বিস্ফোরক-সংবেদনশীল উপকরণের গবেষক ও শিক্ষাবিদ ফাং ইয়ু’র গল্প
2021-12-27 16:37:39

চীনের শাআনসি নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফাং ইয়ু অন্যদের চোখে একটু অন্যরকমের মানুষ। তিনি মনোযোগ দিয়ে গবেষণাকাজ করেন। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির শিক্ষাবিদ নির্বাচিত হলেও, শিক্ষকতা পেশার ওপর তাঁর গুরুত্ব এতোটুকু কমেনি। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নেন এবং মাইন ক্লিয়ারিং, সন্ত্রাসদমন, বিস্ফোরক-সংবেদনশীল উপকরণ নিয়ে কাজ ও গবেষণা করেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি যেসব গবেষণাকাজ করছেন, সেগুলোর সবই বিপজ্জনক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় তাঁর প্রচুর আগ্রহও রয়েছে। আজকের আসরে শিক্ষাবিদ ফাং ইয়ু’র গল্প তুলে ধরবো আপনাদের সামনে।

 

অধ্যাপক ফাং ইয়ু উচ্চ সংবেদনশীল বিস্ফোরক নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। স্মার্ট কুকুর তার নাক নিয়ে গন্ধ শুঁকে বিপজ্জনক উপাদান বা মাদকদ্রব্য অনুসন্ধান করে থাকে। আর অধ্যাপক ফাং ইয়ু বিভিন্ন সেন্সর নিয়ে গবেষণা করেন, যেগুলো দিয়ে বিপজ্জনক বিস্ফোরকদ্রব্য চিহ্নিত করা যায়।

 

সেন্সর প্রযুক্তির মানদন্ড অত্যন্ত কঠোর ও উচ্চ হতে হয়। চীনের ৭০ শতাংশ বেসরকারি সেন্সর বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অধ্যাপক ফাং বলেন, গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম এ ধরনের সেন্সর-প্রযুক্তি আবিষ্কার করে এবং এর  একচেটিয়া ব্যবসা করতে থাকে। সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেয়। একটি এক কেজির চেয়ে কম ওজনের সেন্সর সরঞ্জামের মূল্য তখন দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ইউয়ানে। তবে চীনে উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন নিরাপত্তাব্যবস্থার চাহিদা বাড়তে থাকে। রেলপথ, বিমানবন্দর, আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের আয়োজনস্থলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘স্মার্ট কুকুরের নাক’ শীর্ষক অনুসন্ধানকারী সরঞ্জামের দাম অনেক বেশি ছিল এবং এর মানও খুব একটা ভালো ছিল না। এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৯৯৮ সাল থেকে ফাং ইয়ু চীনের নিজস্ব সেন্সর তৈরির গবেষণা শুরু করেন।

 

গবেষণার জন্য কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। এ কাজে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ১৯৯৮ সালে বিদেশ থেকে শানআনসি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন অধ্যাপক ফাং। তখনকার পরীক্ষাগারের অবস্থা ছিল অনেক দুর্বল। অনেক ছাত্রছাত্রীর মনে আছে, তখন শিক্ষক ফাং পরীক্ষাগারে সবসময় ব্যস্ত সময় কাটাতেন। রাত ১০টা পর্যন্তও তার পরীক্ষাগারে আলো দেখা যেতো। প্রতিবছরের বসন্ত উত্সবের সময়ও তাঁর স্ত্রী পরীক্ষাগারে এসে ফাংকে ডেকে বাড়িতে ফিরতেন। তবে একদিন পরই তিনি আবার পরীক্ষাগারে ফিরে যেতেন। অধ্যাপক ফাংয়ের দৃষ্টিতে সেটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ, তিনি জানতেন পরীক্ষাগারে অধ্যাপক হিসেবে তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি সময় দিতে হবে এবং গবেষণার কাজ ধাপে ধাপে শেষ করতে হবে। আবার এ কাজে ভুল হওয়াও চলবে না। তাই তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে যেতেন।

 

অধ্যাপক ফাং ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ফ্লুরোসেন্স সনাক্তকরণ প্রযুক্তির গবেষণা করেন। এমন পরীক্ষায় অদ্ভুত সব গন্ধ নিয়ে কাজ করতে হয়। তিনি দুগর্ন্ধযুক্ত মোজা ও পচা আপেলসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে গবেষণা করেন।

 

