চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ঢাকা স্টেশন থেকে প্রচারিত আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। কেমন আছেন আপনারা? আশাকরি সবাই সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আপনাদের চীনা নববর্ষ বা বসন্ত উত্সবের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি সেইসব নারীর সঙ্গে যারা তাদের জীবনে সাফল্য অর্জন করেছেন, অথবা সাফল্য পেতে চান।
বিশেষ প্রতিবেদন: মিয়াও নারীর নকশী গল্প
চীনের ৫৬টি জাতির অন্যতম হলো মিয়াও জাতি। তাদের রয়েছে নকশীকাজের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। মিয়াও জাতির নারীরা নকশী কাজের ঐতিহ্য বহন করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তাদের নিজেদের লিখিত ভাষা না থাকায় নকশী কাজের ভিতরেই তারা গল্প বলে থাকে। তাদের পোশাক তৈরি হয় নকশী কাপড় দিয়ে যা তারা নিজেরাই বুনন করে। এমনি একজন নারীর কথা শুনবো ‘মিয়াও নারীর নকশী গল্প’ নামে বিশেষ প্রতিবেদনে।
সবসময় তাকে দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী এথনিক অলংকার ও পোশাকে সজ্জিত হয়ে ইলেকট্রিক বাইকে চড়ে সব জায়গায় যাচ্ছেন। তার নাম চেন সিয়ুলান। তিনি চীনের হাইনান প্রদেশের চিয়ানাও গ্রামের একজন নারী। তিনি মিয়াও জাতির মেয়ে। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন নিজের হাতে তৈরি নকশী কাপড়ের ঐতিহ্যবাহী সব সামগ্রী।
মিয়াও জাতির রয়েছে এমব্রয়ডারির ঐতিহ্য। তারা নকশী কাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে তাদের জাতির ইতিহাস ও মিথোলজি। চেন সিয়ুলান সেই ঐতিহ্যবাহী নকশাকেই করে নিয়েছেন নিজের জীবিকার অবলম্বন। এ কাজ তাকে দিয়েছে খ্যাতি ও অর্থ। ছোটবেলা থেকেই তিনি নকশী কাজ শিখেছেন।
চেন বলেন, ‘আমার যখন ১২ বছর বয়স, আমি মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট এক টুকরো নকশী কাপড় চুরি করি। স্কুলের পর আমি নকশী কাজ শেখা শুরু করি। ১৬ বছর বয়সে আমি মিয়াও নকশায় নিজের প্রথম স্কার্ফটি তৈরি করি। সেটি এখনও আমার কাছে রয়েছে ।’
মিয়াও জাতির নারীরা নকশী কাজের ঐতিহ্য বহন করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তাদের নিজেদের লিখিত ভাষা না থাকায় নকশী কাজের ভিতরেই তারা গল্প বলে থাকে। তাদের অলংকারও জাতির ঐতিহ্যকে বহন করে। তাদের পোশাক তৈরি হয় নকশী কাপড় দিয়ে যা তারা নিজেরাই বুনন করে।
‘প্রতিটি মিয়াও নারী নকশী কাজ জানে। প্রতিটি পরিবার ঐতিহ্যবাহী পোশাক সংরক্ষণ করে। তারা বিশেষ অনুষ্ঠানে এবং ছেলেমেয়েদের বিয়ের সময় এই ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।’
চেন সিয়ুলানের বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। সংসার ও কৃষিকাজের অবসরে তিনি সময় করে নিতেন তার শখের নকশী কাজের জন্য। এরপর তিনি এই শখকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার চিন্তা করেন। নকশীকাজে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী আশপাশে মানুষের কাছে বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। ২৮ বছর বয়সে তিনি এই কাজ শুরু করেছেন। গত বিশ বছর ধরে তিনি নিজের বাইকে চড়ে এসব সামগ্রী বিক্রি করছেন। এখন তিনি নিজের সমাজে একজন সুপরিচিত ও সম্মানিত মানুষ। তিনি পরিবারেও নিয়ে এসেছেন স্বচ্ছলতা। তিনি এখন তরুণ প্রজন্মকে মিয়াও এমব্রয়ডারি শিখাচ্ছেন।
‘আমার বয়স হচ্ছে। মিয়াও এমব্রয়ডারি আমি তরুণ প্রজন্মকে যদি না শিখাই তাহলে সেটি হারিয়ে যাবে’। স্থানীয়ভাবে চেনকে তাই ডাকা হয় শিক্ষক নামে।
মিয়াও জাতির নারী চেন সিয়ুলান
চেন সিয়ুলান
সাক্ষাৎকার: জোবেরা রহমান লীনু
এখন আমরা কথা বলবো আমাদের অতিথির সঙ্গে। আমাদের আজকের অতিথি জোবেরা রহমান লীনু। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক কিংবদন্তি। জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়া প্রথম বাংলাদেশীর গৌরব অর্জন করেছেন।
জোবেরা রহমান লীনু বলেন, তিনি ছোটবেলাতেই খেলাধূলার প্রতি আকৃষ্ট হন। তার বাবা এবং বড়বোন ছিলেন টেবিল টেনিসের কৃতী খেলোয়াড়। তাই লীনুর খেলার পিছনে তার পরিবারের উৎসাহ ছিল প্রবল। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তার নাম যখন গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ওঠে তখন তার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের নারীদের প্রেরণা জোগানোর জন্য তিনি সামান্য হলেও কিছু অবদান রাখতে পেরেছেন। একবার তিনি খেলতে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত কাটিয়ে আবার ক্রীড়াভুবনে ফিরে আসার ফিটনেস অর্জনে তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। সেটা ছিল তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের সহসভাপতি হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের নারীদের ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে পারিবারিক উৎসাহ খুব বেশি প্রয়োজন। কারণ সামাজিক অনেক বাধা নারীকে পার হতে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীদের ক্রীড়াক্ষেত্র এগিয়ে আসার জন্য আর্থিক নিশ্চয়তা থাকা দরকার’। তিনি চান আরও অনেক নারী ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক এবং সাফল্য লাভ করুক।
