চীনের দরিদ্র এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প
2021-03-15 14:48:48

আপনারা যারা নিয়মিত আমাদের অনুষ্ঠান শুনেন, তারা অবশ্যই জানেন গত বছরের শেষ দিকে সারা চীনের দরিদ্র এলাকাগুলোর সবই দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। কিছু কিছু অঞ্চলের গ্রামের আর্থিক অবস্থা এখনও খারাপ। সেগুলো মাত্র দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছে। তবে, সার্বিকভাবে হতদারিদ্র্যমুক্ত হওয়া চীনের জন্য বড় সাফল্য। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই চীন দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের চরম দরিদ্র এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প তুলে ধরবো। তাদের দারিদ্র্যমুক্তি গল্প অনেক চমকপ্রদ।

চীনের কানসু প্রদেশের তিংসি শহরের সিয়াংছুয়ান গ্রামের নারী মা ইয়ু হুয়া স্থানীয় অঞ্চলের একজন সুপরিচিত নারী। যদিও তিনি অশিক্ষিত, নিরক্ষর, তবে তাঁর তিন ছেলেমেয়ের সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছে। এটা তাঁর জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার।

কানসু প্রদেশের নিরক্ষর মায়ের গল্প

আসলে ৪৬ বছর বয়সের মা ইয়ু হুয়া’র জীবন ছিল অনেক কষ্টের। তাঁর স্বামীর শরীর অনেক খারাপ। তাই কোনো কাজ করতে পারতেন না। তিন ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। তাই ২০১৬ সালে স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের নামতালিকায় নিবন্ধিত হয় তার পরিবার। কৃষিকাজ করার পাশাপাশি, গ্রামে একাধিক অস্থায়ী কাজও করতেন মা ইয়ু হুয়া। তিনি স্বামীর যত্নও নিতেন।  গোটা পরিবারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। তাঁর জন্য সুখের ব্যাপার ছিল এই যে, তাঁর দু’মেয়ে ও একটি ছেলে স্কুলে পড়াশোনায় সেরা এবং তারা মা’কে বিভিন্ন কাজে সহায়তা দিত।

এ সম্পর্কে মায়ের ছেলে মা ওয়েন বো স্মরণ বলেন, ‘আমার বাবা আগে বলেছিলেন, আমাদের জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে শিক্ষাগ্রহণ। কষ্ট হলেও পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত থাকা যাবে না।’

চীনের দরিদ্র এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প_fororder_xj

২০১৬ সাল থেকে মা ইয়ু হুয়া’র তিন ছেলেমেয়ে কানসু নর্মাল একাডেমি, দুর্যোগ প্রতিরোধক বিজ্ঞান প্রযুক্তি একাডেমি এবং নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে অনেক আর্থিক চাপের সম্মুখীন হন মা ইয়ু হুয়া । তখন স্থানীয় সরকার তাঁর পরিবারের অবস্থা জেনে সহায়তা দেয়। যেমন, গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘর মেরামত করে দেয়, বাচ্চাদের জন্য অস্থায়ী ভর্তুকি হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার ইউয়ান দেয়, সাথে সাথে তাদের পড়াশোনার ব্যয় ঋণ হিসেবে দেয়। যদিও মা ইয়ু হুয়ার পরিবারের জীবন ছিল কষ্টের, তবে বিভিন্ন সাহায্য পাওয়ার পর তাদের জীবনের কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়।  ২০১৯ সালের জুন মাসে মা ইয়ু হুয়ার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। তখনও পরিবারের সব দায়িত্ব তাঁর কাঁধে রয়ে গেছে।

এ সম্পর্কে মা ইয়ু হুয়া বলেন, ‘আমার স্বামীও অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তিনি অশিক্ষার কুফল বুঝতে পেরেছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে আমাকে বললেন, কষ্ট করে হলেও বাচ্চাদের পড়াশোনা নিশ্চিত করতে হবে।’

তখন থেকেই মা ইয়ু হুয়া বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ সংগ্রহ করতে প্রতিদিন দু’টি চাকরি করতেন, কৃষিক্ষেতে চাষ করতেন, ছাগল পালন করতেন, এবং একটি রেস্তোঁরায় অস্থায়ীভাবে  কাজ করতেন। এতো ব্যস্ততার কারণে তার অনেক ক্লান্ত লাগত। তবে বাচ্চাদের ফোন পেয়ে স্কুলের পড়াশোনার খবর জানার পর তার ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো। তিনি আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতেন। তাঁর আয় করা সব অর্থই বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিতেন তিনি। ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসেস লিখতে কম্পিউটার কিনতে হবে। তখন তিনি ভুট্টা বিক্রি করে ৬০০০ ইউয়ান ছেলেকে পাঠিয়ে দেন।

