প্রথমে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের গত এক সপ্তাহের কর্ম তত্পরতা তুলে ধরছি...
গত ৪ঠা জানুয়ারি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মিয়ানমার প্রজাতান্ত্রিক ঐক্যতন্ত্রের ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট’কে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট সি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি যে, মিয়ানমার সরকারের নেতৃত্বে দেশটির জনগণ তাঁদের নিজস্ব বৈশিষ্ট সম্পন্ন উন্নয়নের পথে ক্রমশ এগিয়ে যাবে এবং সুন্দর ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করবে।” “গত বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট উইনের আমন্ত্রণে আমি মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সফর করেছি। সে থেকে দু’দেশের সম্পর্ক অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। আমি দু’দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের উপর অতন্ত্য গুরুত্ব দেই”। দুদেশের বিভিন্ন খাতে বাস্তব সহযোগিতা জোরদার করে, চীন-মিয়ানমার অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার কাজ আরও এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ওই দিন চীনের প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিং কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের ২০২১ সালের প্রথম নির্দেশে স্বাক্ষর করেছেন। এতে গোটা সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু করতে সৈন্য সমাবেশের আদেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরে গোটা সেনাবাহিনীকে সি চিন পিং নতুন যুগের চীনা বৈশিষ্টসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার আলোকে নতুন যুগের সামরিক কৌশল পালন করার নির্দেশ দেন। সামরিক প্রশিক্ষণের প্রতি সিপিসির নেতৃত্ব জোরদার করারও আদেশ দেন তিনি। পাশাপাশি যুদ্ধ করার প্রস্তুতিমূলক কাজকে গুরুত্ব দিয়ে সার্বিকভাবে বাস্তব-যুদ্ধের প্রশিক্ষণের মান উন্নত করে যে কোন যুদ্ধ জয়ের সক্ষমতা অর্জনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট সি। চীনা সেনাবাহিনীর সকল সদস্যকে দৃঢ়ভাবে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সিদ্ধান্ত ও দিক-নিদের্শনা অনুসরণ করতে বলেন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারি বেইজিংয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিপিসি’র সাধারণ সম্পাদক ও দেশের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বলা হয়, গত এক বছরে সিপিসি’র কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারী-প্রতিরোধক কাজে অর্জিত হয়েছে ব্যাপক সাফল্য। সভায় আরও বলা হয়, চলতি বছর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম বর্ষ। এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চীনাদের উচিত, জাতির মহান পুনরুত্থানের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে, কমরেড সি চিন পিংকে কেন্দ্র করে দেশের আরও উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া।
গত ৯ জানুয়ারি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, দেশের প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিং রাজনৈতিক ও আইনি কাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০২০ সালে রাজনৈতিক ও আইনি ফ্রন্টে যারা কাজ করেছেন তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মহামারী প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করেছেন। ‘চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনার’ সূচনা বছর ২০২১ সাল। বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও আইন বিভাগ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ও সার্বিক আইন অনুযায়ী দেশ প্রশাসন বিষয়ক কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসম্মেলনের চেতনা বাস্তবায়ন করবেন এবং কার্যকরভাবে সংশ্লিষ্ট কাজের উচ্চমানের উন্নয়ন এগিয়ে নেবেন বলে উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট সি।
‘প্রথম চাইনিজ পিপলস পুলিশ দিবসের’ প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট সি সিপিসি’র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেশের পুলিশ বাহিনীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। চীনের গণ-পুলিশ জনসেবা, জনগণের সুখ এবং দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় আরও বেশি অবদান রাখবে বলে আশা করেন প্রেসিডেন্ট সি।
২. যুক্তরাষ্ট্রে পার্লামেন্ট ভবনে সহিংসতায় কি প্রতিফলিত হয়েছে?
গত ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে সশস্ত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীদের একাংশ পার্লামেন্টভবনে ঢুকে ভাঙচুর করে। এসময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। ঘটনার সময় পার্লামেন্টের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইলেক্টরেট ভোট সত্যায়নের কাজ চলছিল। বিক্ষোভকারীদের একাংশ পার্লামেন্টভবনের ভিতরে প্রবেশের পর পরই অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়।
বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কক্ষ তছনছ করে। এসময় প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। মার্কিন তথ্যমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পার্লামেন্টভবনের ভিতরেও গোলাগুলি হয়েছে। তবে, রাত ৮টায় আবার অধিবেশন শুরু হয়।
ওই সহিসতায় ৪জন নিহত হয়েছে। নিহতদের একজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে এবং বাকি তিনজন হাসপাতালে চিকিত্সা গ্রহণের সময় মারা গেছে। এ সহিংস এবং নজিরবিহীন হামলায় অন্তত ১৪জন পুলিশ আহত হয়েছে এবং ৫২জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি’র মেয়র মুরিয়েল বাউসার শহরটিতে কার্ফিউ জারি করেন। সেসঙ্গে শহরটিতে চলমান জরুরি অবস্থা আরও ১৫ দিন বাড়ানোর ঘোষণা দেন।
