চীনের বসন্ত উত্সব খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পরিবারের পুনর্মিলনের এই উত্সবে কয়েকটি টপিক প্রতি বছরই সামনে আসে। সারা বছর অন্য জায়গায় কাজ করা তরুণ-তরুণরীরা বসন্ত উত্সবের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পর আশেপাশের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুরা অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞাস করেন: চাকরি কেমন? বেতন কেমন? বিয়ে হয়েছে কি না? সন্তান আছে কি না? দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রস্তুতি কেমন চলছে? এসব প্রশ্নের কারণে অনেক তরুণ-তরুণীর মনে বসন্ত উত্সব এখন একটি আতঙ্কের নাম।
বসন্ত উত্সব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুনর্মিলনের সুযোগ দেয়। আবার একশ্রেণির তরুণ-তরুণীর জন্য বিরূপ পরিস্থিতিও সৃষ্টি করে। এসব প্রশ্নের মধ্যে বিবাহসংক্রান্ত প্রশ্ন সবচেয়ে বিব্রতকর। কারণ, প্রত্যেক চীনা তরুণ-তরুণীর বিবাহ মানে প্রবীণদের কাছে বংশের ধারা বজায় রাখা এবং মানবজাতির টিকে থাকা। তাই নিজের ইচ্ছামতো অবিবাহিত জীবন কাটানো উচিত নয় বলে প্রবীণরা মনে করেন।
আজকের ‘আলোছায়া’ আসরে আমরা বিবাহসম্পর্কিত রিয়ালিটি শো’র সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। এই রিয়ালিটি শো’র নাম হচ্ছে ‘ফারএওয়ে ব্রাইডস্’।
হংকংয়ের টেলিভিশন ব্রডকাস্টস লিমিডেট (টিভিবি)-র উদ্যোগে নির্মিত এ সিরিজ অনুষ্ঠান এখন পর্যন্ত মোট তিন সিজন পার করেছে।
প্রতি সিজনে বিদেশে বিয়ে করা হংকংয়ের নারীদের ওপর ফোকাস করা হয়। কোনো অভিনব শুটিংয়ের উপায় নেই শো-তে। গোটা অনুষ্ঠানে রয়েছে কথোপকথনের স্বতন্ত্র রূপ। প্রতি পর্বের দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ মিনিট।
সিও ইউন ফ্রান্সে বিয়ে করা একজন প্যাস্ট্রি শেফ। তার স্বামী রেগিস একজন শিল্পী। তাদের দু’জনের মিলিত হওয়ার গল্প যেন রোম্যান্টিক মুভির মতো। একদিন যখন সিও ইউন রাস্তার পাশের একটি বারে বিয়ার পান করছিলেন, তখন চাকরি করতে হংকংয়ে আসা রেগিস তাকে দেখে ছবি তুলেছিলেন। সিও ইউন অবশ্যই অবাক হয়ে যান এবং রাগের সাথে তাকে জিজ্ঞাস করেন: তুমি কেন আমার ছবি তুলেছো?
এভাবে তাদের দু’জনের গল্প শুরু হয়।
দিনের পর দিন তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়। তবে রেগিসের সঙ্গে ফ্রান্সে যাবে কি না, তা ছিল সিও ইউনের জন্য অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। হংকংয়ে তিনি একজন প্যাস্ট্রি শেফ এবং এই চাকরি পাওয়া ফ্রান্সে সহজ নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি বাবা-মা’র আশা পূরণ করতে একটি কোম্পানিতে যোগ দেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তিনি অফিসে কাজ করতেন। তবে এমন জীবন তিনি একদম পছন্দ করতেন না। তারপর ৩০ বছর বয়সে তিনি সবকিছু ছেড়ে মিষ্টি শিল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রান্নার ঘরে তিনি শূন্য থেকে শিখতে শুরু করেন। ক্লান্ত হলেও তিনি আনন্দ বোধ করেন এবং মন থেকে এই নতুন কাজ পছন্দ করেন। কয়েক বছর পর তিনি সাফল্যের সঙ্গে প্যাস্ট্রি শেফে পরিণত হন। ফ্রান্সে বিয়ে করলে প্যাস্ট্রি শেফ হিসেবে তার এই পেশা শেষ হওয়ার আশঙ্কা আছে। ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও, হংকং স্টাইল থেকে ফরাসি স্টাইলে বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। সেই চিন্তাও ছিল। নিজের বয়স বিবেচনা করলে ভবিষ্যত নিয়ে সিও ইউন সত্যিই উদ্বিগ্ন। সেই সময় রেগিস তাকে সর্বোচ্চ উত্সাহ দেন। প্রিয়জনের সমর্থন এবং নিজের অধ্যবসায়ের কারণে বর্তমানে সিও ইউন ফ্রান্সের একটি বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে উপ-পাচকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ধরনের বিয়ের পর, নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করা কঠিন কাজ। তবে অন্য পক্ষের সমর্থন ও সাহায্য এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
যা হোক, তাদের জীবনে ঝগড়াও মাঝেমাঝে ঘটে। প্রতিবার ঝগড়ার পর রেগিস সিও ইউনের কাছে প্রশ্ন করেন: আমরা কি একটি টিমে আছি?
