চীনের উ মেং পাহাড়ি এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির গল্প
2020-12-25 18:36:19

চীনের উ মেং পাহাড়ি এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির গল্প_fororder_wu1

চীনে উ মেং নামে একটি পাহাড় আছে। এর মোট বিস্তার ২৫০ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়পড়তা দুই হাজার মিটার উঁচু এ পাহাড়ে ফসল চাষ করা কঠিন, এখানে পানি যেন তেলের মতোই মূল্যবান।

এ অঞ্চলে চীনের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের জেলা ও শহর অবস্থিত। এখানে আরো আছে চীনের অন্যান্য জেলা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা মানুষের বৃহত্তম আবাসিক এলাকা। এ এলাকার দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ হল চীনের দারিদ্র্যমুক্তকরণ কর্মসূচীর একটি দারুণ উদাহরণ।

চীনে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হওয়ার পর ৭০ কোটিরও বেশি গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। যা চীনে সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

 

জিং আন নতুন এলাকা হল ইয়ুননান প্রদেশের চাও থুংয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য তৈরি নতুন আবাসিক এলাকা। নতুন ভবনের বিভিন্ন অবকাঠামো আছে, দেখতে যেন আধুনিক বড় শহরের মতই সুন্দর।

ইয়ুননান প্রদেশের চাও থুং শহরের সিপিসি’র শাখা সম্পাদক ইয়াং ইয়া লিন বলেন, উ মেং পাহাড়ি এলাকার জীবনযাপনের অবস্থা খুব কঠোর। এখানকার জমিতে চাষাবাদ করে স্থানীয় লোকজনের জীবনযাপন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এই কঠোর প্রাকৃতিক অবস্থা পরিবর্তন করতে না পারলে স্থানীয় মানুষদের স্থানান্তর করতেই হবে। যা বাস্তবায়নের জন্য সরকার অনেক চেষ্টা করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাও থুং শহর ৩ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি দরিদ্র মানুষকে গভীর পাহাড় থেকে স্থানান্তর করেছে। তারা নতুন বাড়িঘরে বসবাস করছে।

 

জিং আন নতুন এলাকায় কর্মসংস্থান-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কর্মীরা স্থানান্তরিত মানুষদের বাইরে চাকরি খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। জিং আন আবাসিক এলাকার অস্থায়ী প্রধান চৌ সিয়াং বলেন, এখানে স্থানান্তর হবার পর করোনাভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়। এ বিষয়ে আমাদের বাড়তি সচেতন থাকতে হচ্ছে।

আগে চাও থুং শহরে ২০ লাখ মানুষ বাইরে কাজ করতেন, মহামারি চলাকালে তাদের মধ্যে ৮.৪ লাখ জন্মস্থানে ফিরে আসে। সেপ্টেম্বর মাসে ৯৮ শতাংশ মানুষ আবারও বাইরে নিজের কাজে ফিরে যায়।

 

নতুন আবাসিক এলাকায় নতুন দোকান সাজানো হচ্ছে, এসব দোকানে স্থানান্তরিত মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

৫৭ বছর বয়সী ছি সি ছিং এবং তাঁর পরিবার গত মার্চ মাসে এখানে স্থানান্তরিত হয়েছে। আগে তিনি পাহাড়ে কিছু জমি চাষ করতেন, উত্পাদিত ফসল ছিল খাওয়ার জন্য যথেষ্ট। পুরো পরিবারে পুরো বছরের আয় ছিল চার হাজার ইউয়ান। যা দিয়ে ৬টি শিশু লালনপালন করতে হয়, জীবন খুবই কঠিন ছিল।

স্থানান্তরের পর বড় ছেলে বাইরে গিয়ে চাকরি করছে। ছি সি ছিং এবং তাঁর স্ত্রী আবাসিক এলাকায় একটি ছোট দোকান খুলেছেন; প্রতিদিন তার আয় ৫০ ইউয়ানের কিছু বেশি।

 

কুই চৌ প্রদেশের বড় আকারের স্থানান্তর করা আবাসিক এলাকা বো ইয়াং লিনে ৫৬ বছর বয়সী কৃষক ইয়াং ছিং চুং দারিদ্র্যবিমোচনের কারখানায় কাজ করছেন। তিনি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। স্থানান্তরের আগে তিনি পাহাড়ের একটি ৪০ বর্গমিটারের পুরোনো বাড়িতে থাকতেন; ভুট্টা চাষ ও বিক্রি করে  জীবনযাপন করতেন। সরকারের সাহায্যে তাঁর পরিবারের ছয় সদস্য ১২০ বর্গমিটারের নতুন বাড়িতে স্থানান্তর হয়েছে।

