মোবাইল ফোন নিয়ে ঝগড়া হয়। তাঁর দুই ছেলের একজন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ছে এবং আরেকজন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বড় ছেলে মোবাইল ফোনে গেমস্ খেলতে আগ্রহী, আর  ছোট ছেলে মোবাইলে ভিডিও দেখতে পছন্দ করে। তবে, বাচ্চাদের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার ঠেকাতে মা তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তিনি মোবাইল ব্যবহারের সময় ঠিক করে দিয়েছেন। তিনি বাচ্চাদের মোবাইল লুকিয়ে রাখেন। এ নিয়ে মা-ছেলে ঝগড়া হয় প্রায় প্রতিদিন।

মা জানেন সম্পূর্ণভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তবে মোবাইল ফোন থাকলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তার ব্যবহার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও তিনি জানেন না। আসলে ম্যাডাম ফেংয়ের মতো অনেক চীনা মা রয়েছে। বর্তমানে চীনের কতো ছাত্রছাত্রীর নিজের মোবাইল ফোন আছে? মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মোবাইল ফোন দিয়ে কী করছে? প্রতিদিন কতো ঘন্টা তারা তা ব্যবহার করে? কিভাবে বাচ্চাদের মোবাইল ফোনের নেশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়? বিশেষজ্ঞদের জরিপ থেকে এসব প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া গেছে।

চীনের শহরাঞ্চলের মাঝারি ও প্রাথমিক স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রীর নিজেদের মোবাইল ফোন আছে। তারা সাবওয়েতে গেমস খেলতে, অনলাইনে ক্লাস করতে, ইত্যাদি কাজে মোবাইল ব্যবহার করে। তবে বাচ্চাদের পিতামাতারা প্রায় সবাই মনে করেন, মোবাইল ফোনের ব্যবহার একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে। এমন উদ্বেগে ম্যাডাম লি চিং অনেক বছর ধরে বাচ্চাদের জন্য মোবাইল ফোন কিনেননি। তবে তাঁর বাচ্চা এখন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নিজের মোবাইল ফোনের জন্য সে বার বার তাগাদা দিতে থাকে। ফলে ইচ্ছা না-থাকলেও মাকে তার জন্য কিনতে হবে। মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ে মা বাচ্চাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রয়োজন ছাড়া তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না।

জরিপ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে চীনের প্রায় ৪৮.৫৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নিজের মোবাইল ফোন আছে। গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ব্যবহারের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে ১২ বছরের বাচ্চাদের মোবাইল ফোন কেনার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ৬৪.২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে চীনা ছাত্রছাত্রীরা বলেছে, নিজের মোবাইল ফোন থাকা স্বাভাবিক। কারণ, তাদের স্বাধীন স্বত্বা রয়েছে। ছোট বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর তাদের নিজের পরিচয়ে সামনে এগুতে হয়।  বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার সাথেও এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?_fororder_mb1

মোবাইল ফোনের ভুমিকা: বিনোদন ও সোশ্যাল যোগাযোগের পদ্ধতি

মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র চাং লেই শুরুর দিকে মোবাইল ফোনে গেমস খেলায় আগ্রহী ছিল না। তবে তার সহপাঠীরা অনেকে গেমস নিয়ে আলোচনা করে। তাই না-খেললে তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা জমে না। ফলে প্রায় ১ মাসের চর্চায় ছাত্র চাং লেইও গেমস খেলা শিখে ফেলে। সে এখন সবসময় মায়ের ফোনে মধ্যরাত পর্যন্ত অনলাইনে গেমস খেলে। এক সেমিস্টার এভাবে চলার পর লেখাপড়ায় তার অবনতি ঘটেছে।

জরিপ থেকে জানা গেছে, মোবাইল ফোন মানুষের জীবনে সুবিধা দেওয়ার সাথে সাথে ক্ষতিকর ভুমিকাও পালন করে থাকে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যারা ভালভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়। ছাত্রছাত্রীরা মূলত কয়েকটি কাজে মোবাইল ব্যবহার করে থাকে। অনলাইনের ক্লাসে অংশ নিতে প্রায় ৩৮.২৫ শতাংশ, অনলাইন গেমস খেলতে প্রায় ২৫.৩৭ শতাংশ, উপন্যাস পড়তে ও ভিডিও দেখতে প্রায় ২২ শতাংশ এবং বন্ধুদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথাবার্তা বলতে প্রায় ১৫ শতাংশ মোবাইল ব্যবহার করে। অন্যভাবে বললে, বিনোদনের জন্যই প্রায় ৬১.৭৫ শতাংশ মোবাইল ব্যবহার করে।

জরিপে আরও বলা হয়েছে, মোবাইলে গেমস খেলা ছাত্রছাত্রীদের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সস্তা বিনোদন। তারা মোবাইলের মাধ্যমে সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগও রক্ষা করে। তাই আরো বেশি শিক্ষার্থী মোবাইলের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী।

মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় ৪০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ১ ঘন্টারও বেশি

চীনের হুনান প্রদেশের ইইয়াং শহরের আনহুয়া জেলার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক লিউ সি ছোং ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় নিয়ে নিয়মকানুন নির্ধারণ করেছেন। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ; শনিবার ও রোববার প্রতিদিন ১ ঘন্টার মতো মোবাইল ব্যবহার করা যাবে। তবে ছুটির সময় তিনি খেয়াল করেন যে, বাচ্চারা স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে অনেক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। কারণ, তাদের বাবা-মা শহরে চাকরি করেন, দাদা-দাদী বা নানা-নানী মোবাইল ফোনের সময় নিয়ন্ত্রণ করেন না। অনেকে সারাদিনই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। আসলে এবারের জরিপ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন এক ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে বাবা-মা বাচ্চাদের এ ব্যাপারে পরামর্শ দেন। তবে দীর্ঘকাল ধরে পরামর্শ অবশ্যই কার্যকর থাকে না। বাচ্চারা একসময় বাবা-মায়ের কথা আর শোনে না। ফলে অনেক বাবা-মা কাগজে প্রতিদিনের সঠিক সময়সূচি তৈরি করেন। যেমন, কখন মোবাইল গেমস্ খেলা যাবে, কখন হোমওয়ার্ক করতে হবে, ইত্যাদি। জরিপ থেকে জানা গেছে, মোবাইল ফোন নিয়ে বাবা-মা ও বাচ্চাদের মধ্যে টানাপড়েন চলে। অনেকে পরিবারে আছে এ নিয়ে অশান্তি। বাবা-মায়ের পরামর্শ না-শুনলে সাধারণত শাস্তি আরোপ করা হয়। যেমন, একদিনে এক মিনিট মোবাইলে গেমস্‌ খেলার সুযোগ না দেওয়া। এতে বাচ্চারা বিদ্রোহী আচরণ করে থাকে। এতেও পরিবারের অশান্তির সৃষ্টি হয়।

বর্তমানে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করা অনেক জরুরি ব্যাপার। একদিকে বাবা-মা মনে করেন, তাদের বাচ্চা মোবাইল খেলার জন্য অনেক সময় নষ্ট করছে এবং ইন্টারনেটে আসক্ত। অন্যদিকে, ৮৩.৬ শতাংশ বাচ্চা মোবাইল গেমস খেলছে, তবে নিজেকে ইন্টারনেটে আসক্ত মানতে নারাজ। ছেলে ও মেয়ের মধ্যেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে। মেয়েরা ছেলেদের তুলনা কম ইন্টারনেটে আসক্ত।

যারা পড়াশোনায় কম আগ্রহী, তাদের মধ্যে অনেকে কম্পিউটার গেমস খেলতে বেশি আগ্রহী। বাচ্চাদের বাবা-মা এ অবস্থায় বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করেন। কেউ কেউ মনে করেন, কম্পিউটার গেমস খেলা বুদ্ধিমান ও মেধাবীর প্রতীক। তবে এমন পিতামাতার সংখ্যা খুবই কম, মাত্র ২ শতাংশ।

মোবাইল ফোন ব্যবহারের জরিপ থেকে আরও অনেক তথ্য জানতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন, বাচ্চাদের পিতামাতা কম্পিউটার গেমস খেলে কি না, স্কুলের শিক্ষক বাচ্চাদের যত্ন নেন কি না, বাচ্চাদের সঙ্গে পিতামাতার কথাবার্তার অবস্থা, বাচ্চাদের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক ভালো কি না, পিতামাতা ইন্টারনেট ব্যবহারের ধারণা কী, ইত্যাদি বাচ্চাদের মোবাইল ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলে। আসলে পরিবার, সমাজ ও স্কুলের যৌথ প্রয়াসে বাচ্চাদের সুষ্ঠু অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব এবং মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়ানো যায়।

ছুটির দিনে বাবা-মার বাচ্চাদের যথেষ্ট বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য কাজ করাকে বাচ্চাদের শখ হিসেবে উত্সাহিত করতে হবে। নিয়মিতভাবে বাচ্চাদের সাথে কথাবার্তা বলতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হবে।

স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যাদের পড়াশোনায় আগ্রহ কম, তাদের লেখাপড়ার আগ্রহ বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সঠিক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মোদ্দাকথা, মোবাইল ফোন আধুনিক সমাজে মানুষে-মানুষে যোগাযোগের অপরিহার্য যন্ত্র। কিন্তু সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে হবে এবং বাচ্চাদের এর সঠিক ব্যবহার শেখাতে হবে।  

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান যারা মিস করেছেন, তারা আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানতে পারেন।

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে, যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)