পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়েদের ‘স্কুল মাস্টার মা’
2020-12-16 14:49:03

পাহাড়ি  অঞ্চলের মেয়েদের ‘স্কুল মাস্টার মা’

একদিন দুপুরে এক সাংবাদিক চীনের ইউনান প্রদেশের লি চিয়াং শহরের হুয়া পিং গার্লস হাই স্কুলে প্রবেশ করেন। সেখানে ওই সাংবাদিক দেখতে পান ছোট একটি মেয়ে স্কুলের মাস্টার মাদাম ছাং কুই মেই’র কোলে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে কথা বলছে। এ মেয়ের বড় বোনও এ স্কুল থেকে তার শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেছে এবং সে এখন মাধ্যমিকের ছাত্রী। বড় বোনের কারণেই ছোট মেয়েটি মাস্টার ছাংয়ের সঙ্গে পরিচত হয়।  মেয়ে দুটির বাবা মারা গেছেন এবং  মা  আম চাষ করে তাদের পড়া-লেখা করাচ্ছেন। তবে চলতি বছর আমের ফলন ভাল হয়নি। ছোট মেয়ে বাবার কথা মনে করে গত কয়েক দিন খুব মর্মাহত ছিল। সেসময়ে সে স্কুলেও আসে নি। সেজন্যই মেয়েটি মাস্টারের কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। ছাং কুই মেই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তুমি স্কুলে এসো, না হলে বাবা হতাশ হবেন। তিনি মেয়ের মা’কে ১০হাজার ইউয়ান দেন এবং এ টাকা দিয়ে আম বাগানে একটি জলাধার নির্মাণের পরামর্শ দেন। তবে এ টাকা মাস্টার শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে তাঁর চিকিৎসার জন্য পেয়েছেন। কিন্তু তিনি এ টাকা তাঁর ছাত্রীর মা’কে দিয়ে দেন।

 

এভাবেই ওই মাস্টার অনেক মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়তা করে চলছেন। ছাং কুই মেই’র নেতৃত্বে হুয়াং পিং গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার ১২ বছরে মোট ১৮০৪জন মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সহায়তা করেছে। এসব কারণে তেষট্টি বছর বয়সি ছাং কুই মেই’কে স্কুলটির মেয়েরা ‘মা’ বলে সম্বোধন করে থাকে।

 

হুয়া পিং গার্লস হাই স্কুলটি হুয়া পিং জেলার একটি পাহাড়ে অবস্থিত। স্কুলটি তেমন বড় নয় এবং দেখতে একটু পুরাতনও বটে। এমন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাং কুই মেই’র স্বপ্ন ছিল। ছাং কু মেই ও তাঁর স্বামী তা লি শহরের একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর স্বামী পেটের ক্যান্সারের কারণে ১৯৯৬ সালে মারা গেছেন।  ফলে ছাং কুই মেই শহর থেকে ছোট এ জেলায় চলে আসেন। ২০০১ সালে তিনি হুয়া পিং শিশু কল্যাণ ইনস্টিটিউটের প্রধান হন এবং তিনি আবিষ্কার করেন যে, ওই এলাকার অনেক মেয়ে আসলে অনাথ নয় , বরং তাদের বাবা-মা তাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। তাই তিনি নিয়মকরে স্থানীয় পরিবার পরিদর্শন করা শুরু করেন। একবার একটি ১৩-১৪ বছর বয়সি মেয়ের সঙ্গে তাঁর  দেখা হয়। মেয়েটি তাঁকে বলে, সে স্কুলে পড়া-লেখা করতে চায়। তবে তার বাবা ৩০হাজার ইউয়ানের লোভে তাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। ছাং কুই মেই মেয়ের বাড়িতে যান এবং তার বাবা-মাকে বলেন, মেয়েটিকে আমি নিয়ে যাব এবং  স্কুলে পাঠাব। কিন্তু মেয়েটির মা কোনভাবেই এতে রাজি হন নি। কোন উপায় না দেখে ছাং কুই মেই আর ওই মেয়ের কাছে যান নি। কিন্তু মেয়েটির জন্য তাঁর সব সময় আক্ষেপ হতো। সেই থেকে তাঁর মনে এমন একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন জন্ম নেই, যেখানে সব মেয়ে বিনামূল্যে লেখা-পড়া করতে পারবে।

