চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ঢাকা স্টেশন থেকে প্রচারিত আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। কেমন আছেন আপনারা? আশাকরি সবাই সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। চীনের সবচেয়ে বড় সামাজিক উত্সব বসন্ত উত্সবের নানা রকম অনুষ্ঠান চলছে। তাই অনুষ্ঠানের শুরুতেই আপনাদের চীনা নববর্ষ বা বসন্ত উত্সবের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বিশেষ প্রতিবেদন: তোফু সুন্দরীর গল্প
ঐতিহ্যবাহী চীনা বসন্ত উত্সবের আয়োজন করে নিজের ও পুরো গ্রামের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন একজন নারী। স্থানীয়ভাবে তাকে ডাকা হয় তোফু সুন্দরী নামে।
চীনের হুনান প্রদেশের একটি দুর্গম গ্রাম ফিনলাং। মিয়াও জাতি অধ্যূষিত এই গ্রামের একজন নারী শি ছিংসিয়াং। তিনি তোফু তৈরি করে পরিচিতি পেয়েছেন, ঘুরিয়ে দিয়েছেন পুরো গ্রামের অর্থনীতির চাকা। এই গ্রামের একটি ব্র্যান্ড পণ্য হলো ফিনলাং তৌফু।
চীনের জনপ্রিয় খাদ্য তোফু বসন্ত উৎসবেরও অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। শি ছিংসিয়াংয়ের পরিবার বংশগতভাবে তোফু তৈরি করতেন। বলা যায় শি ছিংসিয়াং বড় হয়েছেন বিনস পেষা জাঁতার শব্দ আর বিনসের ঘ্রাণের মধ্যে। বাড়ির ক্ষেতে জন্মানো বিনস, ঝর্ণার জল এবং পুরনো পাথরের জাঁতায় বিনস দানা পিষে তারা তৈরি করতেন তোফু। পরিবারটি ছিল খুব দরিদ্র। একমুঠো খাবার জন্য তাদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হতো। দুর্গম এলাকা বলে, গ্রাম থেকে শহরে পণ্য পরিবহণ করা সম্ভব ছিল না।
শি ছিংসিয়াং বলেন, ‘আমাদের অবস্থা ছিল দিন আনি দিন খাই। রাত দুটোর সময় উঠে যাঁতায় বিনস পিষতে হতো, পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে বাঁকে করে দু বালতি পানি আনতে হতো। পথটা ছিল এত দুর্গম যে দিনে মাত্র একবারই যাওয়া যেত’।
নিজেদের আর্থিক দুর্দশা ঘোচাবার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন শি। বাবার কাছ থেকে তিনি তোফু তৈরির প্রক্রিয়া শিখে নেন। চিন্তা করতে থাকেন কিভাবে সেটি বিক্রি করা যায়। একবার ছাংশা শহর থেকে একজন অফিসার এখানে আসেন এবং তার তৈরি তোফু দেখে পরামর্শ সেটি কৃষিমেলায় নিয়ে যেতে। ২০১২ সালে তিনি মেলায় নিজের তৈরি তোফু নিয়ে যান। এক সপ্তাহ ধরে তৈরি করা তোফু এক বেলাতেই বিক্রি হয়ে যায়। তিনি নিজের গ্রামের ব্র্যান্ড তৈরির চিন্তা করেন। গ্রামের নেতা তাকে বলেন তোফু শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে। সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় দারুণভাবে। গ্রামের বিশটি পরিবার নিয়ে শির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তোফু সমবায়। ব্যাংক থেকে তারা প্রত্যেকে ৫০ হাজার ইউয়ান করে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করেন। সমবায় থেকে তারা স্থির করেন নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামে একটি তোফু ভোজ ও মেলার আয়োজন করবেন। ২০১৫ সালে এই মেলা হয়। ব্যাপক সাড়া জাগায় মেলাটি। ফিনলাং তোফুর জনপ্রিয়তা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। গ্রামবাসীর অবস্থা পরিবর্তন হতে থাকে।
শি বলেন, ‘গ্রামটি আগে ছিল মনমরা। এখন উত্সাহে জেগে ওঠে পুরো গ্রাম। আমরা নতুন আশার আলো দেখি’।
তোফু শহরে পাঠানোর সুবিধার জন্য গ্রামবাসীরা সরকারি সাহায্য নিয়ে পাহাড় ও নদীর পাশ দিয়ে তৈরি করে নতুন সড়ক।
সরকারের দারিদ্য বিমোচন কর্মসূচির সহায়তায় এবং নিজেদের পরিশ্রমে ও উৎসাহে ফিনলাং গ্রাম এখন আর দরিদ্র নয়। এখন আর পাহাড়ি পথ ভেঙে জল আনতে হয় না। ঘরে ঘরে পৌছে গেছে সবরকম সুবিধা। আর্থিক অবস্থা, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। এইভাবে তোফু সুন্দরী শি ছিং সিয়াং গড়ে তুলেছেন দারিদ্র্যমুক্ত নতুন জীবন এবং তৈরি হয়েছে ফিনলাং তোফু ব্র্যান্ড।
সাক্ষাত্কার: বাংলা একাডেমির পরিচালক ও আবৃত্তিশিল্পী রহিমা আখতার কল্পনা
সিআরই বাংলার সঙ্গে বিশেষভাবে কথা বলেছেন কবি এবং বাংলা একাডেমির পরিচালক ও আবৃত্তিশিল্পী রহিমা আখতার কল্পনা।
তিনি শুনিয়েছেন তার জীবনের অভিজ্ঞতা। তার জন্ম কিশোরগঞ্জে। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্রী। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চায় পরিবার। কারণ তাকে প্রতিবেশী একটি ছেলে একটি সাধারণ চিঠি লিখেছিল। তার বিয়েও ঠিক হয়ে যায়। তবে তিনি সেইসব বাধা অতিক্রম করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি শুরু করেন। রহিমা আখতার কল্পনার ২৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হাইকু কবিতা লেখেন। তিনি কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায়ও কবিতা লিখেছেন। তিনি ময়মনসিংহগীতিকা থেকে পুথিপাঠ করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ভাষা থেকে সাহিত্যের অনুবাদ কর্ম খুবই জরুরি একটি বিষয়। এতে অন্য ভাষায় কী কাজ হচ্ছে সে বিষয়ে জানা যায়।’