সারা পরিবারের যৌথ প্রয়াসে সুখবর আসে। ২০২০ সালে মা ইয়ু হুয়ার বড় কন্যা সফলভাবে স্নাতক হয় এবং তিংসি শহরের একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করে। ছোট কন্যাও চীনের জিওসিএসেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্স্টাস ক্লাসে ভর্তি হয়। যদিও তা খুবই ভালো ব্যাপার, তবে মাস্টার্সে পড়াশোনার খরচ মা ইয়ু হুয়ার জন্য নতুন আর্থিক বোঝায় পরিণত হয়। তিনি আগের মতোই পরিশ্রম করতে থাকেন। বড় কন্যা বেতন পেয়ে মায়ের জন্য নতুন কাপড় কেনে এবং ছোট ভাই-বোনের জন্য কিছু টাকাও পাঠায়। এতে মা ইয়ু হুয়া অনেক খুশী।  আরো কয়েক মাস পর ছোট ছেলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে এবং তার চাকরিও প্রায় ঠিক। ছেলে মা ওয়েন বো বলেন, ‘যখন আমি বেতন পাবো, তখন মাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো, গ্রামের বাইরে বিশ্ব দেখাবো।’ তিনি সংবাদদাতাকে বলেন, যদিও মা অশিক্ষিত মানুষ, তবে আন্তরিক ভালোবাসা ও সমর্থনে তাদের যত্ন নেন; তাই মা’র সাথে সুখী জীবন ও সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে চান তিনি।

হ্যপেই প্রদেশের লুয়ানচৌ শহরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ওয়াং সিয়াও ফেং’র গল্প

চীনের হ্যপেই প্রদেশ রাজধানী বেইজিং থেকে বেশি দূরে নয়। লুয়ানচৌ শহরের ইয়োচা জেলার ওয়াংকুয়ানইং প্রাথমিক স্কুল পাহাড়াঞ্চলে অবস্থিত। স্কুলে মোট ১৮টি ক্লাসের ৬১৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ৪৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩ জন ক্রীড়া-শিক্ষক। তাদের মধ্যে একজন ৫৯ বছর বয়সের ওয়াং সিয়াও ফেং। তিনি স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক। শিক্ষকতার জীবন সম্পর্কে ওয়াং বলেন, “আমার কলেজের মেজর গণিত। তাই ১৯৯১ সালে স্নাতক হওয়ার পর একজন গণিত শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। তবে স্কুলে তখন খেলাধুলার শিক্ষক ছিল না। তাই গণিত ও খেলাধুলা একসাথে পড়াতে হতো।” স্কুল অনেক দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলে অবস্থিত। তাই এখানে নতুন ক্রীড়া-শিক্ষক আনা মুশকিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করেন। তাই ১৯৯৫ সাল থেকে খেলাধুলার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন।

স্কুলে কোনো খেলার মাঠ ছিল না। তখন তিনি নিজেই পাহাড় থেকে মাটি কেটে এনে একটি খেলার মাঠ তৈরি করেন। শিক্ষক ওয়াং তার জীবন এ স্কুলে কাটিয়েছেন। ২০১২ সালে লুয়ানচৌ শহরে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। তখন তিনি কম সময়ের মধ্যে একটি ২০ জন খেলোয়াড়ের দল গঠন করেন। এ সম্পর্কে শিক্ষক ওয়াং বলেন, “বাচ্চাদের বাস্কেটবল খেলায় কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। আমিও পেশাদার কোচ নই। তাই শূন্য থেকে আমাদের চর্চা শুরু করতে হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে বাস্কেটবল প্রশিক্ষণ ভিডিও দেখে আমি খেলা শিখি এবং বাচ্চাদের শিখাই।”

শুধু ক্লাসের পর বা গ্রীষ্মকাল ও শীত্কালের ছুটিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতে পারতো। শিক্ষক ওয়াং বলেন, বাচ্চাদের খেলার দক্ষতা বাড়ার পর তারা ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের স্কুলে খেলার অভিজ্ঞতা নিতে যায়।