জোবেরা রহমান একজন লেখকও। তিনি নাটক, কবিতা ও চিত্রনাট্য লেখেন। এ পর্যন্ত তার পাঁচটি নাটক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তবে তিনি খুব বেশি ব্যস্ততা ভালোবাসেন না। তিনি নিজেকে সময় দিতে পছন্দ করেন। তিনি জীবনকে উপভোগ করেন।
চীনা নারী: বিখ্যাত নারী বিজ্ঞানী হাও ইছুন
হাও ইছুন একজন বিখ্যাত চীনা বিজ্ঞানী। তিনি চীনের প্রথমসারির প্যালেওনটোলজিস্ট বা জীবাশ্ম বিজ্ঞানী। তিনি প্যালেওনটোলজি এবং মাইক্রোপ্যালেওনটোলজি বিষয়ে প্রথম চীনা পাঠ্যবইয়ের অন্যতম লেখক। তিনি ভূতত্বের একটি বিশেষ শাখা স্ট্র্যাটিগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন এবং পেট্রোলিয়াম বিষয়ক আবিষ্কার ও প্যালেওশেনোগ্রাফিতেও বিশেষ অবদান রাখেন।
চীনের হুবেই প্রদেশে উছাং জেলায় ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ন্যাশনাল সাউথ ওয়েস্টার্ন অ্যাসোসিয়েটেড ইউনিভারসিটিতে ইতিহাসে পাঠ গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভূতত্ব, জলবায়ু, এবং ভুগোল বিভাগে লেখাপড়া করেন এবং ১৯৪৩ সালে স্নাতক হন। তিনি স্নাতকোত্তর করেন সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর তিনি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি বেইজিং জিওলজিকাল ইন্সটিটিউটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হন। তিনি চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সের একাডেমিশিয়ান ছিলেন।
তিনি উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণপশ্চিম চীনে স্ট্র্যাটিগ্রাফিতে গবেষণা করেন এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেন। তার গবেষণা কাজের ফলে সমুদ্র শক্তি সম্পদ বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার হয়।
তিনি চায়নার কমিউনিস্ট পার্টির একজন অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি নারী অধিকার আন্দোলনেরও একজন সোচ্চার কর্মী ছিলেন। তিনি জাতীয় পর্যায়ে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০১ সালে বেইজিংয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।হাও ইছুন বিশ্বের নারী বিজ্ঞানী হিসেবে বিখ্যাত এবং নারীদের জন্য প্রেরণাস্বরূপ। ২০২০ সালে চায়না ইউনিভারসিটি অব জিয়োসায়েন্সেস তার জন্মশত বর্ষে স্মৃতি কনফারেন্সের আয়োজন করে।
অসামান্য বাঙালি নারী : লীলা নাগ
লীলা নাগ
ইতিহাসের পাতায় খচিত এক মহীয়সী নারী লীলাবতী নাগ। যিনি লীলা নাগ নামেই পরিচিত। আসামের গোয়ালপাড়া শহরে ১৯০০ সালের দোসরা অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা লীলা নাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রবর্তী সৈনিক ছিলেন। তার হাত ধরেই সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার । নারীশিক্ষা এবং নারীদের রাজনীতিসচেতন করে তুলতে তাঁর অবদান স্মরণীয়। তবে তিনি শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নন। ছিলেন সাংবাদিক ও দক্ষ সংগঠক।
১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রীধারী প্রথম নারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাঙ্খা বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ড. হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন। বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ঢাকার আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশ করেন জয়শ্রী নামক নারীদের পত্রিকা। এতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রসার ঘটে। তাঁর সাধনা ছিল নতুন সমাজ, নতুন জীবন, নতুন মানুষ গড়ে তোলার। রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, ব্রিটিশদের শাসনমুক্ত হওয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, তখন ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি কমিটি। ১৯৩৯ সালে বিপ্লবী অনিল রায়কে বিয়ে করেন লীলা। ১৯৭০ সালে এই মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। লীলা নাগ বাংলার নারী অধিকার আন্দোলনের এক স্মরণীয় নাম।
প্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা। অনুষ্ঠানটি কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আমাদের অনুষ্ঠান আপনারা সবসময় শুনতে পাবেন, ঢাকায় এফ এম ১০২ এবং চট্টগ্রামে এফ এম ৯০ মেগাহার্টজে এবং অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজে। জেনে নিন আমাদের ইমেইল অ্যাডরেস, cmg.bangla@gmail.com আমাদের ফেসবুক পেজ facebook.com/CRIbangla এবং facebook.com/CMGbangla এবংআমাদের সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে দেখতে পাবেন। youtube.com/CMGbangla. আজ এ পর্যন্তই। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। আবার কথা হবে। বিদায় নেয়ার আগে সবাইকে জানাচ্ছি বসন্ত উৎসবের শুভ কামনা। সিনচুন খোয়াইলা।
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
সহযোগিতা: রওজায়ে জাবিদা ঐশী
ছবি: হোসনে মোবারক সৌরভ
অনুষ্ঠানের অডিও সম্পাদনা: তানজিদ বসুনিয়া