২০১০ সালে অধ্যাপক ফাং ইয়ু শানআনসি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি অন্যান্য শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ ছেড়ে দেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি এখান থেকে চলে গেলে, সেন্সর নিয়ে গবেষণাকাজ বন্ধ হয়ে যাবে।” ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্টপদ ছেড়ে দেন এবং আরো বেশি সময় গবেষণার কাজে দিতে থাকেন। “আমি যত বেশি সময় গবেষণাকাজে ব্যয় করব, তত দ্রুত কাজ শেষ হবে।” অধ্যাপক ফাং এমন কথা বলছিলেন। ২০১৪ সালে তাঁর গবেষকদলের যৌথ প্রয়াসে লুকানো অতি-সংবেদনশীল বিস্ফোরক সনাক্তকরণ সরঞ্জাম (Hidden explosives ultra-sensitive detection equipment) আবিষ্কৃত হয়। এ নতুন সরঞ্জাম বিদেশে তৈরি সরঞ্জামের চেয়ে আরও উন্নত ছিল।

 

এরপর জি-টোয়েন্টি শীর্ষসম্মেলন, বোয়াও ফোরাম, শাংহাই আমদানি মেলা এবং চীনের হংকং-ম্যাকাও-চুহাই সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে অধ্যাপক ফাং’র দলের আবিষ্কৃত সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। তার তৈরি সেন্সরের দামও তুলনামূলকভাবে কম। অথচ এটি তুলনামূলকভাবে বেশী কার্যকর।

 

কিন্তু গবেষণায় সাফল্য অর্জিত হলেও, গবেষকদল বসে থাকেনি। আরও উচ্চমানের সরঞ্জাম তৈরির কাজে তারা আত্মনিয়োগ করে। বহুমুখী তথ্য সংগ্রহ করে মাদকদ্রব্যকে আলাদাভাবে সনাক্তকরণের যন্ত্র আবিষ্কারে মনোযোগ দেন তারা। তারা ধারাবাহিক ফ্লুরোসেন্স সংবেদনশীল ফিল্ম উপাদান নিয়ে গবেষণা করেন, যা ভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যের বাষ্প বা কণা শনাক্ত করতে সক্ষম। বর্তমানে মাত্র ৪৫০ গ্রাম ওজনের মাদকদ্রব্য-সেন্সর চীনে মাদকদ্রব্য প্রতিরোধক কাজে ব্যবহৃত হয়। পুলিশ সন্দেহযুক্ত ব্যাগ না-খুলেই এ সরঞ্জাম ব্যবহার করে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে মাদকদ্রব্য আছে কি নেই—তা নিশ্চিত হতে পারেন।

 

আসলে, এমন প্রযুক্তি কেবল নিরাপত্তা খাতে ব্যবহার করা হয় তা নয়, বরং ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত করতেও কাজে লাগে। কেন এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন তিনি? এ সম্পর্কে অধ্যাপক ফাং বলেন, “চীনের সুবিখ্যাত বিজ্ঞানী হুয়াং খুন ১৯৪৭ সালে পদার্থবিদ ইয়াং চেন নিংকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে হুয়াং লিখেন, যদিও আমরা কেবল গবেষকের কাজ করি, তবে মাতৃভূমি ফিরে না-ফেরার কারণে মনে দুঃখ পাই। কারণ, চীনের উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টা প্রয়োজন।” বলা বাহুল্য, জনাব হুয়াং’র কথা অধ্যাপক ফাং’র মনে গভীর দাগ কাটে। ১৯৯২ সালে ৩৬ বছর বয়সে ফাং নিজের খরচে বিদেশে পড়াশোনা করতে যান। ৬ বছর লেখাপড়া করে স্নাতক হওয়ার পর তিনি চীনে ফিরে আসেন। তিনি ব্রিটেনে নাবিক হিসেবে চাকরি করেছেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অপমানও সহ্য করেছেন। কিন্তু  মাতৃভূমির শক্তিশালী উন্নয়ন নিয়ে তিনি বরাবরই ছিলেন আশাবাদী। তিনি অবশেষে স্বদেশে ফিরে আসেন। তিনি নিজে দেশের উন্নয়নে কিছু অবদান রাখতে চেয়েছিলেন।

 

আবার শানআনসি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন তিনি। তবে, স্থানীয় জীবনমান ব্রিটেনের তুলনায় খারাপ ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার বরাদ্দও অনেক কম ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ফাং তাঁর গবেষকদল নিয়ে ২০ বছরের গবেষণা করে চীনের নিজস্ব অতি-সংবেদনশীল বিস্ফোরক সনাক্তকরণ সরঞ্জাম তৈরি করেন। এ সরঞ্জাম নিরাপত্তাব্যবস্থা ও মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে ভুমিকা পালন করতে থাকে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, খাদ্যদ্রব্যের নিরাপত্তা, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং রোগ শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়ে আসছে।

 

ফুসফুসএর ক্যান্সারের উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, এ সরঞ্জাম দিয়ে ফুসফুসের প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়।  সেন্সর উপাদান নবায়ন আর ফিল্ম কাঠামো উন্নত করার মাধ্যমে এ রোগ এখন আরও দ্রুত শনাক্ত করা যায়।

