পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন
2021-02-18 14:47:06

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan1

রোদ ঝলমলে দিনে শরীরে ধুলাবালি আর বর্ষায় কর্দমাক্ত শরীর—এমন কথা প্রচলিত ছিল চীনের কুয়াং সি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মানুষের মুখে। এ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বর্ণনা দিতে লোকজন প্রায়শই এমন কথা বলত!

 

কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা আগে খুব দরিদ্র ছিল। কিছু গ্রামে কোনো পথ-ঘাট ছিল না। শিশুরা খাড়া উঁচু পাহাড়ে ঝুলানো সিঁড়ি দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করত। একটি মাটির ঘরই ছিল স্থানীয় একটি স্কুল। একটি কাঠের বিছানায় শুয়ে থাকত সাত আটটি শিশু, একটি খাবারের বাক্সে থাকত কিছু ভাত ও সয়াবিন, কোনো মাংস ও শাকসবজি পাওয়া যেত না।  

চীনে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের কল্যাণে পাহাড়ে সুন্দর সড়ক পথ চালু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা প্রকল্পও পাহাড়ি এলাকায় শুরু হয়েছে। এভাবে পাহাড়ি এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

 

হ্য ছি শহরের ছি পাই নুং পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ কঠোর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কর্মকর্তা আগে একবার ওই স্থান পরিদর্শন করেছিলেন এবং বলেছিলেন- সেই জায়গাটি মরুভূমির পর মানুষের থাকার জন্য সবচেয়ে অনুপযোগী স্থান!

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan3

সেখানের বান শেং গ্রামের পাহাড়ে একটি ‘আকাশের সিঁড়ি’ ছিল। যা স্থানীয় নুং ইয়ু প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র পথ! ‘আকাশের সিঁড়ির’ এক দিকে হল খাড়া উঁচু পাহাড়, অন্য দিকে আরোহণ-অযোগ্য দুর্গম পর্বতমালা।

নুং ইয়ু প্রাথমিক স্কুলের প্রধান লিউ সিং ই বলেন, আগে আমরা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে এই সিঁড়ি তৈরি করতাম। শীতকালে পাহাড়ি এলাকায় বরফ হতো, তাই পা পিছলে পড়ে যাওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

মাথা উঁচু করে রয়েছে সারি সারি পাহাড়; আর নিচে রয়েছে বিশাল হ্রদ। পাহাড়ে উঠতে প্রয়োজন হয় ‘আকাশের সিঁড়ি’, পাহাড়ের নিচে যেতে প্রয়োজন হয় নৌকা।

 

নান নিং শহরের সাং লিন স্কুলে শিক্ষক সি লান সুং ৩০ বছর আগে নিজের বাড়ির সামনের কয়েকটি বড় গাছ কেটেছিলেন। তারপর সেই কাঠ দিয়ে একটি নৌকা তৈরি করেছিলেন; যাতে শিশুদের স্কুলে যাতায়াতে সাহায্য করা যায়। দীর্ঘ ৩০ বছরে একটি নৌকা থেকে ৮টি নৌকা হয়েছে, পাহাড়ি এলাকার শিশু এই নৌকার মাধ্যমে বাইরে যেতে পারে।

 

বাস্তবতা হলো—যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় শিক্ষাগত অবকাঠামো ব্যবস্থাও খুব খারাপ ছিল। নুং থেং প্রাথমিক স্কুল ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় এটি ছিল তিন তলা ভবন; যা গোটা গ্রামের একমাত্র ভবন!

নুং থেং প্রাথমিক স্কুলের প্রধান ওয়েই জিন ক্য বলেন, আগে স্কুলে শিশুদের কাঠের বিছানা ছিল; একটি বিছানায় চার পাঁচটি শিশু দুপুরে বিশ্রাম নিত। নুং থেং প্রাথমিক স্কুলের প্রধান জানান, আগে স্কুলে কোনো রান্নাঘর ছিল না, শিশুরা নিজ বাসা থেকে সয়াবিন, চাল ও জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসত। তারপর খাবার সময় হলে কাছাকাছি কোনো এক কৃষকের বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার রান্না করে খেত।

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan2

কৃষক থাং লিং ইয়ু’র বাসাই তখন নুং থেং প্রাথমিক স্কুলের রান্নাঘর ছিল। তিনি বলেন, সবাই খাবারের পাত্রে চাল ও সয়াবিন রাখত, তারপর তা সিদ্ধ করে খেত। তিনি নিজেও ছোটবেলায় এই স্কুলে পড়তেন, তাই তিনি বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। শিশুদের একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা কত কঠিন ব্যাপার!

