২০২১ সালের নিউ-নরমাল বাংলাদেশ : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
2021-01-03 19:53:05

করোনার দুঃসহ স্মৃতিতে মোড়ানে ছিল বিগত বছরটি। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষকে ঘিরে ছিল অভাবিত এক আতঙ্ক, ঘরবন্দি জীবন, স্বজনহারা মানুষের হাহাকার; আর শেষ বিদায়েও প্রিয়জনকে একটু স্পর্শ করতে না পারার বেদনাবিধুর বহু আখ্যান। এমন অভূতপূর্ব একটা পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার মতো দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশের মানুষ। এর বিপরীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে- এমন ঘটনাও বিরল ছিল না। 
করোনার থাবা দেশে প্রথম আঘাত হানে গেল বছররে ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। এরপরের চিত্র বাংলাদেশের মানুষ আগে আর দেখেনি। দেরিতে হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে মতো শুরু হয় লকডাউন। ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয় হয়। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যানবাহন চলাচলে। রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাট হয়ে পড়ে ফাঁকা, জনমানবহীন। দেশের ১৭ কোটি মানুষ কার্যত ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। লকডাউন কার্যকরে মাঠে নামে সেনাবাহিনীও। 
কোথাও কোনো রোগী শনাক্ত হলেই ওই এলাকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। একের পর এক মৃত্যুর মিছিল। করোনায় স্বজনের মৃত্যুশয্যায় পাশে না থাকতে পারা, মৃত স্বজনকে শেষ দেখা দেখতে না পারা, তার শেষযাত্রায় থাকতে না পারাটা কতটা বেদনাদায়ক- তা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন। করোনা সন্দেহে নিজের মাকে জঙ্গলে রেখে আসার মর্মান্তিক খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।
অদৃশ্য এক ভাইরাসের ছোবলে গোটা জাতি যখন দিশেহারা, সেই সময়ে নকল মাস্ক সরবরাহ, রিজেন্ট হাসপাতাল ও জিকেজি হেলথকেয়ারের ভুয়া করোনা সনদ, জালিয়াতি-প্রতারণা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগকে নাড়িয়ে দেয়। প্রশ্নের মুখে পড়ে গোটা স্বাস্থ্যখাত। করোনা মহামারি প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়হীনতা, চিকিৎসকদের জন্য সরবরাহ করা মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর নিম্নমানও প্রশ্নের জন্ম দেয়। 
এমন ঘটনা বিদেশি গণমাধ্যমেও চলে যায়, প্রশ্নবিদ্ধ হয় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। ইতালিসহ অনেক দেশে বাংলাদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে মহাপরিচালকসহ ব্যাপক রদবদল আনা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। পরবর্তীতে অবশ্য করোনা মোকাবেলায় অব্যবস্থাপনা কিছুটা সামলে ওঠে স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়।
বছরজুড়ে করোনা আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা হয়ে পড়ে বিপন্ন। চাকরি-বাকরি, আয়-উপার্জন হারিয়ে একরকম পথে বসেন অনেক মানুষ। রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে দেখা গেছে বহু পরিবারকে। চাকরি রক্ষা করতে লকডাউনে করোনা-ঝুঁকি নিয়ে শতশত মাইল পায়ে হেটে রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে কাজে যোগ দিতে হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের। রেমিটেন্স যোদ্ধাখ্যাত বহু প্রবাসী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ছুটিতে আসা অনেকে কর্মস্থলে ফিরে যেতে বিমানের টিকিট না পেয়ে পড়েন সীমাহীন বিড়ম্বনায়। অসহায় দুঃস্থদের জন্য বরাদ্দ সরকারি ত্রাণ নিয়েও হয়েছে নয়-ছয়। 
করোনায় বিশ্বের সব দেশের মতোই কমেছে বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি। বিদেশি বিনিয়োগেও সঙ্গতকারণেই নেই তেমন সুখবর। বছরের একেবারে শেষভাগে এসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে উগ্রমৌলবাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাও ভাবিয়েছে দেশের মানুষকে। 
করোনা মহামারির এ কঠিন সময়ে ইতিবাচক কিছু বিষয়ও দেখেছে বাংলাদেশ। করোনার শুরুতেই বাংলাদেশ সুরক্ষা সামগ্রী ও ওষুধ পাঠিয়ে পাশে দাঁড়ায় বন্ধুরাষ্ট্র চীনের। বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ দেখা দিলে বরাবরের মতোই পাশে দাঁড়িয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র চীন। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দেন পাশে থাকার। সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল পাঠিয়ে করোনা মোকাবেলায় সহায়তা দিয়েছে চীন। 
করোনার দমবদ্ধ অবস্থার মধ্যেই স্বপ্নের পদ্মাসেতু পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান হওয়াটা ছিল বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার বুকে দাঁড়ানো এ সেতু বিশ্বের বুকে বাংলদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রতীক। এখানেও কারিগরিসহ সর্বাত্মক সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে পরীক্ষিত বন্ধু চীন।
করোনা-কারণে বিশ্বের বহুদেশই অর্থনৈতিক মন্দাদশায় পড়েছে। বাংলাদেশও এর প্রভাব পড়লেও বিপর্যয়ে পড়েনি বাংলাদেশের অর্থনীতি। সরকারে একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজে সামলে ওঠে দেশের অর্থনীতি। আইএমএফের প্রতিবেদনে জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেলার পূর্বাভাসও স্বস্তি দিয়েছে দেশের মানুষকে। এ ছাড়া বিকাশমান অর্থনীতির ধারা ধরে রাখতে পারলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে- ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থার পূর্বাভাসও ছিল আশা জাগানিয়া। 
গলে বছরে টানা ৬৬ দিনের লকডাউনের পর দেশে বর্তমানে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন বিরাজ করছে। করোনা টিকা প্রাপ্তিতে সুখবর থাকলেও কবে এর করাল গ্রাস থেকে জাতি মুক্তি পাবে তা যদিও অনিশ্চিত। 
একুশ সালের নিউ-নরমাল বাংলাদেশের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। রেমিটেন্স প্রবাহ ধরে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমানো, কল্যাণমূলক অর্থনীতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোসহ নতুন বছরে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগুতে হবে বাংলাদেশকে। 
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।