স্মরণীয় বরণীয় যারা (০৮/০১/২১)
2021-01-10 19:25:37

স্মরণীয় বরণীয় যারা (০৮/০১/২১)

 

গেল বছর চীনের হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছুটা হ্রাস পায়। ঠিক সে বছর কেন্দ্রীয় সরকার ও হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল সরকারের নীতিগত সমর্থনে অবকাঠামো ও সেবার মান উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়। চীনের এ অঞ্চলে আরও বেশি হংকংয়ের যুবকদের দেখা যায়। এসব যুবক শেনচেনের নদী পার হয়ে বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলে যাওয়া হংকং তরুণ-তরুণী। তারা বৈষয়িক কল্যাণ অর্জন করছে এবং উন্নয়নের সুযোগকে স্বাগত জানাচ্ছে।

 

১. হংকং ও কুয়াংতুংয়ে পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হংকংয়ের তরুণ ছেন ইয়ুং খাং বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের অনেক প্রশংসা করেছেন। এখন হংকং থেকে কুয়াংতুং প্রদেশের ফোশান শহরে যেতে খুব অল্প সময় লাগে; যা আগে কখনই কল্পনা করা যেত না।

 

২০০৫ সালে হংকংয়ে পোশাক ব্যবসা শুরু করেন ছেন। তখন ইন্টারনেটে ফোশান শহরে পোশাক ব্যবসায়ী একটি  মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। পরে তাদের দু’জনের ব্যবসা অনেক ভালো হয়। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও তৈরি হয়। অবশেষে দু’জন বিয়ে করেন। তারা ব্যবসায়িক অংশীদার থেকে একে অপরের জীবনের অংশীদার হয়ে ওঠেন।

 

পরে ছেন মূল ভূভাগে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চান, তাই স্ত্রীকে নিয়ে ফোশান শহরে যান। ছেন বলেন, আগে তাঁর ফোশানের বাসা থেকে হংকং যেতে আট ঘণ্টা সময় লাগত। পরে অনেক শাটল বাস চালু হয়। বাস স্টেশন ঠিক তাঁর ভবনের নিচে। পরে চীনের নানশা সেতু চালু হলে ফোশান থেকে হংকংয়ে যেতে মাত্র তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

 

দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণ বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চল গঠনের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছে। ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে দেশের উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন কুয়াংতুং-হংকং-ম্যাকাও বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের আন্তঃশহর রেলপথ নির্মাণ প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। ‘এক ঘণ্টার জীবনযাপনের সার্কেল’ বাস্তবায়নের চেষ্টায় সমর্থন জানায় কর্তৃপক্ষ।

 

২০২০ সালে অনেকগুলো অনির্দিষ্ট উপাদানের কারণে বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু হংকং-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এবং হংকংয়ের তরুণরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে, ধারাবাহিক সুবিধাজনক নীতি চালু হওয়ার পর তারা আরও ভালো এবং আরও সুবিধাজনক ব্যবসার পরিবেশ উপভোগ করতে পারে, তারা উন্নয়নের বড় সুযোগ পায়।

ফোশানের আইসিং স্মার্ট বিজ্ঞান কোম্পানির প্রধান, হংকংবাসী লিয়াং জি বিন বলেন, বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলে আস্তে আস্তে শিল্প চেইন তৈরি হচ্ছে এবং ব্যবসার পরিবেশের অনেক উন্নত হয়েছে।

কুয়াংতুং ও হংকংয়ের সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের ফলে বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলে মূল ভূভাগের বিভিন্ন স্তরের সরকারি সেবা আরও সুসংহত হয়েছে, সেবার মানও অনেক উন্নত হয়েছে। লিয়াং বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে, মূল ভূভাগ ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে অনেক গুরুত্ব দেয়, তা আমরা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারি।

 

২. গেল বছর হংকংয়ের তরুণ ওয়াং কুয়ান মো-এর কাছে খুব বিশেষ একটি সময়। তিনি মূলভূভাগের শেনচেন শহরের হেংলি শিল্প উদ্যানে কাজ করেন। এখন এই উদ্যান বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের নতুন শিল্প উদ্যানে পরিণত হয়েছে। ওয়াং বলেন, সরকার আমাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়, এই উদ্যানের উন্নয়নে সমর্থন দেয়। আমরা এজন্য খুব আনন্দ বোধ করি, আমরা আরও বেশি হাই-টেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবো।

 

২০২০ সাল হল ওয়াংয়ের শেনচেনে কাজ করার ১৩তম বছর। তিনি শেনচেনে পোশাক ব্যবসা করেন। শিল্প রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে ২০১৫ সালে তিনি একটি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্থাপন করেছেন। হেংলি শিল্প উদ্যান প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, নিরাপত্তা ও আইনি সেবা দিয়ে থাকে।