বিবাহের পর ‘আমাকে’ নিয়ে নয়, বরং ‘আমাদেরকে’ নিয়ে বেশি চিন্তা করা প্রয়োজন। ‘আমাদের’ কথা বিবেচনায় রেখে একই দিকে এগালে অনেক দ্বন্দ্ব সহজেই সমাধান করা যাবে। পারস্পরিক সমঝোতা ও বিবেচনা হলো একটি দম্পতির সফল জীবন কাটানোর গোপন রহস্য।
সিও ইউনের ট্রান্সন্যাশনাল বিবাহ আসলেই অধিকাংশ মানুষের কল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। উন্নত দেশ, ভালো পারিবারিক অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক, নিজের পছন্দসই চাকরি। তবে সকল ট্রান্সন্যাশনাল বিবাহ সুখের হয় না।
সেরেনা নামের একজন হংকং মেয়ের নাইজেরিয়ার সিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তারা একে অপরকে ভালোবাসেন। তারা দু’জন হংকংয়ে বাস করতেন। তাদের একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে আছে। জীবন সুষ্ঠু এবং স্থিতিশীল ছিলো। যেহেতু স্বামী কৃষ্ণাঙ্গ, হংকংয়ে মাঝেমাঝে অন্যদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টি সহ্য করতে হতো তাদের। তাই সেরেনা স্বামীর সঙ্গে হংকং থেকে নাইজেরিয়ায় চলে যান। ক্যামেরার সামনে সেরেনা জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেন। এখনকার জীবন সত্যিই কষ্টকর। অর্থনীতি অনুন্নত এবং অবকাঠামোও পশ্চাত্পদ। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তার অবস্থাও উদ্বেগজনক।
চীনারা সেখানে স্থানীয় নানান অপরাধমূলক আচরণের শীর্ষ শিকার। সেখানে শুটিং করতে অনুষ্ঠানের কর্মীদের ২৪ ঘন্টা দেহরক্ষী নিয়োগ করতে হয়।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে সীমাবন্ধতা আছে, নিরাপত্তার অভাব, হঠাত্ করে পানি ও বিদ্যুত্ বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রতি মুহূর্তে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ভয়। এসব অসুবিধা সহ্য করতে পারেন সেরেনা। তার কাছে সবচেয়ে অসহ্য ব্যাপার হলো স্থানীয় পারিবারিক ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে পিতৃতান্ত্রিক। স্বাধীন একজন মহিলা হিসেবে হংকংয়ে সেরেনা বড় এক কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। নাইজেরিয়ায় যাওয়ার পর তিনি গৃহিনী হিসেবে সংসারের কাজ নিয়ে বস্ত থাকেন। ওখানে নারীদের মর্যাদা নিম্ন পর্যায়ের। সব কঠিন হলেও স্বামীর মুখে ফুটে ওঠা মৃদুহাসি দেখে সেরেনা দিনের পর দিন সব সহ্য করে যান।
নাইজেরিয়ায় যাওয়ার পর সিন আরও আত্মবিশ্বাসী ও মর্যাদার অধিকারী হন এবং কাজেও অনেক অগ্রগতি অর্জন করেন। স্ত্রীর ত্যাগের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। হংকংয়ে থাকার সময়ের তুলনায় নাইজেরিয়ায় তিনি স্ত্রীর মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেন। বড় বা ছোট ব্যাপারে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন।
স্বামীর সঙ্গে নাইজেরিয়ায় যাওয়া সংক্রান্ত সেরেনার এই সিদ্ধান্ত কি সঠিক? একেক মানুষের একেক চিন্তা-ধারা আছে। তবে সেরেনা এবং সিন মনে করেন, এক জোড়া দম্পতি হিসেবে একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা উচিত্।
