স্মরণীয় বরণীয় যাঁরা
2020-12-20 17:21:19

্মরণীয় বরণীয় যাঁরা

ভাগ্যের অন্বেষণে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন তারা। তারপর শুরু করেছিলেন সাধারণ কিছু কাজ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। এক এক করে দুটি কোম্পানির প্রধান হয়ে যান ২৮ বছর বয়সী ইয়ুননান প্রদেশের তরুণ সিয়াও থাও। আর এতে তাঁর লেগেছিল মাত্র তিন বছর সময়। এখন তাঁর দুই কোম্পানিতে শতাধিক প্রতিবন্ধী কর্মী আছে। আর তিনি নিজেও আসলে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী, তাঁর দেহের অঙ্গ অচল, তাঁর কথা বলতে সমস্যা হয়। কিন্তু, নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি সবসময় পর্বতের মতো দৃঢ় মনোবল ধারণ করেন। তাঁর স্বপ্ন— জন্মস্থানের অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ দেওয়া।

 

সিয়াও-এর বাড়ি ইয়ুননান প্রদেশের ছুই জিং শহরের লাউ নিউ ছাং গ্রামে। উচ্চ বিদ্যালয় পাস করার পর তিনি আর লেখাপড়া করতে পারেন নি। কারণ তাঁর পরিবার ছিল অনেক দরিদ্র। এরপর তিনি কয়লা খনিতে কাজ করেছেন, গাড়ি ধোয়ার কাজ করেছেন, খবরের কাগজ বিক্রি করেছেন, জুতার দোকানে কাজ করেছেন, ছোট-খাটো জিনিস বিক্রি করেছেন। এসময় তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন যে, প্রতিবন্ধীদের জীবন অনেক কষ্টের। তবে, তিনি কখনওই নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে সরে যান নি।

তাঁর জীবনে পরিবর্তন শুরু হয় ২০১৭ সালে। ছুই জিং শহরের প্রতিবন্ধী সংস্থা ই-কমার্স প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে সিয়াও এক মাসের মধ্যে ধাপে ধাপে ই-কমার্স পরিচালনার বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। তখন তাঁর মাথায় নিজের উদ্যোগ গ্রহণের চিন্তা শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন স্তরের প্রতিবন্ধী কমিশনের সাহায্যে তিনি ছুই জিং শহরে প্রথম ই-কমার্স কোম্পানি স্থাপন করেন। প্রতিবন্ধী কমিশন তাঁর জন্য পণ্যদ্রব্যের উত্সের সমস্যা সমাধান করে। তাঁর ব্যবসা এভাবেই শুরু হয়।

 

২০১৮ সালের শীতকালে জন্মস্থানের মরিচ বিক্রির সমস্যা দেখা দেয়। এ তথ্য শুনে সিয়াও গভীর রাতে লাউ নিউ ছাং গ্রামে ফিরে যান। তিনি বাজারের দামের চেয়ে আরো বেশি দাম দিয়ে গ্রামবাসীর কাছ থেকে ১৩০০ টন মরিচ কিনে নেন। এর ফলে স্থানীয় লোকজনের জীবনের সমস্যা সমাধান হতে থাকে। সিয়াও বলেন, তিনি কখনই সেই শীতের রাতের কথা ভুলে যাবেন না। তখন গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা লাইন ধরে কাঁধে মরিচের ব্যাগ নিয়ে সিয়াও-এর দলের জন্য অপেক্ষা করত।

 

সেই মুহূর্তে সিয়াও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাঁর কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তখন থেকে আরো বেশি প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

মরিচসহ বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ক্রয় করার জন্য সিয়াও-এর ছোট ভাই গাড়ি চালিয়ে তাকে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে যান। একবার, দুই ভাই সিয়াও ওয়ান থৌ গ্রামে পৌঁছে জানতে পারেন যে, প্রতিবন্ধী কৃষক চু মিং কুও-এর পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ, তিনি সরকারের নিম্ন আয়ের ভর্তুকি দিয়ে জীবনযাপন করেন। সিয়াও দ্বিধা না করে কৃষক চুকে দুই পেকেট মরিচের বীজ দিয়ে দেন। তিনি বলেন, বীজ নাও, মরিচ চাষ করো, আমি তোমার সব মরিচ কিনে নেবো।

 

এখন কৃষক চু ৪০ মু (এক মু ৬৬৬ বর্গমিটার) জমিতে মরিচ চাষ করছেন, তিনি গ্রামের আদর্শ কৃষকে পরিণত হয়েছেন। তিনি যেখানে যান, সেখানে স্থানীয় কৃষকদের যে কথাটি সবচেয়ে বেশি বলেন, তা হল: আমি বীজ দেবো, তোমরা চাষ করলে আমি সব কিনে নেবো, তোমাদের সব মরিচ আমি বিক্রি করে দেবো।