 

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়াংতুং-হংকং-ম্যাকাও বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনা চালু হয়। ওয়াং মনে করেন, এতে বিরাট সুযোগ রয়েছে। তাই তিনি বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি মূলভূভাগের হংকংয়ের তরুণদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এখন ওয়াং-এর পরিচালনায় শিল্প উদ্যানের আয়তন প্রায় ১.২ হাজার/লাখ বর্গমিটারে উন্নীত হয়েছে। ২০টিরও বেশি দেশ-বিদেশের বিখ্যাত হাই-টেক প্রতিষ্ঠান এ উদ্যানে কাজ করছে।

 

লিয়াং জি বিন মূল ভূভাগে কাজ করতেন। ওয়াং-এর তুলনায় তার কোম্পানি ছিল অনেক ছোট। ২০১৭ সালে বন্ধুর সাহায্যে তিনি ফোশান শহরে আসেন। তিনি একটি হাই-টেক কোম্পানির সিইও হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি নিজেই ফোশান শহরে একটি কোম্পানি চালুর সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি হাসতে হাসতে বলেন, শুরুতে আমার মনে হয়েছিল কোম্পানি চালু করা খুব সহজ কাজ। তবে, পরে তিনি বুঝতে পারেন, মূল ভূভাগের আইন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হংকংয়ের চেয়ে একেবারে ভিন্ন; তিনি একদিকে নিজেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, অন্যদিকে মূল ভূভাগের বিভিন্ন নীতি শিখতেন।

 

হংকংয়ের আরেক অধিবাসী ছেন ইয়ুং খাং মূল ভূভাগের একজন অন্যতম ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, তিনি আগে কোম্পানি খোলার কথা কখনই ভাবতেন না। পরে ফোশান শহরের হংকং, ম্যাকাও ও তাইওয়ানবাসীদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে অনেক সাহায্য করেছে। তাদের বিভিন্ন নীতিগত ও আইনগত সহযোগিতা করেছে। এর ফলে কোম্পানি চালু করা অনেক সহজ হয়েছে।

ভবিষ্যত সম্বন্ধে বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের হংকংয়ের মানুষরা নিজেদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন, করোনাভাইরাসের মহামারির পর বৃহৎ উপসাগরীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ আরও সুন্দর হবে।

 

হংকংবাসী ছেন মনে করেন, মূল ভূভাগ সম্বন্ধে হংকংয়ের তরুণ-তরুণীদের কিছু ভুল ধারণা আছে। তারা যদি মূল ভূভাগে না আসে, তাহলে মূল ভূভাগের উন্নয়নের গতি ভালোভাবে বুঝতে পারবে না।

হংকংবাসী লিয়াং জানান, হংকং ও ম্যাকাওয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য সুবিধাজনক। মূলভূভাগে আমাদের তৈরি পণ্য আরও দ্রুত ও আরও সুবিধাজনকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারছে। তাই, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাদের আস্থা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

 

এখন আমরা তাইওয়ান এক ব্যক্তি চিন ইয়ান হাও-এর গল্প বলবো।

সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য তাইওয়ানের ব্যক্তি চিন ইয়ান হাও কুয়াংচৌ থেকে উহান শহরে ফিরে যান। তিনি ঠাট্টা করতে বেশ পছন্দ করেন। সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি ঠাট্টা করে বলেন, মহামারির সময় যদি হাসপাতালের চিকিৎসক আমাকে উদ্ধার না-করত, তাহলে আজকের এই সাক্ষাৎকার আর হতো না। চলুন শুনি তার গল্প।

 

চিন ইয়ান হাও তাইওয়ানের তাইপেই শহরের মানুষ, তাঁর বয়স ৫২ বছর। মূল ভূভাগে তিনি ২১ বছর ধরে আছেন। বর্তমানে তিনি কুয়াংচৌয়ে দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ব্যবসা করেন। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা উহানে থাকেন।

তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগী ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। গত বছরের কথা স্মরণ করে চিন বলেন, তিনি এখন আর আগের মত উদ্বিগ্ন না। কৃতজ্ঞতা হল তাঁর সবচেয়ে গভীর অনুভূতি ও উপলব্ধি।

চিন বলেন, অনেক মানুষের সহযোগিতায় তিনি তার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। তিনি এজন্য সবার প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করেন।

 

গত বছরের ৩০ জানুয়ারি তার জ্বর ছিল। তিনি বলেন, তখন আমি গুরুতর অসুস্থ ছিলাম, ভীষণ জ্বরে মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।

