চীনের ‘ছাং এ-৫’ চন্দ্রাভিযানের আদ্যপান্ত
2020-12-23 09:38:39

চীনের ‘ছাং এ-৫’ চন্দ্রাভিযানের আদ্যপান্ত

১৭ ডিসেম্বর ভোরে ‘ছাং এ-৫’ চন্দ্রযান আকাশের একটি উল্কার মতো দ্রুত গতিতে পৃথিবীর কোলে অবতরণ করে। সুদূর মহাকাশ ও চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রাচীনকাল থেকেই চীনা মানুষের একধরনের কল্পনাময় স্বপ্ন ছিল।  আর এ হুমুর্তে সে স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নেওয়ার পাশপাশি চীনের মহাকাশ অভিযানের নতুন এক অধ্যায়ের জন্ম হয়। একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতি প্রথম বারের মতো চাঁদ থেকে নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। সবচেয়ে জটিল প্রযুক্তির এ চন্দ্রযান চীনের প্রথম মহাকাশযান, যেটি পৃথিবীর বাইরের কোন গ্রহ থেকে নমুনা নিয়ে ফিরে এলো। এর মাধ্যমে চাঁদের জন্ম ও সৌরজগতের উন্নয়ন সম্পর্কে মানুষের বৈজ্ঞানিক জানাশোনা আরও গভীর হবে।

২০২০সালের ২৪ নভেম্বর ভোর সাড়ে ৪টায় চীনের ওয়েন ছাং উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে লাংমার্চ-৫ পরিবাহক রকেটের সঙ্গে ‘ছাং এ -৫’ চাঁদের  উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করে। ২৩ দিন পর ১৭ ডিসেম্বর  ভোরে ইনার মঙ্গোলিয়ার সি চি ওয়াং জেলায় সফলভাবে ফিরে আসে। ‘ছাং এ-৫’ চন্দ্রযানের ওজন ৮.২টন। এর চারটি অংশ রয়েছে। এটি চীনের চাঁদ গবেষণা প্রকল্পের মূল অংশ এবং  চীনা বৈজ্ঞানিক উন্নতি, দক্ষতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন।

‘ছাং এ -৫’ এর ২৩দিনের যাত্রা পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় এটি এক অসাধারণ স্মৃতি। ২০২০ সালের শেষ দিকে এ মহাকাশ যাত্রা চির দিনের মতো মানুষের মনে থাকবে।

 

১ ডিসেম্বর রাতে ১১টা ১১মিনিটে, ‘ছাং এ-৫’ চাঁদের নির্দিষ্ট এক জায়গায় অবতরণ করে। ১৫ মিনিটে জটিল প্রক্রিয়া শেষ করে একজন পরীর মতো ধীরে ধীরে চাঁদে চলাফেরা করে। ২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১৯মিনিটে এটি চাঁদ থেকে কিছু মাটির নমুনা নেয় এবং সীল করে। তারপর এ নমুনা আরোহী যন্ত্রে রাখে।

 

‘ছাং এ-৫’ মোট দু ধরনের চাঁদের মাটি নিয়েছে। একটি হলো পৃষ্ঠতলের মাটি অন্যটি ভেতর থেকে খুড়ে বের করা মাটি। মাটি নেয়ার প্রক্রিয়াও ভিডিওর মাধ্যমে দেখেছে চীনের জনগণ। পরে ৩ ডিসেম্বর রাত ১১টা ১০মিনিটে ‘ছাং এ -৫’ এর আরোহী যন্ত্র সয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রবেশ করে। চাঁদে উড্ডয়নের জন্য উপযুক্ত জায়গায় খুঁজে বের করে সয়ংক্রিয়ভাবে উড্ডয়ন করে ‘ছাং এ-৫’। এর সবগুলো ধাপই  কঠিন ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর ছিল।

 

পরে ৪ ডিসেম্বর চীনের জাতীয় মহাকাশ ব্যুরো প্রকাশ করে একটি ছবি এবং এতে দেখা যায় ‘ছাং এ-৫’ চীনের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করছে। ৬ ডিসেম্বর সকাল ৫টা ৪২মিনিটে ‘ছাং এ-৫’ এর আরোহী যন্ত্রটি ফিরতি যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং নমুনাগুলো ফিরতি যন্ত্রের কাছে হস্থান্তর করে। এর মাধ্যমে চীনের মহাকাশযান প্রথম বারের মতো চন্দ্র-কক্ষপথে সংযুক্ত হতে সফল হয়। সুদূর পৃথীবি থেকে পাঠানো একটি প্যাকেজ ২১ সেকেন্ডের মধ্যে এ সংযুক্তির কাজ শেষ করে।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মহাকাশ অভিযানের জনক ওলকভস্কি রকেটে বসে অন্য গ্রহে যাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন থেকে মহাকাশে যাওয়া মানবজাতির এক অভিন্ন স্বপ্ন। ৫০ বছর আগে চীন সফলভাবে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘তুং ফাং হুং-১’ উৎক্ষেপণ করে এবং ৫০ বছর পর ‘ছাং এ-৫’ মিশনের সফলতা চীনের মহাকাশ অভিযানের নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। দশ বারো বছর আগে বিশ্বের প্রধান দেশগুলো নিজস্ব চাঁদ অনুসন্ধ্যান পরিকল্পনা তৈরি করে। যেমন চাঁদের উদ্দেশ্যে আবিষ্কারক যন্ত্র পাঠানো, মানুষ পাঠানো বা চাঁদে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা ইত্যাদি। তবে এ পর্যন্ত  মাত্র চীন দশ বারো বছর আগে তৈরি এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। চাঁদ আমাদের পৃথিবীর কাছে একটি উপগ্রহ, তবে তার কাছে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। মহান এ পরিকল্পনা নিয়ে চীনা  বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কোন বড় কথা বলেন নি। তাঁরা চাঁদকে কেন্দ্র করে ঘুরা, চাঁদে অবতরণ করা এবং চাঁদ থেকে ফিরা এ তিনটি পদক্ষেপ নিয়ে ধাপে ধাপে কাজ করেছেন।

