চীনের দরিদ্র গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে
2021-02-01 16:41:38

বন্ধুরা, আপনারা যদি নিয়মিতভাবে আমাদের অনুষ্ঠান শুনে থাকেন, তাহলে অবশ্যই জানেন যে, গত কয়েক বছরে চীনের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। আর এ উন্নতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে স্থানীয় শিক্ষকদের অবস্থার। অতীতে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর অবকাঠামো ছিল দুর্বল, শিক্ষকদের বেতনও ছিল অনেক কম। ফলে অনেক এলাকার শিক্ষকরা দরিদ্রতার কারণে অন্যান্য শহর বা জেলায় চলে যেতেন। এতে স্থানীয় শিশুদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তো। বিষয়টির ওপর দীর্ঘকাল ধরেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তিনি বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের পর, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের, তাদের জীবনে আসা পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরব।

২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চীনের হুনান প্রদেশের ছেনচৌ শহরের রুছেং জেলার ইয়াও জাতিঅধ্যুষিত এলাকার একটি প্রাথমিক স্কুল পরিদর্শন করতে যান চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। স্কুলের রান্নাঘর, স্টোররুমসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখান এবং শিক্ষার্থীদের খাবারের মান চেক করেন তিনি। চতুর্থ শ্রেণীর একটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে লেকচার শোনেন তিনি। এসময় প্রেসিডেন্ট সি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তোমরা যেন ছোট গাছ, একদিন বড় গাছ হয়ে যাবে। চীনা জাতির মহান পুনরুত্থানের স্বপ্ন তোমাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। তাই ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করো এবং দক্ষ হয়ে দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে চেষ্টা করবে।”

চীনের দরিদ্র গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে_fororder_hn

হুনান প্রদেশের রাজধানী ছাংশা শহরের ছাংনিং জেলার ইয়াও জাতির এক প্রাথমিক স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পান চিউ রেন গত ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজ করছেন। তিনি কখনো ভাবেননি যে, একদিনে দেশের প্রেসিডেন্টের সামনে তাঁকে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে হবে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সভাপতিত্বে তৃণমূলের প্রতিনিধিদের সাথে এক সেমিনার আয়োজিত হয়। প্রেসিডেন্ট সি বললেন, “রুছেং জেলার ইয়াও জাতির প্রাথমিক স্কুল দেখেছি। সেখানে শিক্ষাভবন, হোস্টেল ও ক্যান্টিন, ইত্যাদি সবই নির্মিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের লাঞ্চও বিনা খরচে দেওয়া হয়। বাচ্চারা হাঁসিমুখে পড়াশোনা করছে। আমাদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার চাহিদা প্রায় পুরোটাই মিটেছে এতে। তবে শিক্ষাসম্পদের ভারসাম্যহীনতা এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। তাই চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে এ সমস্যার সমাধানে গুরুত্ব দিতে হবে।”

স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথাবার্তার সময় সবার মুখে সুখের হাসি দেখেন সি চিন পিং। স্কুলের অবকাঠামো উন্নত হয়েছে, বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাসও দিন দিন বাড়ছে। স্কুলের শিক্ষক চু সিয়াং রুং প্রতিদিন ৭টার দিকে বাসা থেকে স্কুলে যান। গত কয়েক দশক ধরে তিনি প্রায় প্রতিদিনই একই সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে যান। স্কুলের কাজ তাঁর জীবনের এক অংশে পরিণত হয়েছে। বাসা থেকে স্কুল মাত্র কয়েক শ মিটার। অতীতে মাত্র কয়েকটি ক্লাসরুম ছিল। এখন উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে।

স্কুলের শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শিক্ষক চু বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে তিনি গ্রামের স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। অতীতে বেতন অনেক কম ছিল। তাই স্ত্রী কৃষিক্ষেতে শাকসবজি চাষ করে বাড়তি আয় করতেন। তখন স্কুলের শিক্ষকও খুই কম ছিল। তাই প্রতিদিন অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাতে হতো শিক্ষক চু-কে। ২০১৪ সাল থেকে তাঁর মাসিক বেতন ২০০০ ইউয়ান বেড়ছে। এখন তার মাসিক বেতন ৫০০০ ইউয়ানেরও বেশি। পাশাপাশি আরও কিছু ভর্তুকিও রয়েছে। শিক্ষক চু বলেন, “শিক্ষকদের বেতন দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছরে বার্ষিক আয় অনেক বেড়েছে আমাদের।”

তা ছাড়া, আরেকটি সুখবর আসছে। গ্রামাঞ্চলের সিনিয়র শিক্ষকদের জন্য কিছু সুবিধাজনক নীতি চালু হয়েছে। যেসব পুরুষ শিক্ষক ৩০ বছর বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে এবং যেসব নারী শিক্ষক ২৫ বছর বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন, তারা সিনিয়র শিক্ষক হবার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ সম্পর্কে শিক্ষক চু বলেন, “প্রেসিডেন্ট সি’র আমাদের স্কুল পরিদর্শনের দৃশ্যটা যেন গতকালের। তিনি তৃণমূলের শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি তাদের বেতন বৃদ্ধি এবং সামাজিক বীমা, চিকিত্সাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর কথা শুনে আমরা অনেক মুগ্ধ হই।”

