সঠিক প্রতিযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে
2021-01-18 17:03:47

বর্তমানে শিক্ষা ও শিক্ষার উন্নয়ন চীনাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। চীনা পিতামাতারা বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারে এখন আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় অধিক মনোযোগী।  একসময় শুধু পরীক্ষায় ভালো করার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার মানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া, শিক্ষার পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে ইতিবাচক পরিবর্তন। চীনা শিক্ষাব্যবস্থা এখন একটি সমন্বিত উদ্যোগের নাম। এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষাবিদ বেইজিং নর্মাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক কু মিং ইউয়ান এক সাক্ষাত্কারে তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কে এবং শিশুদের যথাযথ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করব।

সঠিক প্রতিযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে

বর্তমানে সবাই বাচ্চাদের প্রাধান্য ও সুপ্তশক্তি বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট পড়াশোনার পদ্ধতি খুঁজে বের করার ব্যাপারে আগ্রহী। মানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী পদ্ধতি প্রয়োগ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো পিতামাতা মনে করেন, তাদের বাচ্চা একাই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে বেশি ভালো হবে। আসলে তা ভুল ধারণা। লেখাপড়া একসাথে করা বেশ কার্যকর। কারণ, মানুষ সামাজিক জীব। যে-কোনো কাজ মানুষ যৌথভাবে করলে বেশি ভালো ফল পেতে পারে। শিক্ষাও এর বাইরে নয়।

২০১৫ সালে ইউনেস্কো এক প্রতিবেদনে বলেছিল, তথ্য, জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের সমন্বিত প্রক্রিয়া হল পড়াশোনা। এ পড়াশোনা হতে হবে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। তাই লেখাপড়ার উপযোগী পরিবেশ দরকার। যদি ভুল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করা হয়, তবে তার কার্যকারিতা হবে কম। অধ্যাপক কু চীনের চেচিয়াং প্রদেশের একজন সিনিয়র গণিত শিক্ষক ইউ চেং ছিয়াংয়ের ক্লাসের উদাহরণ দিয়ে বলেন, শিক্ষক ইউ তাঁর গণিত ক্লাসে যে-কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শিক্ষার্থীদের উত্সাহ দেন। ফলে এমনও হয়েছে যে, শিক্ষার্থীরা কোনো কোনো গাণিতিক সমস্যার চার ধরনের সমাধান বের করেছে। আর এই চারটি পদ্ধতিই সকল শিক্ষার্থী শিখেছে। একা একা পড়লে সাধারণভাবে শিক্ষার্থীরা একটি সমাধান-পদ্ধতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো। একা একা পড়াশোনা করার এটা একটি বড় দুর্বলতা।

ক্লাসে কিভাবে শিক্ষার্থীদের ranking করতে হবে?

প্রাথমিক স্কুল থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিবারের পরীক্ষায় শিক্ষকরা ক্লাসের গড় স্কোর হিসেব করেন। এভাবেই ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অবস্থান বা রাঙ্কিং ঠিক করা হয়। এ সম্পর্কে অধ্যাপক কু মনে করেন, চীনের মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষার স্কোর গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হতে পারে। পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে। তবে পরীক্ষার ফলাফল অনেক বিষয় ও উপকরণের সাথে জড়িত। পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য প্রতিযোগিতা নয়, বরং জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা ও গুণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। একসাথে পড়াশোনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরস্পরকে সহায়তা দিতে সক্ষম এবং যৌথভাবে নিজেদের শিক্ষার মান উন্নত করতে পারে।

পড়াশোনায় প্রতিযোগিতার ভাবনা তীব্রতর হওয়া শিক্ষার্থীদের মানসিকতার জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজকাল শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা ও স্বাস্থ্যকর মেজাজ গঠনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ইউনেস্কো মনে করে, শিক্ষার্থীদের উচিত উন্মুক্ত ও খোলামেলা মন নিয়ে অন্যদের সাথে বিনিময়, যোগাযোগ ও সহযোগিতা করা। এভাবে ছোটবেলা থেকেই তাদের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। এভাবে তারা একে অপরের কাছে শিখতে পারে, নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। আসলে মানুষের নেতৃত্বের দক্ষতা কাজে লাগানো মানে অন্যদের নির্দেশ দেওয়া নয়, বরং অন্যদের সম্মান করা। অন্যদের সাথে কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে যে-কোনো কাজে সাফল্য অর্জন করা যায়।

অতীতকালে শিক্ষকরা সবসময় বলতেন, স্কোরের দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে পড়লে হাজার শিক্ষার্থী তোমার চেয়ে অনেক এগিয়ে যাবে। তার মানে এক নম্বর কম পেলে অন্যরা তোমার চেয়ে এগিয়ে যাবে। তবে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতিতে এমন চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটছে। শিক্ষার্থীদের একসাথে পড়াশোনার মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের মতামত আসবে, মাঝে মাঝে বিতর্কও হতে পারে, তবে তা পরস্পরের চিন্তাভাবনার উন্নয়নের জন্য ভালো। এর মাধ্যমে নতুন ধারণা আসবে এবং তা অভিন্ন অগ্রগতির জন্য সহায়ক।

পড়াশোনায় প্রতিযোগিতার ভাবনা যুক্ত করা ঠিক নয়। একটি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী খেলোয়াড়রা যখন মূল গেমসে অংশগ্রহণ করেন, তখন একে অপরকে ছাড়িয়ে গিয়ে পদক জেতার চেষ্টা করেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তখন সবার উচিত সহযোগিতার ভিত্তিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শ্রেণিকক্ষে সকল শিক্ষার্থীকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তারা পরীক্ষার সময় একজন আগেরজনের চেয়ে ভালো করার চেষ্টা করবে। এতে দোষের কিছু নেই।