পাহাড়ি  অঞ্চলের মেয়েদের ‘স্কুল মাস্টার মা’

 

তবে তাঁর এ স্বপ্নকে  অসম্ভব মনে করেছিলেন স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের প্রধান ইয়াং ওয়েন হুয়া। তিনি বলেন, শুরুতে আমি ছাং কুই মেই এর বিরোধীতা করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম একটি বিনামূল্যের হাই স্কুল খোলা কতটা কঠিন কাজ। একবার  ছাং কুই মেই তাঁর স্বপ্নের স্কুলটি খোলার ব্যাপারে ইয়াং ওয়েন হুয়া এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। ইয়াং তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী জানেন একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করতে কত টাকা লাগবে?  বিশ থেকে ত্রিশ হাজার ইউয়ান। ইয়াং ওয়েন হুয়া বলেন, ছাং কুই মেই নিষ্পাপ একজন মানুষ। তিনি ভাল একজন শিক্ষক এবং অনাথ মেয়েদের অনেক সাহায্য দিয়েছেন তবে তখনও তাঁর কোন স্কুল ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা ছিল না।

 

ফলে অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েও ছাং এর স্কুল খোলার স্বপ্ন বারবার ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০৭ সালে ছাং কুই মেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিসি’র ১৭তম কংগ্রেসের প্রতিনিধি হন। বেইজিংয়ে যাওয়ার আগে জেলা সরকার তাঁকে ৭০০০ ইউয়ান দেয় নতুন একটি পোশাক কেনার জন্য। তবে তিনি এ টাকা দিয়ে মেয়েদেরকে একটি কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন। তিনি ছেঁড়া কাপড় পরেই বেইজিংয়ে যান। বেইজিংয়ে তিনি একজন সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ওই সাংবাদিককে স্কুল খোলার কথা বলেন। পরে ওই সাংবাদিক  এ নিয়ে বিশেষ একটি প্রবন্ধ লিখেন। এবার ছাং কুই মেই’র স্বপ্ন পূরণ হয়। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হুয়া পিং গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রথম বার ১০০জন ছাত্রী ভর্তি করানো হয়। তাঁর স্বপ্নের স্কুলটি চালু হওয়ার প্রথম দিন একমাত্র  শিক্ষা ভবনে দাঁড়িয়ে ছাং কুই মেই স্বপ্ন পূরনের সুখে কয়েক ফোটা অশ্রু বিসর্জন করেন।

 

সকল পাহাড়ের মেয়েদের জন্য হুয়া পিং হাই স্কুল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রথম দিন থেকে এ স্কুলে শিক্ষা, ও বাসস্থানসহ সকল ফি মওকুফ করে দেওয়া হয়। নামে মাত্র কিছু খাবার খরচ ছাড়া অন্য কোন ব্যয় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের করতে হয় না। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা মাধ্যমিক স্কুলে ভাল লেখা-পড়া না করলেও এ হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারে। শুরুতে ক্যাম্পাসের চার পাশে কোন দেয়াল ছিল না, ছিল না কোন টয়লেট। ছাত্রীরা এক রুমে ক্লাস করতো এবং বাকি রুমে ঘুমাতো। আসলে এ স্কুল পুরোপুরিভাবে নির্মিত হওয়ার আগেই মেয়েদেরকে ভর্তি শুরু করে ছিল। ছাং কুই মেই বলেন,  এক বছর দেরিতে খোলা হলে আরও বেশি মেয়ে লেখা-পড়ার সুযোগ হারাবে, তাই আমরা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আগেই স্কুলটি খোলে দিয়ে ছিলাম। ২০১১ সালে হুয়া পিং হাই স্কুলের প্রথম  ব্যাচের ছাত্রীরা স্কুলটির শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করে এবং সবাই বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হয়। এর মাধ্যমে তারা তখন একটি অলৌকিক ঘটনার জন্ম দেয়।

