হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক: প্রধান ইস্যুগুলো দেখছে না আলোর মুখ
2020-12-20 19:46:03

১৭ ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠক করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভার্চুয়াল হলেও দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক দু’দেশের কূটনৈতিক মহলসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে স্বাভাবিক কারণেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দু’দেশের গণমাধ্যম এ বৈঠকের খবর ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশ করেছে। এখন চলছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব-নিকেষ। কী পেলো বাংলাদেশ হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক থেকে?

দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ৭টি সমঝোতাস্মারক সই আর চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলরুট পুনরায় চালু হওয়া। তবে বরাবরের মতোই আশ্বাসে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে তিস্তা চুক্তি, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো।

বাণিজ্য, জ্বালানি, কৃষিসহ সাতটি খাতে সহযোগিতায় সমঝোতাস্মারক সই করেছে দুই দেশ। দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের আগে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পদ্মায় এ সব এমইউতে সই করেন দু’দেশের প্রতিনিধিরা। এমইউগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে হাতি সুরক্ষায় অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, বরিশালে স্যুয়ারেজ প্রকল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। দু’দেশে সহযোগিতার ক্ষেত্রে এ প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব রয়েছে সন্দেহ নেই।

দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে আরেকটি প্রাপ্তি দীর্ঘ ৫৫ বছর বন্ধ থাকার পর ফের চালু হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলরুট। ভার্চুয়াল বৈঠক দুই প্রধামন্ত্রী এ রেলরুটের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের নীলফামারি জেলার চিলাহাটি থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত এ রেলপথটি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়। উদ্বোধনের দিনেই ৩৩টি বগি নিয়ে একটি মালবাহী ট্রেন গেছে চিলাহাটি থেকে গেছে ভারতেরে হলদিবাড়ি।

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, পণ্যবাহী ট্রেনের পাশাপাশি আগামী বছর থেকে শুরু হবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল। ঢাকা থেকে এ ট্রেন চলবে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি পর্যন্ত। রেলরুটটি চালু হওয়া নিঃসন্দেহে দু’দেশের মানুষের জন্য খুশির খবর। দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে এটি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরাবরের মতোই শীর্ষ বৈঠকে বলেছেন, প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তারা অগ্রাধিকার দেন। ভারত করোনা টিকা পেলে তা বাংলাদেশও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবে বলে আবারো জানিয়েছেন। এ জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

কিন্তু প্রতিবেশি ভারতের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া আরো একটু বেশি। বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা আর দেখতে চায় না, বাংলাদেশ তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা চায়; বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের যথাযথ উদ্যোগ চায়। ওপরের সবগুলো বিষয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছেন। সীমান্তে প্রাণঘাতি অস্ত্র বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া যাতে ব্যবহার না হয় – সে উদ্যোগের কথাও বলেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিস্তা চুক্তি কাজ এগুচ্ছে বলে জানিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। কিন্তু এসব আশ্বাসে বরাবরের মতোই ভরসা রাখতে পারছে না বাংলাদেশের মানুষ।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর জট খুলছে না। হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠককে তারা ইতিবাচক বলছেন। বিশেষ করে বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতার বিষয়ক তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। করোনা মহামারি মোকাবেলায় সহযোগিতা ও করোনা টিকা প্রাপ্তিতেও বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পাবে বলে মানছেন তারা। কিন্তু তিস্তা, সীমান্ত হত্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারাও দেখছেন না কোনো আশার আলো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, তিস্তা ও সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে ভারতকে তার অবস্থান আরো স্পষ্ট করত হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমঝোতা ছাড়া তিস্তা চুক্তি সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তারা। ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা কাটিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কী ভূমিকা নেবে সে বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তিস্তা, সীমান্ত হত্যা এবং রোহিঙ্গার মতো ইস্যুগুলোতে ভারত আরো উদার দৃষ্টিভঙ্গি না নিলে এ ইস্যুগুলো অদূর ভবিষ্যতে আলোর মুখ দেখবে না বলেই আশঙ্কা তাদের।  

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।