বাচ্চাদের বিনোদনের সময় দিতে হবে

চীনা বাচ্চাদের জন্য শীতকালীন ছুটি ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এই ছুটি মূলত তাদের বিনোদনের জন্য ব্যয় করা উচিত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসময় বাচ্চাদের অনেক হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়। হোমওয়ার্কের পরিমাণ যাতে অতিরিক্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে, চীনা বাচ্চাদের কেউ কেউ এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অতিরিক্ত ক্লাসে অংশ নিতে বাধ্য হয়। কেউ ছবি আঁকা শেখে, কেউ বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়ার ক্লাসে অংশ নেয়, কেউ ইংরেজি শেখে, কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখে। এর মানে বাচ্চারা একটু অবসর সময় কাটানোর এবং নিজেদের মতো করে বিনোদিত হবার সুযোগ খুব কম পায়। এমনটা হওয়া উচিত নয়। এতে অনেক বাচ্চার মধ্যে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চীনে শীতের ছুটি শুরু হয়েছে। পিতামাতারা এ সময় কিভাবে বাচ্চাদের সময় ভাগ করবেন, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে-কোনো ছুটিতেই হোমওয়ার্ক থাকবে বা থাকা উচিত। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন না-করাই উত্তম। শৃঙ্খলার অভ্যাস গড়ে তুলতে নির্ধারিত সময়সূচিও এসময় অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু সবক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বাচ্চাদের মনের ওপর যাতে বেশি চাপ না পড়ে। পুথিগত বিদ্যার পাশাপাশি এসময় বাচ্চাদের এমন কিছু কিছু কাজ করতে দিতে হবে যেগুলো তারা পছন্দ করে আবার যেগুলো জীবনের জন্য জরুরিও বটে। যেমন, কেউ রান্নাবান্না শিখতে পারে, কেউ ঘরের কাজ করতে পারে, কেউ বেড়াতে যেতে পারে, কেউ ছবি আঁকা শিখতে পারে, কেউ বা স্রেফ গল্পের বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। যার যেটা করতে ভালো লাগে। বাচ্চাদের শখের কাজ করতে দিতে হবে। ছুটির দিনে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন নিয়ম করে অনেক ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠা লাগে না। কিন্তু সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া ও সময়মতো ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা যাতে নষ্ট না হয়, তা লম্বা ছুটির সময় খেয়াল রাখতে হবে।

মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, ‘আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে খানিকটা সময় দূরে থাকা’ এবং ‘ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নেওয়া’ মানুষের মন-মানসিকতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন, সারাদিন হোমওয়ার্ক করার পর অবশ্যই বাচ্চাদের মন ও শরীর ক্লান্ত হয়। তখন কিছু সময়ের জন্য ভিডিও গেমস খেলা বা টেলিভিশন দেখা বা সংগীত শোনা বা খেলাধুলা করা তাদের মন ও শরীরের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। এতে তাদের শরীর ও মন আরও পড়াশোনার জন্য নতুন করে তৈরি হতেও সময় পায়। তবে ভিডিও গেমস্‌ বা টিভি দেখা বা খেলাধুলায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা যাবে না। এতে বাচ্চাদের ফোকাস অন্যদিকে চলে যেতে পারে। তা ছাড়া, ভিডিও গেমস্‌ বা টিভি দেখার ব্যাপারে বেশি সাবধান থাকতে হবে। এতে বাচ্চাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে।

 

গবেষণায় দেখা গেছে, একই ধরনের কাজ টানা বেশিসময় ধরে করলে বাচ্চাদের সৃজনশীলতা হ্রাস পায়। একটি জরিপের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। একদল শিক্ষার্থীকে টানা ৪০ মিনিট ধরে একই জিনিস শেখানো হয়। আর অন্য একদলকে মাঝখানে দু’বার বিরতি দিয়ে তারপর শেখানো হয়। দেখা গেল, যারা বিরতি পেয়েছে, তাদের মনোযোগ ছিল বেশি।

 

বাচ্চাদের মাথাকে মাঝে মাঝে চিন্তামুক্ত রাখা বা তাদের মনকে বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া তাদের সৃজনশীলতা উন্নয়নের জন্য সহায়ক। যারা শিল্প বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, তাদের জন্য এ কথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে কল্পনা আসলে একধরনের দিবাস্বপ্ন, যার মাধ্যমে ব্যর্থতার কষ্ট কাটানো যায় এবং মন প্রফুল্ল হয়। তাই, বাচ্চাদের পড়াশোনার বাইরে নিজের মতো করে কিছু করার বা কল্পনা করার সুযোগ দিতে হবে। বাচ্চাদের শুধু পড়াশোনা ও পরীক্ষার মধ্যে রাখলে তাদের মনের ওপর চাপ পড়বে। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যও হারাতে পারে।

 

তবে পড়াশোনার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে খুব বেশি সময়ের বিশ্রামও কাম্য নয়। অতিরিক্ত বিশ্রাম ভালো নয়। এতে বাচ্চারা অলস হয়ে যেতে পারে। তাই পিতামাতা ও শিক্ষকদের উচিত বাচ্চাদের জন্য যুক্তিযুক্ত সময়সূচি প্রণয়ন করা। বাচ্চাদেরকে নিজেদের মতো করে কাটানোর জন্য কিছু সময় দিতে হবে। কিন্তু সেটা হবে নিয়ন্ত্রিত। এভাবে আশা করা যায় যে, বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হবে। আর প্রতিটি বাবা-মা-ই চান, তাদের বাচ্চাদের জীবন সুন্দর হোক, সুখের হোক, কল্যাণের হোক।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)