 

পাহাড়ি  অঞ্চলের মেয়েদের ‘স্কুল মাস্টার মা’

২০১৬ সালে স্কুলের সব নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং সাধারণ স্কুলের মতো স্কুলটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যান্টিন,ডরমেটরি এবং খেলার মাঠ। বর্তমানে স্কুলের তিন শ্রেণীর ৯টি ক্লাসে মোট ৪৬৪জন ছাত্রী আছে। ছাং কুই মেই এখনও মেয়েদের পরিবার পরিদর্শনের অভ্যাস ধরে রেখেছেন। গত কয়েক বছরে তিনি মোট ১.১ লাখ কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন এবং ১৫০০জন শিক্ষার্থীর পরিবার পরিদর্শন করেছেন। তাঁর স্বপ্নের স্কুল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৮০৪জন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার র‍্যাংকিংয়ে টানা কয়েক বছর লি চিয়াং শহরের প্রথম স্থান দখলে রাখে স্কুলটি।

 

স্কুলের চীনা ভাষার শিক্ষক ওয়ে থাং ইউন বলেন, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ফলাফল দিন দিন ভাল করছে। তবে ছাং কুই মেই’র শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা তাঁর জন্য এখন কঠিন হয়ে পড়ছে।

 

গত সেপ্টেম্বর মাসে ছাং কুই মেই  তাঁর সাবেক দুজন শিক্ষার্থীর ফোন পেয়েছেন। দুজন মেয়ে সৈনিক হয়েছে এবং তিব্বতে যাবে। যাওয়ার আগে তারা ছাং কুই মেইকে ফোন করেছে। দুজনের তিব্বতে যাওয়ার কথা শুনে চিন্তিত হন ছাং, কারণ সেখানে উচ্চতা বেশি এবং অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। তবে মেয়েরা হেসে হেসে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আপনি সবসময় আমাদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন যে, সুযোগ পেলে কঠোর জায়গায় প্রশিক্ষণ নেয়া উচিৎ।

 

চৌ লি ইউন এ স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্রীদের অন্যতম একজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একজন শিক্ষক হিসেবে স্কুলটিতে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ছোট বেলায় তাঁর মা মারা গেছেন, তাঁর বাবা একজন প্রতিবন্ধী। তাঁর বড় একজন বোন আছেন। দুজন মেয়ে যখন বিনামূল্যের হাই স্কুলের কথা শুনেছিলেন, তখন তাঁরা যেন জীবন রক্ষাকারী কাউকে খোঁজে পেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, এ হাই স্কুল ছাড়া তিনি মানুষ হতে পারতেন না। ২০১৫ সালে যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া-লেখা শেষ করেছিলেন, তখন তিনি ভাল একটি চাকরির সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিনা দ্বিধায়  হুয়া পিং হাই স্কুলে ফিরে এসেছেন। কারণ ছাং কুই মেই’র একটি কথা সবসময় তাঁর মনে গেঁথে ছিল। আর তা হলো, যখন আমরা শক্তিশালি হই তখন অন্যদেরকে সাহায্য করা উচিৎ।

 

প্রতি বছরের শিক্ষার্থীদের স্কুল জীবন সমাপনীর সময়টি ছাং কুই মেই’র খুবই প্রিয়। কারণ এ সময়ে  তাঁর সাবেক শিক্ষার্থীরা ছাং এর  সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং  তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাঁকে জানায়। প্রতিদিন দুপুরে স্কুলে প্রচারিত হয় ‘লাল বড়ইটির প্রশংসা’ নামে একটি গান। এটি ছাং কুই মেই’র প্রিয় একটি গান এবং ছাত্রীরা সবসময় একসঙ্গে এ গানটি গায়। লাল বড়ই শীত্কালে ফুটা একটি ফুল। তা সাহস ও শক্তির প্রতীক। এ ফুলটি ছাং কুই মেই’র বিশ্বাস ও  জীবনের প্রতিফলন।(শিশির/এনাম/রুবি)