উক্ত দুটি গল্প স্বপ্ন ও জীবনের বাছাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন আমরা একসঙ্গে তৃতীয় গল্পের ওপর দৃষ্টি দেবো। এ গল্পটি মারাত্মক রিপারের হাত থেকে সুখ ছিনিয়ে নেওয়া এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আ ছিউ একজন ওয়ার্কাহোলিক। তিনি হংকংয়ের একটি টিভি কেন্দ্রে পরিচালকের কাজ করতেন। এক সপ্তাহে টানা ৭ দিন ধরে কাজ করতেন তিনি। প্রেমে জড়িয়ে পড়ার সময় তার একেবারেই ছিলো না। একদিন তিনি নিজে অসুস্থ বোধ করলেন। চিকিত্সক তাকে জানালেন যে, তিনি তীব্র কিডনি ব্যর্থতার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে থাকার সময় তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার টিভি নাটকবিষয়ক এক ইন্টারনেটে বর্তমানের স্বামী ছাং ইউংয়ের দেখা পান। ছাং ইয়ং দক্ষিণ কোরীয়। আ ছিউয়ের অবস্থা জেনে নেওয়ার পর ছাং ইয়ং তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। শুধু তাই নয়, তিনি আ ছিউকে নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় চিকিত্সার জন্য যাওয়ার প্রস্তাবও দেন। আ ছিউ মুগ্ধ হলেও তিনি অন্যদের ঝামেলা হয়ে যেতে চান না। তাই তারা দু’জন আলোচনার পর এমন একটি সিদ্ধান্ত নেন যে, আ ছিউ পরের সার্জারিতে বেঁচে থাকলে তারা বিয়ে করবেন। সৌভাগ্যের বিষয় হলো সার্জারি সফল হয়। আ ছিউ অবশেষে ছাং ইয়ংয়ের বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তবে ছাং ইউংয়ের বাবা-মা আ ছিউ’র স্বাস্থ্যের অবস্থার কারণে তাদের বিবাহের বিরোধিতা করেন। তবে ছাং ইয়ংয়ের জেদে বাবা-মা তাদের দু’জনকে শুভেচ্ছা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের পর আ ছিউ ছাং ইয়ংয়ের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় যান। সার্জারি সফল হলেও আ ছিউ’র শরীরে যে-কোনো সময় মারাত্মক পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কা থেকেই যায়। ছাং ইয়ং প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে স্ত্রীকে দেখভাল করতে থাকেন। জীবনের সামান্য আক্ষেপ বলতে গেলে তা হলো সন্তানের সমস্যা। শরীরের কারণে আ ছিউর দু’বার গর্ভপাত হয়। ভবিষ্যতে তাদের সন্তান পাওয়ার সুযোগ কম। তবে, ছাং ইয়ং কখনই স্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি, তিনি স্ত্রীর ওপর কোনো চাপ দিতে চান না। তার জন্য পাশে আ ছিউ থাকলে যথেষ্ট মনে করেন।
তিনি স্ত্রীকে বলেন, শত বছর বয়সেও আমরা একসাথে জীবন কাটাবো।
‘Faraway Brides’ নামের এ অনুষ্ঠানে আরো আছে মুগ্ধকর ও বিব্রতকর প্রেমের গল্প। সকল ট্রান্সন্যাশনাল বিবাহের পরিণতি সুন্দর হয় না। তবে নিজের দেশ ছেড়ে অপরিচিত দেশে বাস করার যন্ত্রণা তারা ভুগছেন প্রতিদিন। শুধু তাই নয়, তাদের সামনে নানা চ্যালেঞ্জও আছে। ক্যারিয়ার, সন্তান লালন-পালন, বিশাল সাংস্কৃতিক পার্থক্য তথা জাতিগত বৈষম্যের সম্মুখীন হতে বাধ্য হন তারা।
ভবিষ্যতে আর কতো প্রতিবন্ধকতা, স্বামীর সঙ্গে আর কতো ঝগড়া—ইত্যাদিক যা-ই হোক, ক্যামেরার সামনে কাঁদার পর তারা হাসি ও আশা নিয়ে ভবিষ্যতকে স্বাগত জানান।
এসব দম্পতির ভবিষ্যত কী? তাদের কি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটবে? নাকি তারা আমৃত্যু সুখ-শান্তিতে জীবন কাটাবেন? কে বলতে পারে!
আজীবন প্রতিশ্রুতি’র নিশ্চয়তা আসলেই নিজের হাতে। জীবনে সবসময়ই সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। বিবাহ জীবনের একমাত্র বাছাই নয়। ট্রান্সন্যাশনাল বিবাহ সুখী জীবনের নিশ্চয়তাও নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের মনের গহীনে ভালোবাসার শক্তি হারিয়ে যেন না-যায়। (লিলি/আলিম/শুয়ে)