চীনের উ মেং পাহাড়ি এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির গল্প_fororder_wu2

কুই চৌ প্রদেশের বি জিয়ে শহরের হেং তি কমিউনিটি একটি চরম দরিদ্র গ্রাম। দরিদ্র পরিবারের দরজায় সামাজিক নিশ্চয়তার কার্ড লাগানো আছে। এতে পরিবারের মৌলিক তথ্য, দরিদ্র হওয়ার কারণ, আয়ের অবস্থা এবং সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির তথ্য আছে।

বি জিয়ে শহরের কর্মকর্তা ইয়ু চুং ওয়েই স্থানীয় ৪৪ বছর বয়সী ই জাতির মানুষ লুও কুও মি-এর পরিবারে গিয়ে খোঁজ খবর নেন। লুও-এর স্বামী চ্য চিয়াং প্রদেশে কাজ করার সময় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর বড় মেয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে লেখাপড়া করে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর আরো দুই মেয়ে ও এক ছেলে স্কুলে পড়ালেখা করছে। তার ওপর অনেক চাপ রয়েছে।

লুওকে স্বামীর চিকিত্সার রিসিট পাঠানোর কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তা ইয়ু। যাতে তিনি এসব রিসিট নিয়ে তাদের জন্য ভর্তুকির আবেদন করতে পারেন। তিনি লুও-এর বড় মেয়ের চিকিত্সার ফি মওকুফের আবেদনও জানিয়েছেন।

 

উ মেং পাহাড়ে জটিল ও নাজুক রাস্তা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠছে। ইয়ুন নান প্রদেশের ওয়ান ছাং থানার ৩৫ বছর বয়সী কৃষক উ বিং থানার বাস স্টেশনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি ৯০ কিলোমিটার দূরের জেলায় কাজ করতে যাচ্ছেন। তার মনে আছে, ২০১৭ সালে পাহাড়ি এলাকায় শুধু মাটির পথ ছিল। ওই জেলায় যেতে ৫/ ৬ ঘণ্টা সময় লাগতো! এখন বাস স্টেশন থেকে নিয়মিত বাস ছাড়ে, পথ আরো ভালো হয়েছে। মাত্র দুই ঘণ্টায় জেলায় পৌঁছানো যায়।

 

স্থানীয় সড়ক যোগাযোগ বিভাগের প্রধান তেং শেং বি বলেন, চলতি বছর শেষে পাঁচ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ পথ তৈরি হবে। আগামী পাঁচ বছরে আরো চার হাজার কিলোমিটার সড়ক তৈরি হবে। তখন প্রতিটি গ্রামে ভালো রাস্তা থাকবে।

কুই চৌ প্রদেশের বি জিয়ে শহরের তা শান গ্রামে সিপিসি’র শাখা সম্পাদক লি থিয়ান ইয়ানের বয়স ৩৭ বছর। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক সেখানকার গভীর পাহাড়ি এলাকায় যান। পাহাড়ি পথের দুই পাশে জঙ্গল রয়েছে; যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তাই পাহাড়ে ওঠা বেশ কঠিন।

 

লি থিয়ান ইয়াং তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে সেখানকার পাহাড়ি এলাকার মানুষদের স্থানান্তরে সাহায্য করেছিলেন। তাঁরা পাহাড়ে থাকেন, তৃষ্ণা হলে ঝরনার পানি পান করেন। বাড়ি স্থানান্তরের সময় ৮০জন স্থানীয় কর্মকর্তা ১৫ দিন ধরে কাঁধে করে ৩২টি পরিবারের আসবাবপত্রসহ সব জিনিস স্থানান্তর করেছেন।

এখন পাহাড়ে ঘাস ও মাটির বাড়িগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে; পাহাড়ে অনেক তুঁতগাছ চাষ করা হচ্ছে। যা স্থানান্তরিত মানুষদের আয়ের নতুন উত্স।

 

উ মেং পাহাড়ের দরিদ্র এলাকার সবখানে দেখা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা লোকজনকে সাহায্য করায় ব্যস্ত রয়েছেন।

