করোনা মহামারির এক বছর: দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে বাংলাদেশে
2021-03-14 19:41:28

বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের বছর পেরিয়েছে গত ৮ মার্চ। গেল বছরের এদিনে প্রথম দেশে ৩ জনের করোনা আক্রান্তের খবর দেয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর। করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ। এরপর গোটা বছর ধরে করোনার আতঙ্ক-উদ্বেগের মধ্যে কেটেছে গোটা জাতির। এক বছরে করোনায় মারা গেছেন সাড়ে ৮ হাজারের বেশি মানুষ। শনাক্ত হয়েছেন সাড়ে ৫ লাখের বেশি। আর সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখের বেশি মানুষ। নমুনা পরীক্ষা করা হয় প্রায় ৪২ লাখ মানুষের।

মাঝে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই কমে আসে। দৈনিক মৃত্যু এক অঙ্কে নেমে আসে। আর সংক্রমণ নেমে এসেছিল ২ শতাংশে। এরই মধ্যে দেশব্যাপী শুরু হয় করোনার গণটিকাদান কর্মসূচি। প্রথম দিকে খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা। প্রথম দফায় ৮০ লাখ টিকা আসে দেশে। সরকারের কেনা ও কোভ্যাক্সের সহায়তাবাবদ পাইপলাইনে রয়ে আরও ৫ কোটির বেশি টিকা। সব মিলিয়ে আশা করা হচ্ছিল যে করোনা মহামারি হয়তো বা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে দেশ।

কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এসেই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই উর্ধ্বমুখী। মৃত্যু ফের দুই অঙ্কে। শনাক্ত হারও ছাড়িয়ে গেছে ৫ শতাংশ। গত পাঁচদিন টানা সংক্রমণ রয়েছে হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা একে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন।

কিন্তু কেন এমনটা হলো? করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুইই কমলো। শীত চলে গেল। সর্বোপরী গণটিকা কর্মসূচি চালু হলো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একে করোনার ওপর বিজয় হিসেবে ঘোষণা করলেন। কিন্তু করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ায় সব কিছু যেন উল্টে গেলো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, মানুষ টিকা নিয়ে বেপরোয়া হয়ে গেছে। কেউ আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, ডেকে আনছে বিপদ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে দেশে আরও ভয়বহ বিপদ নেমে আসতে পারে। তিনি একে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন। দ্বিতীয় এ ঢেউ মোকাবেলার জন্য দেশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানান স্বাস্থ্যডিজি।

এদিকে, হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণের এ উর্ধ্বগতির পিছনে আবহাওয়াগত কারণ দেখছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন শীত মৌসুমে জ্বর বা নিউমোনিয়ার কারণে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ততটা বাড়তে পারেনি। গরম চলে আসায় জ্বর বা নিউমোনিয়া ভাইরাস কমে গেছে। আর করোনা ভাইরাস বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।

তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ করোনা প্রকোপ বাড়ার জন্য স্বাস্থ্যবিধি না মানাকেই প্রধানত দায়ী করছেন। করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর লোকজনের মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি একেবারেই কমে যায়। আর টিকা কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর তা প্রায় অদৃশ্য।  আর যা হবার তাই হয়েছে। বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু। এর ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গিয়ে পড়লো দেশ।

এদিকে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টিকা কর্মসূচি পার করেছে ৩০তম দিন। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান এ কর্মসূচিতে সারাদেশে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ মানুষ। নিবন্ধ করেছেন ৫৫ লাখের বেশি মানুষ। রাজধানীসহ সারাদেশে সুশৃঙ্খলভাবে টিকা কর্মসূচি চলছে। সরকারে মন্ত্রী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টিকা নিয়ে শুরু থেকেই জনসাধারণের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন। সবশেষ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও টিকা নিয়েছেন। কিন্তু নিবন্ধন জটিলতাসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই টিকায়। তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও খেটেখাওয়া মানুষদের টিকার আওতায় আনতে পরিকল্পনার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। নইলে টিকা কর্মসূচি ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

এর মধ্যে আরেকটি হতাশা কথা শিক্ষাঙ্গনের জন্য। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। করোনা প্রকোপ কমে আসায় ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ ও ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু হঠাৎ করোনার প্রকোপ বাড়ায় এ সময় পেছাতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিষয়টা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশার হলেও করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের গতিপ্রকৃতি বোঝার আগে স্কুল-কলেজ না খোলাই সঙ্গত।

মাহমুদ হাশিম, ঢাকা থেকে।