‘কুইক হ্যান্ড কিং’: চীনা যুবক সিয়া ইয়ানের গল্প
2021-01-31 18:33:15

‘কুইক হ্যান্ড কিং’: চীনা যুবক সিয়া ইয়ানের গল্প_fororder_xia1

বন্ধুরা, চীন প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বে কুংফুর জন্য বিখ্যাত। চীনে কুংফু সম্বন্ধে একটি কথা খুব প্রচলিত। কথাটি হচ্ছে: কুংফুর  ক্ষেত্রে দ্রুতগতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আর বর্তমানে এমন এক ধরনের ‘কুংফু’ আছে, চীনা তরুণ সিয়া ইয়ান যে ক্ষেত্রে খুব দক্ষ ও বিখ্যাত। সবাই তাঁকে ‘কুইক হ্যান্ড কিং’ নামে ডাকে। তার নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও স্থাপ পেয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সিয়া ইয়ানের গল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

নিচে, বামে, আবার ডানে...সিয়া ইয়ানের দুই হাতের আঙুলগুলো চোখের পলকের চেয়ে দ্রুতগতিতে যেন রুবিক্স কিউবের ওপর মুভ করে। তাঁর দুই চোখ ঢাকা। দর্শকের চোখ তাঁর হাতের মুভমেন্টকে ফলো করতে পারে না, গতি এতো দ্রুত!

চীনে হুয়ারুং রোড নামে এক ধরনের গেম আছে। এটা মূলত চীনের প্রাচীনকালের পূর্ব হান রাজবংশের প্রধানমন্ত্রী ছাও ছাও-এর গল্পের ভিত্তিতে উদ্ভাবিত এক ধরনের গেম। বিভিন্ন দাবার ঘুটি স্থানান্তরের মাধ্যমে ছাও ছাওকে সূচনা স্থল থেকে দাবা খেলার ছকের নিচ স্থানের মাঝখানে সরিয়ে নিতে হয়, এবং ছাও ছাওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে হয়। দাবাডুর উদ্দেশ্য থাকে সবচেয়ে কম মুভের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা শেষ করা। চোখ-ঢাকা হুয়া রুং রোড গেম সমাধানের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস হল ৯.৫৮ সেকেন্ড। আর এই রেডর্কধারী হলেন ১৯৯২ সালে জন্মগ্রহণ করা চীনা যুবক সিয়া ইয়ান।

সিয়া ইয়ান হাতের এক্সট্রিম স্পোর্ট খেলোয়াড়। হুয়া রুং রোড গেম ছাড়া তিনি রুবিক্স কিউবেও খুবই দক্ষ। তিনি বলেন, রুবিক্স কিউবের প্রেমী সারা বিশ্বে অনেক। সবার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুব তুমুল। এতে শ্রেষ্ঠ খেলালোড় অনেক বেশি। সিয়া ইয়ান রুবিক্স কিউবসম্পর্কিত দু’টি বিশ্ব রেকর্ড অর্জন করতে পেরেছেন—একটা হল মেকানিক্যাল স্প্রিং স্লিটসে রুবিক্স কিউব মেলাতে তিনি শুধু ১৩.২৮ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন। আর দুই জনের একসাথে রুবিক্স কিউব মেলানোর প্রতিযোগিতায় শুধু ১৮.৭১ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন।  

এমন শ্রেষ্ঠ মানে পৌঁছাতে চাইলে দীর্ঘ সময় ধরে চর্চা করতে হয়। ২০০৮ সালে সিয়া ইয়ান রুবিক্স কিউবের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিয়া ইয়ান তাঁর প্রথম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়েন। সিয়া ইয়ান মোট দশ বছর এ জন্য চর্চা করেছেন।

ম্যাজিক কিউবের ৪৩০ বিলিয়নেরও বেশি পরিবর্তন আছে। তাড়াতাড়ি মেলাতে চাইলে মুভ কমিয়ে আনতে হয়। আর এ জন্য শুধুমাত্র একটি পদ্ধতি আছে, তা হল কিউবের ফর্মুলা মুখস্ত করা। সিয়া ইয়ান বলেন, ১২০ মুভের সমাধান থেকে ৬০ মুভের সমাধানে পৌঁছাতে চাইলে ১১৯টি ফর্মুলা মুখস্ত করতে হয়।

ক্লাসরুমের ফর্মুলার সঙ্গে কিউবের ফর্মুলার কোনো মিল নেই। কিউব খেলোয়াড়কে প্রত্যেক ফর্মুলা বার বার চর্চা করতে হয়। এতে ‘মাসল মেমোরি’ সৃষ্টি হয়। তাই সিয়া ইয়ান প্রত্যেক ফর্মুলা বার বার চর্চা করেন। যখন তিনি রুবিক্স কিউব নিয়ে চর্চা করেন, তখন তিনি ভুলে যান রাত ও দিনের পার্থক্য, ভুলে যান তিনি কোথায় আছেন, কি করছেন!

