চারজন বিদেশির চীনের গ্রামাঞ্চল সফর
2021-01-15 19:07:40

চারজন বিদেশির চীনের গ্রামাঞ্চল সফর_fororder_tian3

চীনের আনহুই প্রদেশের চিন চাই জেলার তা ওয়ান গ্রাম আগে চীনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দরিদ্র গ্রাম ছিল। সম্প্রতি কয়েকজন বিদেশি বন্ধু সে অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। তারা ভেবেছিলেন, এ দরিদ্র গ্রামে নিশ্চয় পানি সরবরাহের পাইপ নেই, বিদ্যুত্ নেই, রাস্তা-ঘাট খুব খারাপ। পাশাপাশি, গ্রামে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি, তরুণ ও যুবকদের পরিমাণ খুবই কম এবং নিশ্চয়ই ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল!

 

কিন্তু তারা কল্পনা করতে পারেন নি যে, গ্রামটি সবুজ পাহাড় ও স্বচ্ছ নদ-নদী দিয়ে পরিবেষ্টিত। প্রত্যেক পরিবারে পানি সরবরাহের পাইপলাইন আছে এবং বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, ওয়াই-ফাই আছে; পাশাপাশি রাস্তাঘাট খুব সুন্দর। গ্রামের কিছু কৃষক নিজেদের বাড়িতে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, সাপ্তাহিক ছুটিতে অনেক মানুষ এ গ্রামে বেড়াতে যান।

 

অবাক করার মতো আরও অনেক বিষয় সেখানে আছে।

২০১৪ সালে তা ওয়ান গ্রামটি চিন জাই জেলার গুরুত্বপূর্ণ দরিদ্র গ্রাম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন গ্রামে কোনো দরিদ্র মানুষ নেই। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে দরিদ্র জেলার তালিকা থেকে গ্রামটির নাম মুছে ফেলা হয়। এখন গ্রামটি উন্নয়নের নতুন পথে উঠেছে।

অতীতের কথা স্মরণ করে গ্রামবাসীরা বলেন, কয়েক বছর আগে এখানে কোনো সুন্দর পথ ছিল না, সূর্যালোকে ধুলাবালি ও  বৃষ্টির সময় পথঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যেত।

 

১৫ বছর বয়সী দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে রেবেকা এবং তাঁর বাবা শাওন একসাথে আনহুই প্রদেশের রাজধানী হ্যফেই থেকে রওনা হন। তাঁরা দু’জন গাড়ি চালিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টায় দু’শ কিলোমিটার দূরবর্তী ওই গ্রামে যান। শাওন বলেন, আমি ভেবেছিলাম যে, পথ নিশ্চয়ই খুব খারাপ হবে। তবে কল্পনাও করতে পারি নি যে, এই যাত্রা এত আরামদায়ক হতে পারে!

 

তাঁরা দু’জন গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়িতে উঠলেন। ঘরে ঢুকে রেবেকার সব দুশ্চিন্তা চলে যায়। কারণ, ঘরে এসি আছে, টিভি আছে, ফ্লাশ টয়লেট আছে— একেবারে শহরের মতো সুযোগ সুবিধা। রেবেকা ভাবলেন, ওয়াই-ফাই আছে কিনা— খোঁজ নেওয়া যাক! দেখা গেল, সত্যিই আছে!

চারজন বিদেশির চীনের গ্রামাঞ্চল সফর_fororder_tian1

জিম্বাবুয়ের মাস্টার্স ডিগ্রীধারী ছাত্র উ জুন চিয়ে (তাঁর চীনা নাম) এখন ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি বেইজিং থেকে রওনা হন। দ্রুতগতির রেল সরাসরি চিন জাই জেলায় যেতে পারে। ট্রেন থেকে নেমে তিনি বাসে করে তা ওয়ান গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছান। সেখানের শিক্ষক ও শিশুরা তাঁকে জানায়, স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা আছে। প্রতি বেলার মিলে একটি মাংসের ডিশ এবং দুটি শাকসবজির ডিশ থাকে। আরো থাকে এক বাটি সুপ। আর, এসব খেতে শুধু দুই ইউয়ান দিতে হয়।

 

বিদেশি অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর এক শিশু ‘বড় ঢেউ’ নামে একটি গান পরিবেশন করে। গানের কথায় বলা হয়- ‘আমার স্বপ্ন জ্বলে, আমার হৃদয়ে বড় ঢেউ নড়ে’। ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্র বলে, সে ভবিষ্যতে চীনের প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়- ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। বিদেশে লেখাপড়া করতে পারলেও সে অনেক আনন্দিত হবে। কথা বলার সময় সে ইংরেজি ভাষায় বিদেশি অতিথির সঙ্গে সাবলীলভাবে আলাপ করতে পারে। স্কুলের ছোট শিক্ষার্থীরা বলে, ভবিষ্যতে তারা ডাক্তার, ক্রীড়া শিক্ষক ও শিল্পপতি হতে চায়। এটাই হল- ভবিষ্যতে তাঁদের স্বপ্ন।

