স্থানীয় সময় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঘোষণা করেন যে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমন একটি সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে চলেছে, যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তি উদযাপন করছে জাতি।
১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোন দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে।
ঠিক দুদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বেইজিংয়ে জাতীয় দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছেন যে, চীন জাতির সকল মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায় সিপিসি প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী উপলক্ষে চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের লড়াইয়ে সার্বিক বিজয় অর্জন করেছে। বর্তমান মানদন্ড অনুযায়ী ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, এবং ৮৩২টি জেলা এবং ১লাখ ২৮হাজার গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। চীন চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ করেছে, যা বিশ্বে বিষ্ময় সৃষ্টি করেছে।
প্রায় একই সময়ে চীন ও বাংলাদেশ নিজ নিজ ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সূচকে দারিদ্র্যবিমোচন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০০১ সালে বাংলাদেশে দরিদ্রের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে এ সংখ্যা কমে ২০.৫ শতাংশ নেমে এসেছে।
চীন ও বাংলাদেশের বড় অগ্রগতি শুধু তাদের নিজের নয়, বরং সারা বিশ্বের। সারা বিশ্বে বর্তমানে ৭০ কোটি মানুষ চরম দরিদ্র। এ প্রেক্ষাপটে ১৪০ কোটি জনগোষ্ঠীর চীন নানা কষ্ট কাটিয়ে উঠে চরম দারিদ্র্য দূর করেছে, যা বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনে ব্যাপক অবদান রেখেছে। তা ছাড়া, বিরাট উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের সাফল্যে বিশ্বের নানা দেশ উত্সাহিত হয়েছে। মহামারির আঘাতে বাংলাদেশ দারিদ্র্যবিমোচন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনীতি উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে সক্ষম হয়েছে। এটি বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতির অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে উত্সাহিত করবে।
চীন ও বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে সুপ্রতিবেশি দেশ। দু’দেশের সামাজিক অবস্থারও অনেক মিল রয়েছে। দু’দেশই বড় জনগোষ্ঠীর দেশ। জিডিপি’র দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি এবং বাংলাদেশে ১৬কোটি। দু’দেশই কৃষি নির্ভরশীল। বিশাল গ্রামাঞ্চলে দরিদ্রের সংখ্যা অনেক বেশি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু’দেশের অভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য স্থির হয়েছে। ঠিক সি চিন পিংয়ের কথার মতো। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে স্থানীয় মিডিয়ায় এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘চীন ও বাংলাদেশে উভয়ই বড় জনগোষ্ঠীর দেশ। দু’দেশের রাষ্ট্রীয় অবস্থা ও সামাজিক অবস্থার অনেক মিল রয়েছে। উন্নয়নের অভিন্ন লক্ষ্য আছে। ভৌগোলিক, জনগোষ্ঠী, বাজারের সম্ভাবনা ও সহযোগিতার বিষয় থেকে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ যৌথ নির্মাণের অপরিহার্য্য অংশীদার।
জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমাজের প্রশংসা ও সম্মান কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন সাধন করা। ২০৩১ সালে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বহুবার বলেছিলেন, চীন সৃজনশীলতা, সমন্বয়, সবুজ, উন্নয়ন ও সমন্বিত অর্জনের চেতনায় তার অর্থনীতির গুণগত মানসম্পন্ন উন্নয়ন সাধন করবে। এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে।
একই লক্ষ্য ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারণে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সহযোগিতা জোরদার করেছে। সহযোগিতা মজবুত হয়েছে। চীনের উত্থাপিত ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ দু’দেশের সহযোগিতা ও উপকারিতার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সে উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে পাইরা পাওয়ার স্টেশন, গান্ধি বর্জ্য জল শোধনাগার, ও পদ্মা সেতুসহ নানা প্রকল্প চালু হয়েছে। এসব প্রকল্পের কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে এবং গণজীবিকার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিজ নিজ দেশের উন্নয়নে সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি সে অঞ্চলের যোগাযোগ, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অভিন্ন স্বার্থে ‘বাংলা স্বপ্ন’ ও চীনা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে দু’দেশের সহযোগিতা প্রত্যাশিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। (রুবি/এনাম)