‘কুইক হ্যান্ড কিং’: চীনা যুবক সিয়া ইয়ানের গল্প_fororder_xia2

খাবার খাওয়ার সময়ও তিনি কিউব চর্চা করেন, টয়লেটে যাওয়ার সময় তিনি কিউব চর্চা করেন, স্ত্রীর সঙ্গে শপিংয়ের সময় শুধুমাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় পেলেও তিনি কিউব চর্চা করেন। ব্যবসার কাজে কোথাও যাওয়ার সময়ও তিনি চর্চা করেন।

এক বছর, দুই বছর, তিন বছর, চার বছর...চর্চার সময় বছর হিসেবে হিসাব করতে হয়, কিন্তু অগ্রগতি সেকেন্ডের গতি হয়। যেটা সিয়া ইয়ান করতে পারেন, তা হল কিউবকে নিজের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে যখন-তখন চর্চা করা।  একটি ফর্মুলা শিখতে তাঁর দুই মাস ধরে চর্চা করতে হয়।

তবে গিনেস বিশ্ব রেকর্ডকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে শুধু ‘মাসল ম্যামরি’র ওপর নির্ভর করা যথেষ্ঠ নয়। বিশেষ করে একটি কিউব মেলাতে সময়কে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আরও কম সময় চাইলে হাতের গতি আরও দ্রুত করা দরকার।

তাই সিয়া ইয়ান ডান্সিং মেশিনের চর্চা করেন। সবচেয়ে দ্রুত এক সেকেন্ডে সিয়া ইয়ান ডান্সিং মেশিনে দশটি পদক্ষেপ করতে পারেন। তিনি আরও দু’টি গিনেজ বিশ্ব রেডর্ক ভেঙে দিয়েছেন—মোবাইল ফোনের ইংরেজি কিবোর্ডে দুই হাত দিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার সবগুলো টাইপ করতে তার শুধু ৩.৯১ সেকেন্ড সময় লেগেছে। আরেকটি গিনেস বিশ্ব রেডর্ক হল: একটি আঙ্গুল দিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডে ইংরেজি বর্ণমালার সবগুলো টাইপ করতে তাঁর শুধু ১৮.৬২ সেকেন্ড সময় লেগেছে।

সিয়া ইয়ানের একজন কিউব পার্টনার আছেন। তার নাম  ওয়াং ভেং ছেং। তাঁরা দু’জন একসাথে কিউব মেলানোর বিশ্ব রেকর্ডতে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে প্রশিক্ষণে বেশি শব্দ হয় এই কারণে তারা দু’জন ভালো একটি চর্চার জায়গা খোঁজার চেষ্টা করেন। একবার তারা দু’জন মধ্যরাতে ২৪ ঘন্টার সেলফ-সার্ভিস ব্যাংকে চর্চা করেন। নিরাপত্তাকর্মী তাদেরকে চোর মনে করেছিলেন!

সিয়া ইয়ান বলেন, ‘আমি ১০ হাজার ঘন্টার নিয়মে বিশ্বাস করি। যদি আপনার লক্ষ্য দৃঢ় থাকে, আপনার সঠিক উপায় থাকে, আপনি নিশ্চয় সফল হবেন। সফল হওয়ার সময় ৫ বছর হোক, দশ বছর হোক, অবশেষে নিশ্চয় সফল হবেন। ১০ হাজার ঘন্টা নিয়মের অর্থ হল: ১০ হাজার ঘন্টা চর্চার পর যে-কোনো লোক সাধারণ থেকে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর মাস্টার হতে পারে। তাই যদি আপনি প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কাজ করেন, প্রতি সপ্তাহে ৫ দিন, তাহলে সফল হতে ৫ বছর সময় লাগবে।”

সিয়া ইয়ান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই নিয়ম প্রমাণ করেছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, তিনি কিউবের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দশম বছরে, তিনি ও তাঁর পার্টনার ওয়াং ভেং ছেং সাফল্যের সঙ্গে একটি নতুন গিনেস বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন—দু’জন একসাথে একটি কিউব মেলাতে ১৮.৭১ সেকেন্ড সময় নিয়ে বিশ্বরেকর্ড ভাঙেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আবারও ১৩.২৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে mechanical spring stilts-এ কিউব মেলাতে গিয়ে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন। বর্তমানে সিয়া ইয়ানের আটটি গিনেস বিশ্ব রেকর্ড আছে। তিনি হলেন বিশ্বের ‘কুইক হ্যান্ড কিং’।

‘কুইক হ্যান্ড কিং’: চীনা যুবক সিয়া ইয়ানের গল্প_fororder_xia3

বর্তমানে সিয়া ইয়ান নিজের শখকে একটি ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগের পর একটি বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলেন।  বর্তমানে তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া কিউবের গণক্লাস হল তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সিয়া ইয়ান বলেন, যখন আমি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি কিউব মিলাই, তখন অনেক শিশুর চোখে আলো জ্বলে। শিশুদের শেখার আগ্রহ, বিশেষ করে কিছু পাহাড়ি এলাকার শিশুরা নতুন জ্ঞানের প্রতি এতো আগ্রহী, যা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি অনেক পাহাড়ি এলাকার প্রাথমিক স্কুলে গিয়েছেন, সঙ্গে নিয়ে গেছেন তার কিউব ক্লাস।

সিয়া ইয়ান বলেন, কিছু শিশু হয়ত একটি পিয়ানো কিনতে পারে না, তবে একটি কিউব অর্জন করা কঠিন ব্যাপার না। এই পর্যন্ত সিয়া ইয়ান সহস্রাধিক কিউব বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন।

“আমি শিশুদেরকে কিউব খেলার মৌলিক পদ্ধতি শেখাতে চাই, তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে চাই।” তিনি বলেন।

এতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কারণ কী? অনেক বার সিয়া ইয়ান এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর উত্তর শুধু একটি: নিজের প্রিয় কাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার জন্যই তিনি এতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। (শুয়েই/সুবর্ণা/আলিম)