কোনও কোনও দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়েও অসাধারণ সুন্দর স্বপ্নের জন্ম হয়। আর দুঃস্বপ্নের দুঃখ ভুলিয়ে সেই স্বপ্ন মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূর; সমাধান করে অনেক সমস্যার। ১৯৯৭ সালের ১৯মে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়; কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারায় আর গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলবার নয়। তবে সেই ঘটনার মধ্য দিয়েও একটি স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল। আজ সরকারি উদ্যোগে জেলায় জেলায় আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য যে বসতবাড়ি নির্মিত হচ্ছে এবং বিনামূল্যে মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে সেই উদ্যোগের সূচনা হয় সেই দিন।
ওই ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘূর্ণিঝড়ের পরে সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে ওই এলাকা পরিদর্শনে যান তিনি। অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ শেখ হাসিনা সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে অত্যন্ত ব্যাথিত হন। সেখানকার গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। দুই ধাপের ওই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৩ হাজার ৮শ কোটি টাকার আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন; ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা; এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ। আর এ কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কার্যক্রম পরে আর কেবল গৃহনির্মাণ ও বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আশ্রয়ণ প্রকল্প-১ ও ২’র আওতায় ২ লাখ ৭৫ হাজার মানুষকে আয়বর্ধক পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ১ লাখ ৩৮ হাজার পরিবারকে ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প-১ বাস্তবায়িত হয় ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে ২০০২ সালের জুন পর্যন্ত। তিন শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত ওই প্রকল্পের আওতায় ৪৭ হাজার ২শ ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০২ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৮ হাজার ৭শ ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।
আশ্রয়ণ প্রকল্প-১’র সাফল্য ও ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদের জন্য গ্রহণ করা হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ২ হাজার ৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে আর এর লক্ষ্য হলো আড়াই লাখ ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা। প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১ লাখ ৯২ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ৩শ ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ ব্যারাকে স্থানান্তর করা হয়েছে, ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮শ পরিবারকে তাঁদের নিজ জমিতে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য ২শ ৩৪টি টং ঘর ও বিশেষ ডিজানের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু ঘর বানানোর মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে না আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ। সবুজায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পগ্রামগুলোতে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। প্রকল্পগ্রামে বসবাসকারীদের জীবনযাত্রা সহজ করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক মানুষের নিজের আবাসন গড়ার সক্ষমতা ছিল না এবং এখনও অনেকের নেই। এমন সব মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প একটি আশির্বাদ হয়ে এসেছে। এ প্রকল্পের কারণে এমন অনেক মানুষ বসবাসের জন্য নিজের একটি ঘর পেয়েছে, যারা নিজে নিজের ঘর নির্মাণের স্বপ্ন হয়তো পূরণ করতেই পারতো না। চলতি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর। ওই সময়ের পরও অনেক মানুষ হয়তো গৃহহীন থাকবে। বাকীরাও যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য নিজেদের একটা ঘর পায়, সেটা নিশ্চিত করতে এ প্রকল্প ২০২২ সালের পরও বহাল রাখা প্রয়োজন।