বিক্ষোভকারীরা লাঠি নিয়ে ভবনের গ্লাস, দরজা ও জানালা ভেঙে সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা আতঙ্কে ছুটাছুটি শুরু করলে পুলিশ তাঁদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। নিরাপত্তা রক্ষীরা বন্দুক দিয়ে দরজা সুসংহত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমন দৃশ্য হলিউডের কোন চলচ্চিত্রের নয়, বরং গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটনে অবস্থিত খোদ যুক্তরাষ্ট্রের পার্লমেন্ট ক্যাপিটল ভবনে বাস্তবেই ঘটেছে। কেউ কেউ এমন দৃশ্যের নাম দিয়েছেন ‘সংসদের পতন’।
এ প্রসঙ্গে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া ছুন ইং বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে, আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা বিশ্বাস করি মার্কিন জনগণ আশা করেন যে, স্বাভাবিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হবে।”
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন যা ঘটছে অতীতে হংকংয়ে যা ঘটেছিল তার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মানুষ ও তথ্যমাধ্যমের মনোভাব একেবারেই ভিন্ন ছিল।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হংকংয়ে বিক্ষোভকারীরা হংকংয়ের সংসদ ভবনে জোরপূর্বক প্রবেশ করে এবং ভাংচুর চালায়। তারা বিষাক্ত তরল ও গোড়া ব্যবহার করে পুলিশের উপর হামলা চালায়। এমনকি, তারা পুলিশের আঙ্গুল কামড়ে ভেঙ্গে দেয়। পুলিশকে ছুরিকাঘাতে আহত করে। কিন্তু হংকংয়ের পুলিশ উচ্চ মানের ধৈর্য্য ধারণ ও পেশাদারীত্ব বজায় রাখে।
তিনি বলেন, ফলে একজন বিক্ষোভকারীও নিহত হয় নি। কিন্তু বর্তমানে ওয়াশিংটনে যা ঘটছে, তা তখনকার হংকং ঘটনার চেয়ে মারাত্বক বা গুরুতর নয়। কিন্তু ইতোমধ্যে ৪জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা, ও তথ্যমাধ্যম এ দুই ঘটনার জন্য ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে, তা নিয়ে মার্কিন মূলধারার তথমাধ্যম ‘সহিংস ঘটনা, গুণ্ডা, চরমপন্থী, ভিলেন ও লজ্জাজনক’ শব্দগুলো ব্যবহার করছে। কিন্তু তারা হংকংয়ের সহিংসতার সময় বিক্ষোভকারীদের প্রতি ‘সুন্দর দৃশ্য, বীর’ এসব শব্দ ব্যবহার করতেন। এমনকি বিক্ষোভকারীদের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন রয়েছে বলেও তাদের উস্কানি দিতেন।
ওয়শিংটন ও হংকংয়ের সহিংসতায় ভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া ও শব্দ চয়নের বিষয়টি সবার ভেবে দেখা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
যে দেশ মানবিক ও সাম্যের তীর্থ ভূমি বলে নিজেকে পরিচয় দেয়, সেদেশে এমন ন্যাক্কারজনক সহিংসতা বিশ্বকে অবাক করেছে। অনেকে আবার মনে করছেন যে, মার্কিন রাজনীতিকরা এতদিন অন্য দেশগুলোতে এমন ঘটনা সৃষ্টিতে মদদ জোগালেও এবার তাঁদের নিজের উপর পড়েছে। এ যেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতার চরন ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’র বাস্তব প্রতিফলন।
একে বিশ্লেষন করতে গিয়ে অনেকে গত ২০১৯ সালের জুনে চীনের হংকংয়ে সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করছেন। সে সময় বিক্ষোভকারীরা হংকংয়ের সংসদ ভবনে একই স্টাইলে অনুপ্রবেশ করে ভাংচুর চালিয়েছিল। যা যুক্তরাষ্ট্রের এবারের ঘটনার সঙ্গে হুবহুব মিলে যাচ্ছে। কিন্তু সে সময় মার্কিন রাজনীতিকগণ হংকংয়ের সহিংসতাকে ‘সুন্দর দৃশ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং সহিংসতাকারীদের ‘সমতা’ রক্ষাকারী হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন।
কেবল হংকং নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সমতার অজুহাতে বিশ্বের নানা দেশে সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে। তবে, তাঁদের ‘কথিত সুন্দর দৃশ্য’ খোদ যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেলে তাঁদের পুলিশ মরিচের গুড়া ছিটানোসহ নানা যন্ত্র দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ এবং ১৩জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করতে পিছপা হয় না। এতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সমতা’ নীতির মুখোশের শেষ সুতোটিও খসে পড়ছে।
৩. সিন চিয়াংয়ের জনসংখ্যা নিয়ে পশ্চিমা মিথ্যাচারের খণ্ডন
গত ৪ঠা জানুয়ারি চীনের সিন চিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে চীন বিশেষজ্ঞ জুলিয়াটি সিমায়ি এবং চাং ইয়া ছিয়ানের যৌথ রচিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এতে বাস্তবতা ও পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে সিন চিয়াংয়ের জনসংখ্যার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে অঞ্চলটির জনসংখ্যা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অপতত্পরতা ও মিথ্যা দাবিসমূহকে খণ্ডন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিন চিয়াং অঞ্চলে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১.১ শতাংশ। এটি জার্মান বিশেষজ্ঞ আডরিয়ান জেঞ্জের তথাকথিত সিন চিয়াংয়ের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে।
২০১৮ সালে সিন চিয়াংয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের চেয়ে কমে ০.৬২ শতাংশে দাঁড়ালেও সে বছর সারা চীনের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের তুলনায় সিন চিয়াংয়ের হার ছিল সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনে আডরিয়ান জেঞ্জের তথাকথিত ‘হান জাতির মানুষের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার উইগুর জাতির মানুষের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে ৮গুণ বেশি- এমন মন্তব্যের সমোচিত জবাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৯৮৭ সালে উইগুর জাতি ও হান জাতির মানুষের জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ১.০৮:১। ২০১৮ সালে এটি ছিল ১.২৯:১। আর ২০১৮ সালে উইগুর জাতির জনসংখ্যা ১কোটি ১৬লাখ ৭৮হাজার ৬শ এবং হান জাতির জনসংখ্যা ছিল ৭৮লাখ ৫৭হাজার ৪শ জন। ফলে জার্মান বিশেষজ্ঞের দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
রুবি/এনাম