 

ফলে ১৬ বছরের প্রচেষ্টায় চীনের ৬টি চাঁদ অনুসন্ধ্যান মিশন সফল হয়। বাজেটের মধ্যে সময় মতো সব পরিকল্পনা শেষ করেন তাঁরা। চীনা চন্দ্র অনুসন্ধ্যান প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী উ ওয়ে রেন বলেন,  “আমাদের প্রত্যেক সাহসি ধারণা ও এসবের সফল বাস্তবায়ন জনগণের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পালন। ছোট এক একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করি। ‘ছাং এ-৫’ এর গবেষণা ও তৈরি করতে ১০ বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে নিশ্চয় নানা কষ্টকর অবস্থা দেখা দেয় এবং ব্যর্থতার ঘটনাও ঘটে কয়েক বার। তবে কেউ হাল ছাড়ে নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে গেছেন। ফলে চীন চাঁদ অনুসন্ধ্যানের ক্ষেত্রে একটি উন্নত দেশে পরিণত হয়। মহান কাজ সাধারণত শুরু হয় একটি স্বপ্ন থেকে এবং উদ্ভাবন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন হয়। আমাদের এ মহৎ কাজের পিছনে রয়েছেন একদল বিজ্ঞানী ও গবেষক। যাঁরা ১০ বছরের মতো পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন”।

 

চীনের চাঁদ অনুসন্ধ্যান প্রকল্পের প্রথম প্রধান বিজ্ঞানী ওইয়াং চি ইউয়ান ‘ছাং এ-১’ এর কথা স্মরণ করে বলেন, “ওই মুহুর্তে আমি যেন ছাং এর একটি অংশে পরিণত হয়েছিলাম এবং মাহাকাশে তার সঙ্গে ঘুরে আমার চার পাশের সবকিছুই আমি ভূলে গেয়েছিলাম”।

 

বর্তমানে ওইয়াং চি ইউয়ান ৮০বছর বয়সি একজন প্রবীণ এবং চাঁদ গবেষণা তিনি কখনও ভুলে যাবেন না। তিনি বলেন, “‘ছাং এ-৫’ এমন একটি দায়িত্ব বহন করে যে, তার মাধ্যমে আমরা চাঁদ উন্নয়নের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারব”।

৫০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি মহাকাশযান ১০১গ্রাম চাঁদের মাটি নমুনা নিয়ে ফিরে এসেছিল এবং এটা মানব জাতির ইতিহাসে প্রথম মাহকাশযান হিসেবে চাঁদ থেকে নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। ৫০ বছর পর চীন আবার এ মহান কাজটি করেছে। ছাও ইউয় হুয়া নামে এক বিজ্ঞানির নেতৃত্বে একটি দল ‘ছাং এ-৫’ যানের গবেষণা ও তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ডাক নাম ছিউ ইউয়ে। চীনা ভাষায় তার অর্থ শরত্কালের চাঁদ। তিনি চাঁদের সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠ। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মনুষ্যবাহি মহাকাশ বিমান এবং তিনি ১৮ বছরের মতো এ ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। তবে চন্দ্রযান গবেষণা করতে গিয়ে তিনি নতুন  একটি বিষয় নিয়ে মূল্যবান কাজ করেন। ‘ছাং এ-৫’ এর গবেষণা  ও তৈরিতে তাঁর ১০ বছর সময় লাগে। তিনি বলেন, “মহাকাশে মানুষের গবেষণা ও অনুসন্ধ্যান মাত্র শুরু হয়েছে। চাঁদ থেকে আমরা আরও দূরে যেতে পারব”।

 

চীনের নভোচারী কবে চাঁদে যাবেন তা এখন চীনের সব মানুষের প্রশ্ন। চীনের এক বিজ্ঞানি একবার বলেছেন: “পৃথিবীতে  সৌর জগতের ছোট একটি অস্তিত্ব হলো মানবজাতি।  এর বাইরে না গেলে আমাদের অস্তিত্ব অব্যাহ্ত রাখা যাবে না”।

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী চীনা চাঁদ অনুসন্ধ্যান প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের  কর্তব্য হল চাঁদে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের মৌলিক পরীক্ষা। ‘ছাং এ ৬’ ও ‘ছাং এ ৭’ ভবিষ্যতে চাঁদে গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের সম্ভবনা নিয়ে আরও কাজ করবে।

 

মহাকাশ অনুসন্ধ্যান আমাদের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। আর ভবিষ্যতে হয়তো মহাকাশের একটি জায়গায় আমরা সুন্দর আবাসও গড়ে তুলতে পারব।

(শিশির/এনাম/)