 

জিম্বাবুয়ের যুবক উ জুন চিয়ে মনে করেন, দরিদ্রতার আসল অর্থ বাছাইয়ের সীমাবদ্ধতা। পাঁচ বছর আগে শিশুদের স্বপ্ন ছিল একবার প্রাদেশিক রাজধানীতে যাওয়া। কিন্তু এখন তাদের স্বপ্ন হল বিদেশে যাওয়া ও বিশ্বকে দেখা। বোঝা যাচ্ছে, এই গ্রামটি সত্যিকার অর্থেই দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।

 

মালয়েশিয়ার সাংবাদিক জি কুও মিং বেইজিং থেকে এই গ্রামটিতে এসেছেন। প্রথমে তিনি তা ওয়ান গ্রামের চিকিত্সা কক্ষে যান। সেখানকার কর্মীরা তাঁকে জানায়, এখানে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ চিকিত্সার ফি দেয় সরকার। এখানে কেউ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে বিনামূল্যে চিকিত্সা দেওয়া হয়।

 

জি কুও মিং এক ধরনের তুলনা করে বলেন, মনে করি একজন চীনা কৃষক এবং একজন মার্কিন কৃষক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদেরকে দু’সপ্তাহের জন্য নিজ নিজ স্থানে চিকিত্সা নিতে হবে। চীনা কৃষকের চিকিত্সার কোনো খরচ নেই। অন্যদিকে, মার্কিন কৃষকের বীমা না থাকলে তাকে ৩৪ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। এটাই হল পার্থক্য।

 

ক্রয় ক্ষমতার সামর্থ্য বা পিপিপি অনুযায়ী হিসাব করলে চীনে দরিদ্রতার মানদণ্ড বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দরিদ্রতার মানদণ্ডের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে। এ ছাড়া, চীনের দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার মানদণ্ড বহুমুখী। এখানে বহুমুখী বিভিন্ন উপাদান রয়েছে। অর্থাত্, মাথাপিছু আয় মানদণ্ডের ওপরে রয়েছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া ও জীবনযাপন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। পাশাপাশি, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, মৌলিক চিকিত্সা ও বাসস্থানের নিরাপত্তাও ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছে।

 

বিদেশি অতিথিদের চোখে, চীনের দারিদ্র্যমুক্তকরণ বিশ্বের মানদণ্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, দারিদ্রতার মানদণ্ড রক্ষায় ওয়াই-ফাইসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ততটা প্রয়োজনীয় না হলেও চীনের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে তা খুব সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে ইন্টারনেটের সুবিধা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার অতিথি শাওন বলেন, কিছু কিছু দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্য এখনো পানীয় জল ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মধ্যে সীমিত রয়েছে। তবে, চীন সরকার সাধারণ জনগণকে আরো বেশি নিশ্চয়তা দিয়েছে, আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করছে। এতে আশা করা যায়, দারিদ্র্যবিমোচনের প্রক্রিয়া টেকসই ও স্থায়ী হবে।

 

শাওন ও তাঁর মেয়ে রেবেকা সফরের প্রথম দিন পুরো গ্রামের আতিথেয়তা উপভোগ করেন। তাদেরকে নাস্তায় নুডল্স ও ডিমের রুটি দেওয়া হয়। সকালে গ্রামের মেলায় গিয়ে কিছু স্থানীয় খাবার কিনেন তারা, দুপুরে পুরো টেবিল গ্রামীণ বৈশিষ্ট্যময় খাবারে পরিপূর্ণ ছিল। বিকালে স্থানীয় বিখ্যাত চা কারখানা পরিদর্শন করেন তারা। সবচেয়ে সরগরম সময় হয় রাতের বেলা। তারা বোনফায়ার সামনে কৃষকের সঙ্গে একসাথে বার্বিকিউ করেন ও নাচেন; এসময় আতশবাজির ব্যবস্থা করা হয়।

 

রেবেকার মুখ দেখে বোঝা যায় তিনি খুব আনন্দ পেয়েছেন। তিনি সাংবাদিককে বলেন, গ্রামটি দরিদ্রতা বিদায় করেছে, লোকজনের জীবন খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে। তার পাশে থাকা তার বাবা শাওন বলেন, যেটা আমাকে মুগ্ধ করেছে, সেটা হল- পুরো গ্রামটি যেন একটি বড় পরিবারের মত, পুরো চীন দেশও যেন একটি বড় পরিবার।