পরিশ্রমের ফলে জেলার প্রতিনিধিদল হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় দলটি এবং তখন থেকে স্কুলের রাঙ্কিং ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। ২০১৬ সালে স্কুলের হোস্টেল ও অফিস ভবনের নতুন মেরামত কাজ চালু হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিমেন্টের খেলার মাঠও তৈরি করা হয়েছে। এ সম্পর্কে স্কুলের প্রেসিডেন্ট সু ছুন রুং বলেন, ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্কুলে যোগ দেন এবং তখন স্কুলে মাত্র একটি ছোট খেলার মাঠ ছি। সেটা বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই ২০১৯ সালে নতুন বড় খেলার মাঠ নির্মিত হয় এবং বাস্কেটবল খেলার মাঠও হয়।

গত কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাস্কেটবল খেলার দক্ষতা অনেক উন্নত হয়েছে। ২০১৯ সালে চীনের বৈশিষ্ট্যময় বাস্কেটবল স্কুল নির্বাচিত হয়েছে এটি। এখন শিক্ষক ওয়াং বাচ্চাদের জন্য শুধু কোচ নন, বরং ঘনিষ্ঠ দাদার মতো। আবহাওয়া ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে, পাহাড় পুনরায় সবুজ হচ্ছে। এক বছর পর অবসর নেবেন তিনি। তবে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ ভালভাবে চলবে বলে তিনি আশা করেন।

চীনা বাচ্চাদের ঘুমের সময় নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞদের আহ্বান

সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞান একাডেমির মনোবিজ্ঞান গবেষণাগারের প্রকাশিত ‘চীনা নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের শিক্ষার্থীদের ঘুমের সময় যথেষ্ঠ নয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। স্কুল ও পরিবারের যৌথ প্রয়াসে ছাত্রছাত্রীদের ঘুমের সময় বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

আসলে স্কুলের হোমওয়ার্কের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ঘুমের সময় অনেক কমে গেছে, বিষয়টা তা নয়। জরিপ থেকে জানা গেছে, ৯৫.৫ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীর প্রতিদিনের ঘুমের সময় ১০ ঘন্টার চেয়ে কম, মাত্র ৮.৭ ঘন্টা; ৯০.৮ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীর ঘুমের সময় ৯ ঘন্টার চেয়ে কম, মাত্র গড়ে ৭.৬ ঘন্টা; এবং ৮৪.১ শতাংশ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর ঘুমের সময় ৮ ঘন্টার চেয়ে কম, গড়ে মাত্র ৭.২ ঘন্টা।

গত ১০ বছর আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের ঘুমের সময় হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষ করে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির পর এ প্রবণতা আরো স্পষ্ট হয়। এ সম্পর্কে চীনের নানচিং নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছেং পিং ইউয়ান বেন, চীনা ছাত্রছাত্রীদের ঘুমের সময় কমা শুধু পড়াশোনা ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।

গ্রামাঞ্চলের অনুন্নত এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষাসম্পদের অভাবের কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী বড় শহরের ছাত্রছাত্রীদের সমান সুযোগ পেতে অতিরিক্ত সময় পড়াশোনা করে থাকে। তাই তাদের ঘুমের সময় কমে যায়। অন্যদিকে, বড় শহরের ছাত্রছাত্রীরা বিকেল সাড়ে তিনটার পর স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। তবে স্কুলের বাইরে আরো কিছু অতিরিক্ত ক্লাস থাকে তাদের, যেমন নাচের ক্লাস, কারাতের ক্লাস, গানের ক্লাস, ইংরেজি ভাষার ক্লাস, ইত্যাদি। তাই ঘুমের সময়ও যায় কমে।

মোদ্দাকথা, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় গোটা সমাজের যৌথ প্রয়াস প্রয়োজন। পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনকে এ ব্যাপারে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। আইপ্যাড বা মোবাইল ফোনের খেলাসহ বিভিন্ন অনলাইন গেমসে অনেক ছাত্রছাত্রী বেশি সময় নষ্ট করে। হোমওয়ার্কের পাশাপাশি, গেমস্‌ খেলেও তারা অনেক সময় নষ্ট করে। এই নষ্ট সময় আসে ঘুমের বিনিময়ে। তাই ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মার উচিত নিজেরাও সবসময় মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। অন্তত বাচ্চাদের সামনে তো বটেই। নিজেরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে সন্তানকে সেটা থেকে দূরে রাখা মুশকিল।

সুপ্রিয় বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়,আজকের বিদ্যাবার্তা এখানে শেষ হয়ে এলো।আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে মিস হলে আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন।ওয়েবসাইট ঠিকানা www.bengali.cri.cn,ফেসবুকে CRIbangla মাধ্যমে চীন ও বিশ্ব সম্পর্কে তথ্য জানতে সক্ষম।

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি,সবাই ভালো থাকুন,সুন্দর থাকুন,আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে, যাইচিয়ান।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)