৩০ বছর ধরে সহপাঠীর বাবা-মায়ের যত্ন নিল সিছুয়ানের নারী লুও চাও হুই
2021-01-25 17:16:11

বয়স্ক পিতামাতার যত্ন নেওয়া চীনাদের সামাজিক রীতিনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হাজার হাজার বছর ধরে এই নীতি মেনে এসেছে চীনারা। তাই, চীনা সমাজে প্রবীণদের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার সন্তানের আকস্মিক মৃত্যু। চীনের সিছুয়ান প্রদেশের পানজিহুয়া শহরের মি’ই জেলায় তেমন এক হতভাগা প্রবীণ দম্পতি রয়েছে। তাঁদের মেয়ে থাং সিয়াও লিং ৩০ বছর আগে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তখন সেটা ছিল দু’জনের জন্য বড় আঘাত। বেঁচে থাকার সাহসই তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন বলতে গেলে। তবে তাঁদের মেয়ের সহপাঠী লুও চাও হুই তখন থেকেই আপন মেয়ের মতো তাদের যত্ন নিতে শুরু করেন। তারা আবার বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায়। আজকের অনুষ্ঠানে এ মনোমুগ্ধকর গল্প আপনাদের শোনাবো।

লুও চাও হুই ও থাং সিয়াও লিং একই উচ্চবিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। যখন থাং সিয়াও লিং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালো, তখন লুও চাও হুই সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে থাং’র বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তখন থেকেই তিনি দু’জনকে দেখাশোনা করা শুরু করেন।

গত ৩০ বছর ধরে তিনি আপন পিতামাতার মতো দু’জন প্রবীণকে দেখাশোনা করে আসছেন। যখন দু’জনের কেউ অসুস্থ হয়, তখন তিনি তাদের নিয়ে হাসপাতালে যান। ৩০ বছর আগে লুও চাও হুই এবং থাং সিয়াও লিং একসাথে মি’ই জেলার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিছেন। তখন একই ক্লাসের সহপাঠী দু’জন পরস্পরের বন্ধু হয়ে যান। স্কুলে প্রতিদিন একসাথে লেখাপড়া ও যাওয়া-আসা করত তারা। তারা সবসময় পরস্পরকে সাহায্য করতো।

১৯৮৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে থাং সিয়াও লিং রেলস্টেশনে কর্মরত মাকে খাবার দিতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়। ট্রেনের বগি থেকে পড়ে গিয়ে সে মাথায় আঘাত পায়। এতে তার মৃত্যু ঘটে। এ দুর্ঘটনার পর ক্লাসের সহপাঠীরা থাং’র বাবা-মাকে আর্থিক সাহায্যও দেয়।

থাং’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর তার মা এ বাস্তবতা সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি একসময় আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লুও চাও হুই তাকে ট্রেনলাইন থেকে টেনে সরিয়ে ট্রেনে কাটা পড়া থেকে বাঁচায়। তখন থেকেই লুও সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে বন্ধু থাং’র জন্য তার বাবা-মার যত্ন নেবে।

তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মেয়ে লুও প্রতিদিন স্কুল শেষ করে থাং’র বাড়িতে যেতো। তার বাবা-মাকে দেখাশোনা করতো এবং ঘরের কাজে সহায়তা দিত। ধীরে ধীরে থাংয়ের পিতামাতার কন্যাকে হারানোর দুঃখ কমে যায় এবং তারা লুওকে আপন কন্যা হিসেবে দেখতে শুরু করেন।

১৯৮৭ সালে লুও চাও হুই মি’ই জেলার শিজেন উপজেলার অর্থ বিভাগে যোগ দেন। তখন তার মাসিক বেতন খুবই কম। এ সময় সম্পর্কে থাংয়ের বাবা বলেন, যখন তার স্ত্রী ও তার মন খারাপ হতো, তখন লুও তাদের কাছে আসতো এবং তাদের ঘরের কাজ করার সাথে সাথে সুস্বাদু খাবারও রান্না করতো। যদি তাদের শরীর অসুস্থ হতো, তবে সে তাদের নিয়ে হাসপাতালে যেতো। উত্সবের সময় বা জন্মদিনে তাদের জন্য নতুন কাপড়চোপড় কিনে আনতো। গত ৩০ বছরে প্রতিটি বসন্ত উত্সব বা ছুটির দিনে লুও তাদের জন্য উদযাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে এবং তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে আসছে।