আসলে চীনের ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা চলাকালে অর্থাত্ ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীনের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য ভর্তুকি অনেক বেড়েছে এবং উপকৃত শিক্ষকদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ২০১৯ সালে চীনের ১০১২টি চরম দরিদ্র এলাকায় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

স্কুলের আরেকজন শিক্ষক ম্যাডাম চু শি ফেন প্রেসিডেন্ট সি’র পরিদর্শন সম্পর্কে বলেন, “আমাদের স্কুল খুব বড় নয়। শিক্ষকদের সংখ্যাও বেশি নয়। প্রেসিডেন্ট সি আমাদের স্কুলে আসার ব্যাপারটি ছিল অনেক আনন্দদায়ক ব্যাপার। তাঁর উত্সাহে আমরা আরও মনোযোগ দিয়ে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করব। এখন স্কুলে শিক্ষা-সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও অনেক বেড়েছে।”

গত বছরের ৯ ডিসেম্বর হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের তুংজুন প্রাথমিক স্কুলের ১০ জনেরও বেশি শিক্ষক ও ১০০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী রুছেং জেলায় আসেন। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে বিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় তখন। ম্যাডাম চু শি ফেন বিনিময় অনুষ্ঠানের পর ছাংশাতে প্রশিক্ষণ-কোর্সে অংশ নেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত এ প্রশিক্ষণ প্রকল্পে অংশ নিতে অনেকেই আগ্রহী। কারণ, গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের শিক্ষাদানের উপযোগী পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চায় তারা। তিনিও তাই চান। এআই প্রযুক্তির যুগে শিক্ষাদানের পদ্ধতিও পরিবর্তন হবে, তাই শিক্ষকদের নতুন দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। আসলে, গত কয়েক বছরে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রকল্প চালু হয়েছে। ফলে শিক্ষকদের যোগ্যতাও অনেক উন্নত হয়েছে।

ম্যাডাম চু এবং তাঁর স্বামী লি ইয়া তুং অন্যান্য স্কুল থেকে রুছেং জেলার এ স্কুলে চলে আসেন। তখন স্কুলে মাত্র ৪ জন শিক্ষক ও একটি শিক্ষাভবন ছিল। হোস্টেলের পানি সরবরাহব্যবস্থা ছিল না, বিদ্যুতের লাইনেও ছিল সমস্যা। তবে গত কয়েক বছরে রুছেং জেলার প্রাথমিক স্কুলের অবকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য নতুন হোস্টেল নির্মিত হয়েছে। বিদ্যুতের ও পানির সমস্যারও সমাধান হয়েছে। এখন তাঁরা সহজে স্নান করতে পারেন। সমস্যা সমাধানের পর আরও মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন। তাদের জীবন এখন অনেক সুখের।

প্রতিদিন বিকেলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা খেলার মাঠে জাতীয় বাঁশনৃত্য করে। সুন্দর বাঁশির ছন্দে বাচ্চাদের হাঁসির শব্দ দূর থেকে শোনা যায়। এ সম্পর্কে ম্যাডাম চু বলেন, প্রেসিডেন্ট সি আসার পর শিক্ষার্থীদের বললেন যে, ভালভাবে পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্বও বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নত করতে চাইলে শিক্ষকদের যোগ্যতা বাড়াতে হবে এবং সুখী জীবনের জন্য শিক্ষকদের আরো পরিশ্রম করতে হবে।

অন্যদিকে, হুনান প্রদেশের হেংইয়াং শহরের তাশান ইয়াও জাতির প্রাথমিক স্কুলে ভাইস প্রেসিডেন্ট পান চিউ রেন প্রেসিডেন্ট সি’র সাথে দেখার স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, “আমি তাশানের মানুষ। গত ৩০ বছর ধরে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকতার কাজ করছি। প্রেসিডেন্ট সি আসার পর আমাদের শিক্ষাভবন, হোস্টেল ও রান্নাঘরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। এখন বাইরে ঝড়বৃষ্টি হলেও ক্লাসরুমে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। ক্লাসরুমে নতুন সাদা বোর্ড স্থাপিত হয়েছে। এখন অনলাইনেও ক্লাস করা যায়। শিক্ষকরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের জন্য আগের চেয়ে বেশি চেষ্টা করছেন। এ সবই ইতিবাচক পরিবর্তন।”

পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীনের কেন্দ্রীয় সরকার মোট ১০.৮ বিলিয়ন ইউয়ান দিয়ে দেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের ১০০০টিরও বেশি জেলার ৩০ হাজারেরও বেশি স্কুলের শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এতে গ্রামাঞ্চলে নতুন করে ৪ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক-কাঠামোও পরিবর্তন হয়েছে। ৩৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিক্ষকের সংখ্যা এখন ৪৩.৩৯ শতাংশ। শিক্ষকদের মধ্যে অনার্স ডিগ্রীধারীর সংখ্যা ৫১.৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়,আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠান শেষ হয়ে এলো।আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না,আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা ben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)