চিন বলেন, তখন আমি ভীষণ দুর্বল ও অসহায় ছিলাম। আমি জানতাম না, আগামীকাল আর দেখতে পাব কিনা। তখন শুধু একটি কাজই করার ছিল। তা হলো সাহায্য খোঁজা। এসময় সাহায্য আসে- যা তিনি কল্পনা করতে পারেন নি। হুপেই প্রদেশ ও উহান শহরের তাইওয়ান কার্যালয় তাঁর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে দ্রুত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিভিন্ন পক্ষের সমন্বয়ে তিনি উহান শহরের সিয়ে হো হাসপাতালে ভর্তি হন।

তখন চিনের মহামারি পরিস্থিতি ছিল ভয়ংকর। তাঁর চিকিত্সক চাং ইয়ুং বলেন, যদি দুই দিন দেরিতে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হতো, তাহলে আর মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করা যেত না।

 

চিন বলেন, তখন উহানে করোনাভাইরাসের রোগী অনেক বেশি ছিল। অবস্থাও ছিল খুব জটিল। এত কঠিন অবস্থার পরও তাঁরা আমার জন্য হাসপাতালে একটি বিছানার ব্যবস্থা করে, আমাকে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। প্রতিবার আমি একথা স্মরণ করি এবং আমার হৃদয় উষ্ণ হয়ে ওঠে।

 

 

আরও ভয়াবহ ব্যাপার হল, যখন চিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর ১০ বছরের ছেলেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয় তখন। তাঁর পরিবার চারটি আলাদা স্থানে কোয়ারেন্টিনে আটকা পড়ে। চিনের স্ত্রী উ লিং বলেন, তখন আমাদের পরিবারের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে পড়ে। তখন আমাদের কমিউনিটি আমাদের অনেক সাহায্য করে। তারা চিনের পরিবারকে দৈনন্দিন সামগ্রী এনে দিয়েছিল। কোয়ারেন্টিনের সময় তথ্যগত সেবা দিয়েছিল, মানসিক সাহায্যও করেছিল। চিন বলেন, স্ত্রীর মানসিক সমর্থন, কমিউনিটির যত্ন এবং চিকিৎসকের সাহায্যে তাঁরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। চিন বলেন, কেউ অন্যকে সাহায্য করার জন্য বাধ্য না। তারপরও তারা সবাই আমাদেরকে সাহায্য করেছে। এখন আমরাও তাদের মতো অন্যকে সাহায্য করবো।

 

২০২০ সালের ২০ মার্চ চিন হাসপাতাল থেকে বের হন। এর এক মাস পর চিন ও তাঁর স্ত্রী উহান রক্ত কেন্দ্রে এসে রক্তের প্লাজমা দান করেন। চিন বলেন, সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি যে, সুস্থ হওয়া রোগীর রক্তের প্লাজমা করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় সহায়ক। তাই, যদি আমার রক্ত অন্যকে সাহায্য করতে পারে, তাহলে আমি আমার রক্ত দান করবো।

 

করোনাভাইরাসের মহামারি মানবজাতির জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এ রোগ মানুষকে চিন্তা করার সুযোগও দিয়েছে। চিন বলেন, আগে তিনি সবসময় টাকা উপার্জনের জন্য ব্যস্ত থাকতেন। তবে, জীবনের গুরুত্ব কখনই উপলব্ধি করেন নি। তিনি হাসপাতালে থাকার সময় অনেকে মৃত্যুর কথা শুনেছেন। বেঁচে থাকা ও মৃত্যুর পার্থক্য তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি বুঝেছেন যে বর্তমান মুহূর্তকে গুরুত্ব দিতে হয়।

 

মহামারির সময় ছেলেমেয়ের আরও বেশি কাছে থাকার সুযোগ পেয়েছেন চিন। পরিবারের সবাই একসাথে কেক তৈরি করেছেন, রান্না করেছেন, বই পড়েছেন। এতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

চিন বলেন, নিজের জীবন আগের চেয়ে আরও প্রশান্ত হয়েছে, স্বাস্থ্যের ওপর আরও গুরুতারোপ করেছেন তিনি। এখন পরিবারের সবাই সুস্থ আছে- এটি অনেক প্রশান্তির বিষয়।

 

২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল, উহানে শত দিন আটকে থাকা চিন আবারও কুয়াংচৌ শহরে ফিরে যান। তাঁর দুই ছেলেমেয়েও স্কুলে যাতায়াত শুরু করে; জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

 

মূল ভূভাগে আসার ২১ বছরে চিন শাংহাই, ছেংতু, উহানসহ অনেক শহর দেখেছেন। এরমধ্যে মূল ভূভাগের উন্নয়ন তাঁকে অনেক অবাক করেছে। মূল ভূভাগের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহামারি প্রতিরোধ করেছে। এ বিষয়টি তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেন, তাইওয়ান প্রণালীর দু’তীরের মানুষ আসলে একই পরিবারের সদস্য। সাধারণ মানুষ আশা করে, দু’তীরের লোকজন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারবে।