২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের যোগাযোগ তথা অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতের জন্য একটি মাইলফলক। এদিন প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড়কে যুক্ত করে দিগন্ত জুড়ে দাঁড়ায় স্বপ্নের পদ্মাসেতু! দেশের বৃহত্তম সেতুটি পূর্ণ অবয়ব পায় এ দিনটিতে। আর এ স্বপ্নের সারথী বন্ধুরাষ্ট্র চীন।
করোনা মহামারি পরিস্থিতির জন্য চলতি বছর কাজে ধীরগতি থাকলেও নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসে দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে নেন চীন ও বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও কর্মীরা। শেষ দু’মাসে পদ্মার ওপর গড়ে ওঠা মজবুত ভিতের ওপর একের পর এক বসতে থাকে স্প্যানগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১ ও শেষ স্প্যানটি। দৃশ্যমান হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরো সেতুর কাঠামো। যুক্ত হয় পদ্মার দুই পাড়!
আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে পদ্মা-বিধৌত জনপদ পেরিয়ে গোটা দেশে। কেননা শুধুমাত্র পাথর আর রড-সিমেন্টে তৈরি নয় এ সেতু। এর সঙ্গে জড়িয়ে ১৭ কোটি মানুষের আবেগ-স্বপ্ন। বিজয়ের মাসে সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে যেনো আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো বাংলাদেশের। যোগাযোগসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর এখন পদ্মাপারের মানুষ!
১৯৯৮ সালে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরই দক্ষণিাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতার পালাবদলে পরের ৭ বছর আর কাজ এগোয়নি। স্থান নির্ধারণের পর অর্থায়ন জটিলতায় আরো পাঁচ বছর। এক পর্যায়ে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ এনে সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থাগুলো। যদিও কানাডার আদালতে শেষ পর্যন্ত সে অভিযোগ টেকেনি।
নানা জটিলতার মধ্যে ২০১৩ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর ফের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার বন্ধুরাষ্ট্র চীন। সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। কাজ শেষ হবার কথা ২০১৮ সালের মধ্যে। কিন্তু পদ্মার তলদেশে মাটির গঠন বৈচিত্র্যের কারণ কাজ পিছিয়ে যায়। সাড়ে চার বছর লেগে যায় শুধু সেতুর খুঁটি বসানোর কাজে। পরের তিন বছর স্প্যান বসাতে।
অবশেষে স্বপ্নের সেই সেতু এখন বাস্তব রূপে। এর ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি যুক্ত হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্যই বাংলাদেশ অসম্ভকে সম্ভব করেছে। এ গৌরবের সহযাত্রী চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান সেতুমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর বাকি কাজ শেষ করে যানচলাচল শুরু হতে এখনো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। সেতুটি চালু হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে অভিমত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের। আন্তর্জাতিক মানের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার ফলে এশিয়ান হাইওয়েতে আরো ভালোভাবে যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ। এতে সার্বিকভাবে মজবুত হবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। সেতুর দুপাশে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি আসবে। মোট দেশজ উৎপাদ-জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ মনে করেন, সেতুটির কারণে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এতে কর্মসংস্থান, উৎপাদন, পণ্য সরবরাহ বাড়বে; জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি কমবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। সার্বিকভাবে পদ্মাসেতু দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে বলে অভিমত অধ্যাপক আকাশের।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।