 

আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিজের দুই বাহু হারিয়েছেন ২৭ বছর বয়সী কৃষক সিয়াও ফু ইউ। এ অবস্থাতেও জীবন সম্পর্কে আস্থা হারান নি তিনি। তিনি সিয়াও-এর ই-কমার্স কোম্পানিতে ক্রেতাদের সেবার কাজ করে থাকেন। বাসায় বসেই কাজ করা যায়, প্রতি মাসে দুই হাজার ইউয়ানেরও বেশি উপার্জন করছেন তিনি। সিয়াও ফু ইউ-এর মত, এই কোম্পানিতে কাজ করা প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২২জন।

সিয়াও বলেন, আমাদের কোম্পানি পরিচালনার ধারণা হল- উত্পাদন ও বিক্রি একসঙ্গে করা; সবাই একসঙ্গে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া। সিয়াও আশা করেন, আরো বেশি প্রতিবন্ধীদের দারিদ্র্যমুক্ত করবেন তিনি। কোম্পানি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইয়ুননান প্রদেশের ছুই জিং এবং দ্য হুং শহরে কৃষিজাত দ্রব্য উত্পাদনের জন্য পাঁচ হাজার মু আয়তনের কৃষিকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। এতে প্রধানত মরিচ ও ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী এবং তিন শতাধিক নিবন্ধিত দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে।

 

২০১৯ সালে সিয়াও-এর ই-কমার্স কোম্পানি ছুই চিং শহর এবং ইয়ুননান প্রদেশের প্রতিবন্ধী ব্যবসায় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।

 

চলতি বছর করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে, ইয়ুননান প্রদেশের কিছু কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করায় সমস্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে অফিস ও কাজ শুরু হলে সিয়াও দ্রুত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে কৃষিজাত দ্রব্য ক্রয় করতে শুরু করেন। যাতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে স্থানীয় কৃষকদের জীবন ও উত্পাদন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা যায়। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে সিয়াও ৫০০ টন আলু, ৮০০ টন রসুন এবং ১০০০ টন ভুট্টা বিক্রি করেছেন।

এখন অনেক রাত। তবে সিয়াও তাঁর কারখানায় কাজ করছেন। তিনি বিভিন্ন অর্ডারের পণ্য পাঠানোর কাজে ভীষণ ব্যস্ত। গত তিন বছর ধরে তাঁর কোম্পানি প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার পার্সেল বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠাচ্ছেন। তিনি ইয়ুননানের বৈশিষ্ট্যময় কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করেছেন প্রায় ৬০ হাজার টন। যার মোট মূল্য নয় কোটি ইউয়ানেরও বেশি।

 

ছুই জিং শহরের প্রতিবন্ধী কমিটির উপপরিচালক ছেন জু সিয়ান বলেন, প্রতিবন্ধীদের নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সহায়তা করার জন্য আরো বেশি চেষ্টা করতে হবে। তবে সিয়াও কখনওই কঠিনতার কাছে নতি স্বীকার করেন নি।

 

গত জুন মাসে সিয়াও ছুই চিং শহরে একটি প্রতিবন্ধী টিশু পেপার কারখানা স্থাপন করেন। এখন এই কারখানায় আটজন প্রতিবন্ধী আছে। ৪৮ বছর বয়সী নারী ফু ওয়েন সিয়াংয়ের পা-তে সমস্যা। তিনি এই কারখানায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আগে তার কোনো চাকরি ছিল না, শুধু বাসায় বসে থাকতে হতো। এখন তিনি প্রতিদিন কারখানায় কাজ করেন এবং তার দৈনিক ৮০ ইউয়ান আয় হয়।

 

সিয়াও নিজের আচরণের মাধ্যমে অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের জানান যে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।

 

তিনি আশা করেন, সমাজের আরো বেশি মানুষ প্রতিবন্ধীদের যত্ন নেওয়ার কাজে যোগ দেবে। ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে সিয়াও বলেন, আরো বেশি মানুষ তাঁর মতো স্বপ্ন পূরণের কাজে যোগ দিলে অবস্থা অনেক ভালো হবে। তাঁর কৃষিজাত দ্রব্য উত্পাদন কেন্দ্রের আয়তন আরো বাড়ানোর প্রত্যাশা করেন তিনি। এ প্রদেশের অন্যান্য প্রতিবন্ধী এসব কাজে অংশ নিলে তাদের জীবন আরো ভালো হবে বলে আশা করেন তিনি।

সিয়াও বলেন, তিনি ঠিক চোখের সামনেই আশার আলো দেখতে পান। শুধু তাকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে হয়।

 

 