আসলে লুও’র আর্থিক অবস্থা এতো ভালো নয়। জীবনের  অনেক চাপ তাকে সামলাতে হয়। তার আত্মীয়স্বজন দুই প্রবীণের যত্ন নেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ মনে করেন যে, সে প্রবীণদের বাড়িঘর বা সম্পত্তি দখল করার জন্য এমন কাজ করে আসছে। তবে আসলে থাংয়ের মা-বাবার নিজেদের বাড়িঘর নেই। তাদের আর্থিক অবস্থাও দুর্বল। দু’জন রেলস্টেশনের কাছে ৪০ বর্গমিটারের একটি পুরাতন বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

অন্যদের সন্দেহ দেখেও তাদের যত্ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেনি লুও। এ সম্পর্কে লুও বলল, ‘সবাই প্রবীণ হয়ে যাবে, বয়স্ক লোক অবশ্যই নিজের ছেলে বা মেয়ের সাথে সুখী জীবন কাটাতে চান। তবে তাদের মেয়ে আর নেই, তাই শুধু আমার কারণে তারা বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে। যদি আমি তাদের ত্যাগ করি তাহলে তারা কীভাবে বেঁচে থাকবে? আমি নিজকে ক্ষমা করতে পারব না।’

২০১৫ সালে থাংয়ের মা সেরিব্রাল ইনফ্রাকশনে আক্রান্ত হন এবং এ কারণে হাঁটতে পারেন না। নিজের যত্ন নেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন থেকে লুও নিয়মিত তার খোঁজখবর নিতে থাকেন। ছুটি পেলেই হাসপাতালে তাকে দেখতে যান ও তার যত্ন নেন। গোসল করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দেন। মা-কে নিয়ে বাইরে হাঁটতেও যান, শরীরচর্চা করান। মা হাসপাতাল থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসার পরও লুও তার জন্য চীনা ভেষজ ওষুধের চিকিত্সক খুঁজে বের করতে থাকেন। যদি শোনেন যে, কোথায়ও এমন চিকিত্সক আছে, তবে যত দূরেই হোক তার কাছে চলে যান মায়ের চিকিত্সার জন্য।

গত কয়েক বছরে দু’জন প্রবীণ লুও’র যত্ন প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন। তারাও মনে করেন দু’জনকে দেখাশোনা করা মেয়ে লুও’র জন্য বড় চাপ। তাদের এমন কথা শুনে লুও সবসময় রাগ করেন। তিনি সবসময় দু’জনকে বলেন, ‘আপনাদের কন্যা আর নেই। সিয়াও লিং চলে যাওয়ার পর আমিই আপনাদের আত্মীয়স্বজন, আপনাদের কন্যা। তাই আপনাদের যত্ন নেওয়া আমার কর্তব্য।”

আশেপাশের প্রতিবেশীদের অনেকে জানে না যে, লুও দু’জন প্রবীণের আপন মেয়ে নয়। কারণ সে সবসময় দু’জনের যত্ন নেয় মা-বাবার মতো। ২০১৭ সালে থাংয়ের রোগ গুরুতর আকার ধারণ করে। যদিও হাসপাতালে চিকিত্সাধীন হন তিনি, কিন্তু তাঁর অবস্থা ভালো হয়নি। তার কষ্ট আরও বাড়ে। সেই সময় তার স্বামীও হার্টের রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের রোগে আক্রান্ত হন। লুও’র পরিবার বাস করে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। দুওর পক্ষে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেওয়া সহজ কাজ নয়। সে তখন দু’জনকে নিজের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু প্রবীণরা সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।

২০১৮ সালে লুও তেশি জেলার কমিউনিটি থেকে অবসর নেন। তখন থেকেই তাদের দু’জনকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন লুও। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে থাং আরেকবার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং তাকে যত্ন নিতে হাসপাতালে টানা ২০ দিনের মতো বাস করেন লুও। থাং একটু ভালো হওয়ার পর তার স্বামীও হাসপাতালে ভর্তি হন। লুও প্রায় মাস খানেক তাঁরও যত্ন নেন।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে থাং মারা যান। তার স্বামীও নিজের জন্মস্থানে ফিরে যান। এ সম্পর্কে লুও বলল, ‘আমি নিয়মিতভাবে তাকে ফোন করি। আমার সাথে থাকতে আমন্ত্রণ জানাই। তবে তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। জন্মস্থানে আত্মীস্বজনের সাথে জীবনের শেষ সময় কাটাবেন তিনি।’ এ সম্পর্কে লুও বলে যে, সময় পেলে সে তাকে দেখতে যাবে। 

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে এলো। আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না, আমাদের যোগাযোগ ঠিকান ben@cri.com.cn, caoyanhua@cri.com.cn,সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী বছরের প্রতি সোমবারে আবার দেখা হবে, কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)