বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ জুতার চাহিদা মেটায় পান্ডা স্যু!
2021-12-24 18:48:37

বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ জুতার চাহিদা মেটায় পান্ডা স্যু!

সাজিদ রাজু, ঢাকা: দুনিয়াজোড়া বিনিয়োগ ও পণ্য উৎপাদনে চীনের জুড়ি নেই। বিশ্বের নানা দেশে চীনা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নজিরও নতুন নয়। এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের পান্ডা স্যু ইন্ডাস্ট্রি। রাজধানী ঢাকার অদূরে সাড়ে ৬ একর জমির ওপর গড়ে তোলা এই কারখানায় বছরে তৈরি হয় বছরে অন্তত ৪৫ লাখ জুতা। দেশের মোট চাহিদার এক বিরাট অংশ পূরণ করে এই কারখানায় উৎপাদিত জুতা।

 


সারি করে সাজানো আধুনিক ডিজাইনের জুতা যেন সৃজনশীলতা ও রুচিশীলতার প্রকাশ। কেবল পায়ের সুরক্ষায় নয়, হাল ফ্যাশনের অন্যতম অনুসঙ্গ নানা রং ও ডিজাইনের জুতা। পরিপাটি পোশাকের সঙ্গে মানানসই জুতা যেন ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ।

 

প্রশ্ন হতে পারে, উন্নত ও নজরকাড়া এসব জুতা কি আমদানি হয় দেশে? আধুনিক ডিজাইনের এসব জুতা এখন তৈরি হয় বাংলাদেশেই। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে টেকসই ও নান্দনিক এসব জুতা দেশের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে।

 

 

গাজিপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় গড়ে তোলা পান্ডা সু ইন্ডাস্ট্রিজে ভোর থেকেই চোখে পড়বে শ্রমিকদের পদচারণা। কারখানাটিতে কর্মরত প্রায় সবাই স্থানীয়।

 

“আমাদের এই মাজুখাতে চায়না ফ্যাক্টরিটা হওয়ার কারণে বেকার মহিলা-পুরুষ তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এখানে চাকরি করে আমরা পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারছে এবং আমাদের সংসারের উন্নতি হচ্ছে।”

 

বিশেষ করে ২ হাজার শ্রমিকের ১৩শ’ই নারী। আর উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিক থেকে সব পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রচেষ্টা বিকাশ ঘটাচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতির। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে অনুসরণ করা হয় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি।

 

“প্রথম যখন এ কারখানায় যোগ দেই তখন হেল্পার ছিলাম। হেল্পার থেকে আমি ৩ মাসের মধ্যে অপারেটর হয়েছি। এরপর আমি এখন সুপারভাইজার। সব মিলিয়ে ৮ বছরের অভিজ্ঞতা আমার। পান্ডা স্যু আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।”

 

২০১১ সালে স্থাপন করা কারখানাটিতে বছরে ৪৫ লাখ জুতা তৈরি হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব জুতা যেমন টেকসই তেমনি দামও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। কেননা, চীন থেকে আনা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সন্নিবেশ করা হয়েছে এখানে। বিশেষ করে ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আউটসোল ফ্লেক্সিং, থার্মাল বন্ডিং মেশিন, ল্যামিনেশন ও অ্যাম্ব্রয়ডারি মেশিনসহ সব ধরনের প্রযুক্তির দেখা মিলবে এখানে।

“জুতার অবয়ব তৈরির আগেই ভাবা হয় নকশার কথা। মানুষের রুচি ও মনোভাব বুঝে পছন্দের জুতার ডিজাইন তৈরি করেন শিল্পীরা। আর সেই শিল্পকর্মের প্রস্ফুটিত প্রতিচ্ছবি রুচিশীল মানুষের ব্যবহার করা জুতার নান্দনিকতা।”

 

 

জুতার স্যোল বন্ডিং, সুইং ও পুল ফোর্স পরীক্ষার মতো ধাপের পর তৈরি হয় আধুনিক স্মার্ট জুতা। এরপর সব শেষ ফিতা বেধে বিশেষ মোড়কে সাইজ অনুযায়ী চলে যায় বাজারে। শ্রমিকরা জানান, বেশিরভাগ কাজ যেহেতু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে করা হয় তাই নেই কঠোর পরিশ্রম। তবে মান নিয়ন্ত্রণে আছে কড়া নজরদারি আর সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ।

“প্রত্যেকটা মাল চিহ্ন দিয়ে কাজ করি। প্রত্যেকটা প্রক্রিয়ারই একটা চিহ্ন আছে, এই চিহ্নের বাইরে আমরা কাজ করি না। প্রত্যেকটা অপারেটরবে বুঝানো আছে যে এই নিয়ম মেনে কাজ করবেন। এর বাইরে যাওয়া যাবে না। প্রত্যেকটা পদক্ষেপেই চেক করা হয়। চেক করে করে একের পর এক ধাপ পার হয়। সর্বশেষ ধাপে কোয়ালিটি কন্ট্রোল পরীক্ষা করে দেখে। এভাবে ভালো পণ্যটাই আমরা ছাড়ি। যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়, সাথে সাথে আমরা সেটাকে আটকে দেই।”

উৎপাদিত জুতা দেখতে আকর্ষনীয় করতে ব্যবহার করা হয় চকচকে উপাদান। বিবেচনায় নেয়া হয় শীত-বর্ষা ঋতুভেদে ব্যবহারকারীদের আরামের কথা। বিশেষ করে স্নিকার, স্লিপার ও স্যান্ডেল তৈরি হয় অফিসগামী ও শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে। আছে পণ্য পরিবর্তনের শিথিল নীতি।

 

 

 

এতে সুনামের পাশপাশি এসেছে ব্যবসায়ীক সফলতাও। এরইমধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ মেটায় পান্ডা স্যু’জ। পাশাপাশি বছরে বাংলাদেশ সরকারকে পরিশোধ করে ২ কোটি টাকার কর্পোরেট কর। তবে কেবল ব্যবসা নয়, পরিবেশ ও স্থানীয়দের প্রয়োজনের কথাও মাথায় রাখে প্রতিষ্ঠানটি।

“জুতা তৈরির ধাপে ধাপে কিছু অবর্জনা জমা হয় প্রতিদিনই। তবে আবর্জনা যেন পরিবেশের কোন ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য আছে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। কারখানার ময়লা পানি পাঠানো হয় এই ইটিপিতে। এখানে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করা হয়। তাই এটি সুনাম অর্জন করেছে পরিবেশ বান্ধব কারখানা হিসেবে।”

ইটিপিতে বর্জ্যমেশানো পানি ছাড়া হলে তা পরিশোধন হয়ে বের হয় একেবারে স্বচ্ছ আর বিশুদ্ধ হয়ে। পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে কারখানার আশপাশে রোপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানীয় এলাকায় প্রতি বছর বিভিন্ন প্রজাতির ৫শতাধিক বৃক্ষ রোপনের কর্মসূচি পালন করে তারা। আছে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের সোলার প্যানেল। পরিবেশ ও উৎপাদনের এক ভারসাম্যপূর্ণ নজির স্থাপন করেছে যেন এই কারখানাটি।