যে নারী পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী

হাই লাং নামে এক প্রতিবন্ধী মেয়ে চীনের শায়ানসি প্রদেশের থুংছুয়ান শহরের উ লিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। ছোটবেলায় হঠাত্ প্রচণ্ড জ্বর তার জীবনকে একেবারে তছনছ করে দেয়। তাঁর পরিবার যদিও তাঁর চিকিত্সার জন্য অনেক চেষ্টা করে, তার পরও জ্বরের কারণে তাঁর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি একটি সুস্থ-সবল  মেয়ে থেকে হঠাত করে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

 

রোগ তার জীবনে কী কী প্রভাব ফেলেছে? এ সম্পর্কে হাই লাং বলেন, যদি জীবনের কোনো দুঃখের কথা বলি, তা হলো আমি দুই পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারি না- তা নয়। বরং, আমার জীবনের পরিতাপের বিষয় হল- আমি অন্য মেয়েদের মতো স্কুলে যেতে পারি না, শ্রেণীকক্ষে বসে লেখাপড়া করতে পারি না।

 

সে আর স্কুলে যেতে না পারলেও তার মানসিক শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। সে নিজেই লেখাপড়া করে অনেক কিছুই শিখতে পারে। সাত বছর বয়সে হাই লাং-এর পরিবারে টিভি কেনা হয়। তখন সে টিভি অনুষ্ঠানের সাবটাইটেল দেখে অক্ষর চিনতে শুরু করে। অবশেষে হাই লাং অক্ষর লিখতে ও পড়তে সক্ষম হন, সে সুন্দর করে ম্যান্দারিনও বলতে পারে।

 

তবে তা সত্ত্বেও হাই লাং মনের দুঃখ দূর করতে পারেন নি। হুইলচেয়ারে এক দিন যেন এক বছরের মত দীর্ঘ। তার মুখ দেখতে শান্ত মনে হলেও আসলে হাই লাং-এর বুকে গভীর কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে। একটি কথা বার বার তাঁর মনে ভেসে ওঠে: পরিবার আমাকে ছেড়ে যায় নি, সবাই আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছে, আমার যত্ন নিয়েছে, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে; তবে, পরিবারের বোঝা হিসাবে নয়।

 

পরিবর্তন শুরু হয় একটি মোবাইলফোন থেকে। ২০০৮ সালে বড় বোন হাই লাংকে একটি পুরানো স্টাইলের মোবাইলফোন কিনে দেন। হাই লাং ঠোঁট দিয়ে টাইপিং করা শুরু করে। দিন  রাত ধরে, হাই লাং পাগলের মত চর্চা করতে থাকে। এতে ঠোঁট রক্তাক্ত হয়ে যায়, শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, পুরো শরীর ব্যথা হয়ে যায়। তারপরও হাই লাং সে চর্চা বন্ধ করে নি। অবশেষে হাই লাং খুব ভালোভাবে এবং দ্রুত ঠোঁট দিয়ে ফোন করা ও মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হয়।

 

২০১৫ সালে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের আওতায় হাই লাংয়ের পরিবার দরিদ্র পরিবার হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ২০১৬ সালে স্থানীয় কর্মকর্তা হাই লাংয়ের পরিবারকে মোবাইলফোন দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেয়। এরপর তার পরিবার হাই লাংকে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেয়। সে উইচ্যাটে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করা শুরু করে। চীনে একটি কথা আছে: সবকিছুর শুরুটাই হলো কঠিন। শুরুর দিকে হাই লাংয়ের ভক্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭জন। তবে, তার নিরলস চেষ্টার পর এখন হাই লাংয়ের দোকানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালে হাই লাংয়ের অনলাইন স্টোরের আয় ৩০ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। হাই লাং অবশেষে আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের দারিদ্র্যমুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে।

 

অনেকেই হাই লাংকে বলেন: তোমার এত কষ্ট করার দরকার নেই। তোমার বাবা মা ও ভাই-বোন তোমাকে ছেড়ে দেবে না। সিপিসি ও সরকার তোমার জন্য অনেক সুবিধাজনক ব্যবস্থা নেবে।

জবাবে হাই লাং জানায়, নিজের চেষ্টার মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। এ খুশি অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় না- এমন একটি প্রশান্তির ব্যাপার। আমি চাই, অনেক বছর পর সবাই যখন আমার কথা উল্লেখ করবে, তখন যেন আমার প্রশংসা করে। আমি চাই প্রতিবন্ধীরা আমার সম্পর্কে আরো ভালো মনোভাব পোষণ করুক, আমি চাই আরো বেশি মানুষ প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে যোগাযোগ করুক, প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করুক। তারা প্রতিবন্ধীদের উপর আস্থা স্থাপন করুক।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)