এরপর সময় বদলে যায়। ২০০৮ সালে নুং থেং প্রাথমিক স্কুলে রান্নাঘর তৈরি হয়। সহৃদয় কৃষক থাং লিং ইয়ু স্কুলের কাজে অনেক সাহায্য করেন। তিনি নিজে প্রতিদিন শিশুদের জন্য ভালো খাবার রান্না করে দিতেন।

 

সারি সারি উঁচু পাহাড় গ্রামের উন্নয়নে অনেক বাধা দিয়েছে। অনেক পরিবার এ কারণে দরিদ্রতার কবলে পড়েছিল। শিশুরা স্কুলে পড়তে যেতে পারত না। ‘মেয়েদের লেখাপড়া করার দরকার নেই’, ‘লেখাপড়া করলেও কোনো লাভ নেই’— এমন ধারণা সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত এলাকায় বেশ প্রচলিত ছিল।

 

লিউ চৌ শহরের রুং সুই মিয়াও জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলার নারী কমিশনের প্রধান ইয়াও লি ছুই ছোটবেলার কথা স্মরণ করতেই চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। তিনি বলেন, যখন আমি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হতে চাইতাম, তখন মা আমাকে বলতেন, বাসার ছাগল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে। আমি ছাগল কাঁধে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথে হেঁটেছি, থানা পর্যন্ত পৌঁছেছি। কিন্তু সারা রাতেও ছাগলটি বিক্রি করতে পারি নি। যা ছিল আমার জন্য অনেক কষ্টকর।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিক্ষা খাত উন্নয়নের জন্য অনেক অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এর ফলে পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার মান অনেক উন্নত হয়েছে।

হ্য ছি শহরের সান জি ইয়াং গ্রাম দীর্ঘকাল ধরে দরিদ্র ছিল। গ্রামের নামের অর্থ হল ‘তিনটি ছাগল’। রূপকথা অনুযায়ী বলা হয়, ইয়াও জাতির মানুষ এই দরিদ্র স্থানে থাকতেন, প্রতি বছর স্থানীয় কর্মকর্তাকে ৩টি ছাগল দিতে হতো, তাই গ্রামের নাম ‘তিনটি ছাগল’ অর্থাত্ ‘সান জি ইয়াং’ হয়েছে।

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan4

দশ বছর আগে, সেখানের প্রাথমিক স্কুল ‘শিশুরা শুধু সয়াবিন দিয়ে ভাত’ খেতো। এ বিষয়টি সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

৫৮ বছর বয়সী ইউয়ান চিয়ান চু ও তার ছেলে এই স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। সে সময় তারাও সয়াবিন দিয়ে ভাত খেতেন। এখন তাঁর ১২ বছর নাতি ওই একই স্কুলে লেখাপড়া করছে; কিন্তু সে প্রতিদিন স্কুলে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে।

ইউয়ান বলেন, আমরা কয়েক প্রজন্মের স্বপ্নের সুখী জীবন এখন আমার নাতির প্রজন্মের শিশুরা উপভোগ করছে।

 

চীনের গ্রামাঞ্চলে বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর খাদ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা চালুর পর এ পর্যন্ত কুয়াং সি’তে  প্রায় এক কোটিরও বেশি শিশু এই পুষ্টিকর খাবার উপভোগ করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ‘সয়াবিন দিয়ে ভাত’ খাওয়া এখন শুধু মানুষের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। স্থানীয় ছেন ভাং গ্রামের ‘খাবার পৌঁছে দেওয়ার’ ইতিহাসও স্মৃতি হয়ে গেছে।

 

কেন এই গ্রামটি ‘খাবার পৌঁছে দেওয়ার গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত? কারণ, শিশুদের খাবার খেয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করার জন্য ছেন ভাং গ্রামের অভিভাবকরা কয়েকটি গ্রুপে বিন্যস্ত হয়ে ধারাবাহিকভাবে সাত কিলোমিটার দূরে মাধ্যমিক স্কুলের শিশুদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতেন। পাহাড়ি পথ ছিল একেবারে খাড়া, প্রত্যেক ধাপ যথেষ্ট সাবধানে ফেলতে হতো। কারণ, তাদের কাঁধে ছিল শিশুদের পুরো দিনের খাবার। এই খাবার পৌঁছে দেওয়ার ঐতিহ্য ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হয়। শিশুদের জন্য দুপুর বেলা পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া ছিল প্রতিদিনের কাজ!