 

নিজেদের গবেষণাকাজ নিয়ে অধ্যাপক ফাং বলেন, রাসায়নিক বিভাগের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে তা দেশের উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাপনে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম।

 

চীনাদের একটি কথা সুপরিচিত, সেটা হলো: ‘ব্যর্থতা হবে সাফল্যের মা।’ মাঝে মাঝে ব্যর্থতা সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে।  একবার ডক্টরেট ছাত্রী পেং জুন সিয়া পরীক্ষাগারে দুটি উপাদান আলাদা করতে পারছিলেন না। অধ্যাপক ফাং এ পরীক্ষার কার্যক্রম দেখে বুঝতে পারেন যে, এ গবেষণা সফল হলে একটি নতুন প্রযুক্তি পাওয়া যাবে, যা দিয়ে চীনের সংশ্লিষ্ট কাঁচামালের অভাবের সমাধান করা যাবে!

 

এ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তারা আরো বেশি গভীর গবেষণা করেন এবং বিশ্বের প্রথম ছোট অণু জেলিং এজেন্ট ইমালসন তৈরি করেন। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে চীনের মহাশূন্য খাতের কাঁচামালের অভাব দূর হয়। অধ্যাপক ফাং’র পরামর্শ ও সাহায্যে প্রতিটি ব্যর্থ পরীক্ষা নতুন গবেষণার সূচনায় পরিণত হয়। কয়েকটি ব্যর্থতার বাধা কাটিয়ে চীনের মহাশূন্য, বিমানচালনা, গভীর সমুদ্র ও গাড়ি প্রক্রিয়াকরণসহ বিভিন্ন খাতের কাঁচামালের অভাবের সমস্যা সমাধান করা হয়। এ সম্পর্কে ছাত্রী পেং বলেন, “অধ্যাপক ফাং না থাকলে আমরা হয়তো খুব দ্রুত গবেষণাকাজ পরিত্যাগ করতাম। কিন্তু আমরা তার অনুপ্রেরণায় প্রতিদিন পরীক্ষাগারে কাজ করতে থাকি। তবে, একসময় গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে ভুলেও যাই। এ সময় অধ্যাপক ফাং’র নির্দেশনা ও প্রস্তাব আমাদের উদ্দীপিত করতো। এভাবে আমাদের গবেষণাকাজ সঠিক পথে সামনে এগিয়ে যায় এবং দেশ ও সমাজের চাহিদাও মেটাতে পারে।”

 

অধ্যাপক ফাং’র পরীক্ষাগারের দেয়ালে চীনের ‘স্মার্ট নির্মাণ, ২০২৫’ রোডম্যাপ শোভা পাচ্ছে। এ রোডম্যাপের লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নে প্রতিদিন ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক ফাং। ১৯৫৬ সালে ফাং ইয়ু চীনের শানআনসি প্রদেশের লিনথুং শহরের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে তিনি গরীব গ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন। শিক্ষাদান কতো গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষকতার তাত্পর্য কী—তা তিনি সহজে বুঝতে পারেন।

 

১৯৭৪ সালে চমত্কার স্কোর পেয়ে তিনি উচ্চবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং জন্মস্থানের একটি স্কুলে বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৭৭ সালে কাওখাও পরীক্ষা পুনরুদ্ধারের পর তিনি শানআনসি নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকে পরিণত হন। অনেক ছাত্রছাত্রীর দৃষ্টিতে অধ্যাপক ফাং অনেক সেরা শিক্ষক, যিনি মানুষের শিক্ষিত হবার ওপর অতি গুরুত্ব দেন। পেশাগত গবেষণায় ফাং’র মানদন্ড বেশ কঠোর। যে কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করতে হবেই। ছাত্রী পেং অধ্যাপক ফাংয়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “আমি গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। কখনো ভাবিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করতে পারব। সেটি অধ্যাপক ফাংয়ের সাহায্যে সম্ভব হয়েছে।” তাঁর সুপারিশে ছাত্রী পেং ফরাসি নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর সাহায্যে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক ফাং বলেন, “আমার অনেক ছাত্রছাত্রী গ্রামাঞ্চলের। তবে কঠোর ও পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারাও বিশ্বের শীর্ষ পরীক্ষাগারে ঢুকতে পারছে। গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। আমি শিক্ষক হিসেবে, তাদের উত্সাহ দেওয়া ও তাদের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা দেই, যাতে তারা স্নাতক হওয়ার পর নিজেদের পরিবার, জাতি ও দেশের জন্য আরো বেশি ভুমিকা রাখতে পারে। এটিই আমার চাওয়া।”

 

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)