চারজন বিদেশির চীনের গ্রামাঞ্চল সফর_fororder_tian2

শাওন ও রেবেকা যে কৃষকের বাসায় উঠেছেন, এই কৃষক পরিবারটি ছিল গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবার। দুই বছর আগে স্থানীয় ব্যাংক থেকে কয়েকটি ক্ষুদ্র ঋণ ও আত্মীয়দের কাছ থেকে কিছু অর্থ ধার নিয়ে তারা নিজেদের বাড়িঘর সুন্দরভাবে মেরামত করেন এবং বাড়ির একটি অংশ হোটেলের মতো করে তৈরি করে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া তারা গ্রামের বৈশিষ্ট্যময় কৃষিজাত দ্রব্যও বিক্রি করা শুরু করেছেন। এসব কাজ করে তারা সব ঋণ ফেরত দিয়েছেন। এখন তাদের জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে।

 

শাওন তাদের গল্প থেকে জানতে পারেন যে, স্থানীয় কৃষকরা পরস্পরকে সাহায্য করে এবং দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পর আরও সুন্দর জীবন গঠনে তারা সুন্দরভাবে চেষ্টা করছে।

 

বিদেশি অতিথি চি মিং কুও-এর মনে একজন তরুণ মানুষ গভীর ছাপ ফেলেছেন। এই তরুণ আগে শহরে কাজ করতেন, গ্রামের অবস্থা উন্নত হলে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং গ্রামের বয়স্কদের নিয়ে মৌমাছি লালন-পালন শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি দারিদ্র্যমুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। তাদের উত্পাদিত মধু চীনের একটি পেশাদার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদকও জয় করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিন চাই জেলায় ফিরে আসা তরুণ মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে। চি মিং কুও বলেন, তিনি জীবনে প্রথম এমন ভিন্ন ধরনের একটি ঘটনা শুনেছেন। শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসার একটা সুন্দর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, স্থানীয়রা বয়স্কদের সাহায্য করছে। যা খুব ভালো একটি ব্যাপার।

চারজন বিদেশির চীনের গ্রামাঞ্চল সফর_fororder_tian4

বিদেশি অতিথি উ চুন চিয়ে প্রতিবেশী গ্রামে একজন ‘ইন্টারনেট সেলিব্রিটি’ ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি আগে গ্রামের নিবন্ধিত দরিদ্র মানুষ ছিলেন, সরকারের ভর্তুকি ও সুবিধাজনক নীতির কল্যাণে তিনি অনলাইনে একটি কৃষিজাত দ্রব্যের দোকান খোলেন। ২০২০ সালে তাঁর বিক্রি করা পণ্যের পরিমাণ হয় ৫০ লাখ ইউয়ান। তার মুনাফা হয় ৫ লাখ ইউয়ান।

নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়- একটি ছোট পাহাড়ি গ্রাম, সড়ক, লজিস্টিক ও ইন্টারনেটের কল্যাণে পুরো চীনের সরবরাহ চেইনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। একজন সাধারণ কৃষক, শহরাঞ্চল থেকে এত বেশি ভক্ত ও ব্যবসার সুযোগ পেতে পারে।

 

সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপের সময় বিদেশি অতিথিরা একটি গ্রাম থেকে জেলা, তথা চীন ও বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। উ চুন চিয়ে বলেন, তা ওয়ান গ্রামের এসব নতুন বন্ধুর মুখের হাসি দেখা যায়, তিনি আবারও উপলব্ধি করেন যে, চীন সত্যি জনগণকে শীর্ষ স্থানে রেখেছে। অন্যান্য দেশে, দারিদ্র্যবিমোচন শুধু আর্থিক পর্যায়ে হয়ে থাকে। তবে চীনে, দারিদ্র্যমুক্তকরণ মানে জনগণকে নিয়ে দরিদ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

 

সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি চালু হওয়ার ৪০ বছরেরও বেশি সময়ে, চীনে ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনে চীনের অবদান ৭০ শতাংশেরও বেশি। অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর মানবজাতি ইতিহাসের বৃহত্তম ও সবচেয়ে  শক্তিশালী দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম আয়োজন করেছে চীন। ৮ বছর পর বর্তমান মানদণ্ড অনুযায়ী প্রায় ১০ কোটি গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, ৮৩২টি দরিদ্র জেলা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।

 

চীনা জনগণ দেশের রাজনৈতিক পার্টি ও সরকারকে বিশ্বাস করে, চীনে যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে, একজন বিদেশির চোখে এটি খুব বড় একটি ব্যাপার।

 

শাওন বলেন, যখন কিছু দেশের সরকার জনগণকে দারিদ্র্যবিমোচনের সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, অনেকেই মনে করে, তা শুধু নির্বাচনে জয়ের জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতি। কিন্তু চীনা জনগণ সরকারকে বিশ্বাস করে এবং সবাই অভিন্ন লক্ষ্যে চেষ্টা করছে।

 

চি কুও মিং আরো বলেন, কারণ এখানে, সরকারের উদ্যোগগুলো সবাই দেখতে পায়। যেমন দ্রুতগতির ট্রেন, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা, বাড়িঘর ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা।

রেবেকা বলেন, চীন সরকার সবসময় জনগণের কথা শোনে ও তাদের সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)