চেন সুং জেলার সিপিসি’র শাখা সম্পাদক চাই ইয়ু লুং পুরো বছর নানা কাজে অনেক ব্যস্ত রয়েছেন। খুব জরুরি মিটিং ছাড়া বাকি সময়গুলো তিনি গ্রামে থাকেন। তিনি বলেন, সরকারি ভবনের ক্যান্টিন সবসময় খালি পড়ে থাকে; কারণ, সরকারি কর্মকর্তারা প্রায় সবাই গ্রামে গিয়ে কাজ করছেন।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন দুই লাখ ৫৫ হাজারেরও বেশি সহায়ক কর্মদল বিভিন্ন গ্রামে পাঠিয়েছে। ২৯ লাখেরও বেশি সরকারি কর্মকর্তা দরিদ্র গ্রামে গিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কুই চৌ প্রদেশের বি জিয়ে শহরের হ্য চাং জেলা সরকারি কার্যালয়ের উপ প্রধান চাং নিং ২০১৮ সালের অগাস্টে জেলার শুয়াং হ্য গ্রামে গিয়ে প্রথম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গ্রামের সব কৃষকদের নিয়ে কৃষি শিল্প উন্নয়নের চেষ্টা করেন। এ সময় তাঁর হঠাত্ কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। তাকে ডায়ালাইসিস করতে হয়। তবে তিনি জেলায় ফিরে যেতে চান না। এ অবস্থায় তিনি আরো ৬ মাস কাজ করেন।

চীনের উ মেং পাহাড়ি এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির গল্প_fororder_wu3

তিনি বলেন, আমি অসুস্থ হয়েছি, আমার খুব খারাপ লাগে। আমি গ্রামের মানুষের জন্য আরো কাজ করতে চাই। অসুস্থ হওয়া বড় বিষয় না। গ্রামে আমার চেয়ে আরো বেশি অসুস্থ মানুষ রয়েছে।

গত কয়েক বছর উ মেং পাহাড়ি এলাকায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দারিদ্র্যবিমোচনের ফ্রন্ট লাইনে কাজ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ অনেক পরিশ্রমের কারণে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন, কেউ আবার দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে মারা গেছেন।

 

দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সিপিসি’র শাখা স্থাপিত হয়। তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শেন চুং ইন নামে জনৈক ব্যক্তি ইয়ুন নান প্রদেশের চাং থুং শহরের একটি নতুন আবাসিক এলাকায় সিপিসি’র শাখা সম্পাদক। এই নতুন আবাসিক এলাকার ১৯টি ভবন আছে। তার কমিউনিটিতে সিপিসি’র ১৯জন সদস্য আছে। প্রতিদিন তারা সরকারের দারিদ্র্যবিমোচনের নীতি, আইন ও শহুরে জীবনের নানা বিষয় স্থানান্তরিত দরিদ্র মানুষদের শেখান। এ ছাড়া, তারা সবার জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজ খুঁজতে সাহায্য করেন।

 

উ মেং পাহাড়ি এলাকার দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, দেশের উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা অনেক সাহায্য করেছেন।

উ মেং পাহাড়ি এলাকা যেন চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের পরীক্ষাকেন্দ্র। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। চাও থুং শহরের সিপিসি’র শাখা সম্পাদক ইয়াং ইয়া লিন বলেন, দারিদ্র্যবিমোচনে দরিদ্র মানুষদের নতুন বাড়িঘর তৈরির জন্য চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী নির্মাণ গ্রুপ সাহায্য করেছে। যা পুরো দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের একটি উদাহরণ।

 

আরও একটি উদাহরণ আছে। যেমন, ইয়ুন নান প্রদেশের চেন সুং জেলার গণ-হাসপাতালের সাহায্যে সিছুয়ান প্রদেশের বিখ্যাত হুয়াসি হাসপাতাল সাহায্য করেছে এবং সেই সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এর ফলে চেং সুং জেলা হাসপাতাল ইয়ুন নানের সব জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বহুমুখী হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালে বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য সুবিধাজনক ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনে  রোগীরা বেইজিং ও শাংহাইসহ বিভিন্ন বড় হাসপাতালের দূরপাল্লার চিকিত্সাও গ্রহণ করেছেন। হাসপাতালের প্রধান হু ইয়ু বলেন, রোগের কারণে দরিদ্রতা গ্রামের বিভিন্ন মানুষের খুব বড় একটি সমস্যা। চিকিত্সা খাতের দারিদ্র্যবিমোচনের মাধ্যমে এখন গ্রামের লোকজন স্থানীয় হাসপাতালে চিকিত্সার চাহিদা পূরণ করতে পারছে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)