চীনের বিখ্যাত নারী: মেডিকেল সায়েন্টিস্ট চেন ওয়েই
চেন ওয়েই ২০২০ সালে চীনের জাতীয় সম্মাননা পিপলস হিরো খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
চেন ওয়েই হলেন চীনের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক এবং চায়নিজ একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন একাডেমিশিয়ান। ১৯৬৬ সালে চীনের চেচিয়াং প্রদেশের লানসি শহরে তার জন্ম। কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর এবং সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর একাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেস থেকে ১৯৯৮ সালে ডক্টোরেট করেন। তিনি এই একাডেমিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রতিনিধি হন।
২০১৫ সালের ১০ জুলাই তাকে মেজর জেনারেল বা শাওচিয়াং র্যাংক প্রদান করে সম্মানিত করেন কেন্দ্রী মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিং।
১২তম ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি ছিলেন, ২০১৮ সালে চায়নিজ পিপলস পলিটিকাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের ১৩তম ন্যাশনাল কমিটির সদস্য হন। ২০১৯ সালে চায়নিজ একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একাডেমিশিয়ান নির্বাচিত হন।
২০২০ সালে করোনা প্যানডেমিকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি ও একাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেসের যৌথ টিমের নেতৃত্ব দেন চেন। এই গবেষণায় তার সাহসী ও সাফল্যজনক ভূমিকার জন্য ২০২০ সালে জাতীয় সম্মাননা পিপলস ন্যাশনাল হিরো খেতাব লাভ করেন। চেন ওয়েই শুধু চীনের জাতীয় বীরই নন, তিনি প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধেরও একজন বীর যোদ্ধা নারী।
ইতিহাসের পাতায় অসামান্য বাঙালি নারী: শামসুন্নাহার মাহমুদ
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ। যার নাম শুনলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের কথা চলে আসে। তিনি ছিলেন এ দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবী ৷ এই গুণী নারী ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন ফেনী মহকুমার গুতুমা গ্রামে, মুন্সীবাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সাথে বিয়ে হয় শামসুন নাহারের। নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলনসহ মৌলিক কিছু কাজের জন্যে এদেশের নারী সমাজের কাছে খুবই আপন ও প্রিয়জন। শামসুন নাহার যখন জন্মেছিলেন তখন মেয়েদের লেখাপড়া শেখা বা স্কুলে যাওয়া নিষেধ ছিল। রক্ষণশীল সমাজের শাসনে মেয়েদের এক রকম বন্দী জীবন যাপন করতে হতো। এমনই এক অবস্থায় শামসুন নাহার রক্ষণশীল সমাজের সকল ভ্রুকুটি ও শাসন উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে শামসুন নাহারের পরিচয় হয় লেখালেখির মাধ্যমে। অল্প বয়সে শামসুন নাহারের প্রথম লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয় কিশোরদের জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘আঙুর’ পত্রিকায়। এরপর ‘নওরাজ’ এবং ‘সওগাত’সহ অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়। বেগম রোকেয়া বহু আগেই ‘নিখিল বঙ্গ’ মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শামসুন নাহার এই সমিতির সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে মরণোত্তর ‘বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় শামসুন নাহার হল।
প্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। অনুষ্ঠানটি কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আমাদের অনুষ্ঠান আপনারা সবসময় শুনতে পাবেন, ঢাকায় এফ এম ১০২ এবং চট্টগ্রামে এফ এম ৯০ মেগাহার্টজে এবং অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজে। জেনে নিন আমাদের ইমেইল অ্যাডরেস, cmg.bangla@gmail.com আমাদের ফেসবুক পেজ facebook.com/CRIbangla এবং facebook.com/CMGbangla এবংআমাদের সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে দেখতে পাবেন। youtube.com/CMGbangla.
আজ এ পর্যন্তই। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। আবার কথা হবে। বিদায় নিচ্ছি চীনা বসন্ত উৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়ে। সিন চুন খুয়াইলা
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
শামসুন্নাহার মাহমুদ বিষয়ে লিখেছেন রওজায়ে জাবিদা ঐশী
ছবি ও অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