‘আকাশে পথ’ তৈরি করা মানুষ মাও সিয়াং লিন
2021-12-24 15:59:46

ছুংছিং শহরের সিয়া চুয়াং গ্রামের চার পাশেই হাজার মিটার উঁচু পাহাড়।

সিয়া চুয়াং গ্রামকে ‘থিয়ানখেং’ বলা হয়, এর অর্থ ‘আকাশের খাদ’। অতীতে, চার পাশে খাড়া উঁচু দুর্গম পর্বতশ্রেণী ছিল। খাড়া দেয়ালের মতো। এসব খাড়া পাহাড় সিয়া চুয়াংয়ের মানুষকে সেখানে আটকে রেখেছিল। প্রায় চারশ’ গ্রামবাসীদের মধ্যে অর্ধেকই কখনও পাহাড় থেকে বের হন নি!

 

এমন কঠোর অবস্থায় সিয়া চুয়াং গ্রামের সিপিসি শাখা সম্পাদক মাও সিয়াং লিন গ্রামবাসীদের নিয়ে খাড়া উঁচু পাহাড়ে বাইরে যাওয়ার এক পথ নির্মাণ করেন। মাও সিয়াং লিন কে? এই পথ কেন তৈরি করতে হলো? তারা কীভাবে খাড়া উঁচু পাহাড়ে এই পথ তৈরি করেছেন? আজকে এই মনোমুগ্ধকর গল্প আপনাদেরকে জানাবো।

 

মাও সিয়াং লি সাংবাদিককে জানান, ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে ছিল, গ্রামবাসীরা কঠোর পাহাড়ি অবস্থার কারণে ২০ জনেরও বেশি লোক বাইরে যাওয়ার পথে পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। কিছু কিছু অসুস্থ মানুষকে বাইরে পাঠানোর সময় পথেই মারা গেছেন। গ্রামের মেয়েরা নিজ গ্রামের ছেলেদের বিয়ে করতে চাইতো না, বাইরের মেয়েরা এই গ্রামে আসতেও চাইতো না। তখন তাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৩শ’ ইউয়ানেরও কম।

 

১৯৯৭ সালে মাও সিয়াং লিনকে গ্রামের সিপিসি’র শাখা সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তিনি পাহাড় থেকে বের হওয়ার জন্য এক সড়ক তৈরি করার প্রস্তাব দেন।

গ্রামবাসীদের সম্মেলনে তিনি সবাইকে উত্সাহ দিয়ে বলেন: সবাই সারা জীবন গরীব হয়ে থাকবে না। এক ইঞ্চি খনন করলে পাহাড় এক ইঞ্চি ছোট হয়ে যায়, এক ইঞ্চি পথ তৈরি করলে এক ইঞ্চি আশা তৈরি হয়। এই প্রজন্মের মানুষ কাজ শেষ করতে না পারলে পরবর্তী বংশধররা এই কাজ এগিয়ে নেবে। হাত দিয়ে একটি পথ গড়ে তোলা যায়। সম্মেলনে মাও সিয়াং লিন সবার আগে প্রতিশ্রুতি পত্রে তার নাম লেখন। তিনি লেখেন, সড়ক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কখনওই চেষ্টা বন্ধ করবো না।

১৯৯৭ সালের শীতকালে গ্রামবাসীরা আনুষ্ঠানিকভাবে সড়ক নির্মাণকাজ শুরু করে। আসলে সড়ক নির্মাণের কাজ ছিল কল্পনার চেয়েও অনেক কঠিন। চারদিকে উঁচু পাহাড়, পা রাখার কোনো জায়গা নেই। যাদের সাহস বেশি, তারা কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলে ঝুলে, কয়েকশ’ মিটার উঁচু পাহাড়ে বিস্ফোরক রাখার গর্ত খনন করেন।

সিয়া চুয়াং গ্রামবাসী ইয়াং ইউয়ান তিং জানান, পায়ের নিচে খাড়া খাদ; একবার পা ফসকে পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। কাজের সময় উপর থেকে ভাঙা পাথরের টুকরা খসে পড়ে! মাও সিয়াং লিন সবার আগে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। তিনি প্রথমে সবচে বেশি বেশি ঝুঁকি নেন। তারপর অন্যরা তাঁর পিছে এই কাজ করতে থাকে।

 

মাও সিয়াং লিন বলেন, তিনি গ্রামের সিপিসির সম্পাদক হিসেবে সবার আগে থাকা তাঁর দায়িত্ব।

হুয়াং হুই ইউয়ান সিয়া চুয়াং গ্রামের গ্রামবাসী। তিনি সাক্ষাত্কার ভিডিওতে বলেছিলেন: সড়ক নির্মাণ করতে আমরা সবাই উত্সাহিত ছিলাম। আশা করি যত তাড়াতাড়ি এই সড়ক সম্পন্ন করবো, তত তাড়াতাড়ি সুখী জীবন আসবে।

 

আসলে ঠিক এই সাক্ষাত্কারের পর দিন, তিনি পাথরের আঘাতে মারা যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬ বছর।

মাও সিয়াং লিন এ বিষয়ে বলেন, এ দুর্ঘটনায় তিনি খুব মর্মাহত। তখন তিনি সড়ক নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবতেন। হুয়াং হুই ইউয়ানের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, এই সড়ক আর নির্মাণ করবো কি না। কেউ একজন চিত্কার করে বলে, ‘করবো, করবো...’। কথাটি বলেছেন মৃত হুয়াং হুই ইউয়ানের বাবা হুয়াং ই খুন।

 

সবাই হাত তুলে তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলায়। খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।

অবশেষে ২০০৪ সালে খাড়া উঁচু পাহাড়ে একটি ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২ মিটার চওড়া সড়ক তৈরি হয়।

২০০৪ সালে সিয়া চুয়াং গ্রাম ছিল হতদরিদ্র গ্রাম। দারিদ্র্যমুক্ত হতে চাইলে শুধু সড়ক নির্মাণই যথেষ্ট নয়, বরং শিল্প খাতেও উন্নতি করতে হয়।

গ্রামে কমলা, পিচ ও তরমুজ এই তিনটি দারিদ্র্যবিমোচনের শিল্প উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে এ কাজে সাহায্য দেয়।

 

কয়েক বছর চেষ্টার পর ২০১৫ সালে সিয়া চুয়াং গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ২০২০ সালে পুরো গ্রামের মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়।

২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, মাও সিয়াং লিন বেইজিংয়ের গণ-মহাভবনে দাওয়াত পান। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ তাঁকে ‘দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের দৃষ্টান্ত’ সম্মাননা দেয়।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর মহান আচরণের প্রশংসা করে বলেন: তিনি গ্রামবাসীদের সঙ্গে সাত বছর ধরে খাড়া উঁচু পাহাড়ে বাইরে যাওয়ার এক মহান পথ নির্মাণ করেছেন। তিনি হলেন ছুং ছিং শহরের উ সান জেলার সিয়া চুয়াং গ্রামের সিপিসি সম্পাদক মাও সিয়াং লিন।

 

পুরস্কার গ্রহণের পর তিনি আবারও গ্রামে ফিরে আসেন। এবার তিনি গ্রামবাসীদের সঙ্গে নতুন পরিকল্পনা নেন। এবারের মিশন: গ্রামের পরিবেশ সুন্দর করতে হবে, পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে এবং গ্রামীণ পর্যটনকে সমৃদ্ধ করতে হবে।