 

চীনে শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার ফি মওকুফ করা এবং বোর্ডিং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ভাতা দেওয়ার নীতি চালু হওয়ার পর পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের লেখাপড়ার ফি নিয়ে উদ্বেগ দূর হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষার্থীরা কিছু ভাতাও পাওয়া শুরু করে।

 

২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, কুয়াং সি’তে শিক্ষা খাতে এক কোটিরও বেশি ইউয়ান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ সময় নতুন করে ৮৯৩টি স্কুল তৈরি হয়েছে এবং আরো ২৫ হাজার ৩০০ স্কুল মেরামত ও বড় করে নির্মাণ করা হয়েছে।

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan5

নুং ইয়ুং প্রাথমিক স্কুলে আগে পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল না। এখন নতুন স্কুল ভবন, হোস্টেল, ডাইনিং হলসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। পাহাড়ের মধ্যে সুন্দর পথ তৈরি হয়েছে। শিশুদের স্কুলে যেতে আর বিপজ্জনক ও কষ্টকর ‘আকাশের সিঁড়ি’ পার হতে হয় না।

 

লান মেই ইং নামে একটি মেয়ে আছে। সে আগে নুং ইয়ুং স্কুলে পড়ত। এখন তার ছোট বোনও নুং ইয়ুং স্কুলে লেখাপড়া করছে। তবে, ছোট বোনের স্কুল যাবার পথ এখন আর বিপজ্জনক নয়। তার ছোট বোন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। ক্লাসরুমে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

 

এখন নুং ইয়ুং প্রাথমিক স্কুলে আরেকটি চার তলা শিক্ষার ভবন তৈরি হচ্ছে। স্কুলের প্রধান লিউ সিং ই বলেন, তারা আরেকটি খেলার মাঠ তৈরি করবে। যখন আপনি আবারও কুয়াংসি’তে আসবেন, তখন এখানকার সবচেয়ে সুন্দর ভবনটি হবে তাদের স্কুলভবন।

শিক্ষকরা হলেন পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার মান উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। আরো শ্রেষ্ঠ মানের মানবসম্পদকে তৃণমূল পর্যায়ে যেতে উৎসাহিত করার জন্য কুয়াংসি সরকার শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানোর অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে কুয়াংসি’তে ৫৬ হাজার ৬০০ শিক্ষক তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষাদানে যোগ দিয়েছেন।

১৯৯৬ সালে রুং সুই জেলার পাই ইয়ুন গ্রামের ছোট মেয়ে ছেন ইং হুয়া প্রথমবারের মত জন্মস্থান ত্যাগ করে গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে অংশ নিয়েছে। সে আগে কখনই নদী দেখে নি। সে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে, এটা কি সমুদ্র?

আগে পাহাড়ি এলাকার নারীরা সারা জীবনে একবারও সমুদ্র দেখতে যেতে পারত না। সেখানে একটি কথা প্রচলিত ছিল: মেয়েদের লেখাপড়া করার দরকার নেই। বাই ইয়ুন গ্রামে এক সময় মেয়েদের স্কুলচ্যুতির হার অনেক বেশি ছিল। আর এখন, শিক্ষার চেতনা ও শিক্ষাগত সম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে আরো বেশি শিশু পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে; তারা জীবনকে আরো সুন্দর করার সুযোগ পেয়েছে।

পাহাড়ি এলাকার শিশুদের স্বপ্ন_fororder_dashan6

ছেন ইং হুয়া লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। তিনি গ্রামে দারিদ্র্যমুক্তকরণ খাতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কয়েক বছর আগে তিনি গ্রামের জন্য একটি পথ তৈরি করেছেন। তিনি নিজের শিশুকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে গিয়েছেন- তাঁর প্রিয় সমুদ্র দেখার জন্য।

 

সেই সঙ্গে শিশুদের মানসিক পরিবর্তনও বিরাট ব্যাপার। পাহাড়ি এলাকার আরো বেশি শিশু ক্রীড়া ও আর্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের সুন্দর আশা-আকাঙ্ক্ষাও দেখা যাচ্ছে। সংখ্যালঘু জাতি এলাকায় ‘শিশুদের লেখাপড়া করলে জীবন সুন্দর হবে’ এমন চিন্তাধারা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে।

 

সান চিয়াং নামে এক কমিউনিটিতে সাংবাদিক গিয়ে দেখেন, সেখানকার প্রাথমিক স্কুলে বিভিন্ন ধরনের ক্লাস চলছে; ফুটবল, ছবি আঁকা, নাচের ক্লাস সব কিছুই আছে। এসব শিক্ষা কার্যক্রম পাহাড়ি এলাকার শিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পেরেছে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)