তাসি এলাকায় পানি-সমস্যা সমাধানের গল্প
2020-12-09 14:37:59

তাসি এলাকায় পানি-সমস্যা সমাধানের গল্প

কুয়াং সি প্রদেশের তাসি এলাকা, চীনের চরম পানি-সংকটে ভোগা একটি জায়গা ছিল। তা সি চীনা ভাষায় মানে বড় পাথর এবং নাম থেকে বোঝা যায় এটা পাহাড়ি অঞ্চল। এখানে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া ছিল কঠিন এক ব্যাপার। একটি লোকসংগীতে এমন কথা আছে: মধ্যরাতে বের হয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করে ভোরে পানি খুঁজে পাওয়া যায়/ পানি নিয়ে ফিরে আসতে আবার সূর্যাস্তের সময় হয়ে যায়। জনপ্রিয় এ পুরাতন লোকসংগীতে প্রতিফলিত হয় স্থানীয়দের পানির সংকটের কথা।

কুয়াং সি প্রদেশের তা সি এলাকায় অন্তর্ভুক্ত আছে ৬টি শহর ও ৩০টি জেলা। বিশেষ কার্স্ট ল্যান্ডফর্ম-এর কারণে এখানে পানি সহজে মাটিতে সংরক্ষণ করা যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে স্থানীয় মানুষ খাওয়ার পানির জন্য কেবল আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে এসেছে এবাং পানির সংকট স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নের পথে ছিল বৃহত্তম বাধা।

লং চিন ইং নামের একজন নারী খুং মিন গ্রামের একজন বাসিন্দা। পানি পাওয়া ছিল তার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। একসময় প্রতিদিন জেগে ওঠার পর তার প্রথম কাজ ছিল বাইরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করা। দেরি হলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিদিন তিনি ৫ বারের মতো পানি নিয়ে যেতেন। ওঠা ও নামায় মোট ১৭০০টির বেশি সিঁড়ির ধাপ তাকে অতিক্রম কতে হতো। সিঁড়ি আবার মাঝে মাঝে পিচ্ছিল হতো। একবার তিনি প্রায় পাহাড়ের সিঁড়ি থেকে নিচে পরে গিয়েছিলেন। সে কথা ভাবতে এখনও তার ভয় হয়। কিন্তু সেই কষ্ট দিন এখন আর নাই। এখন তার বাড়িতে কলের পানি আছে এবং  এ পানি খেতে খুব মিষ্টি। আর বাইরে গিয়ে পানি আনতে হয় না তাকে।  

অন্যদিকে, ফেং ইউন এ্য নামের একজন নারী দশ-বারো বছর আগে কুয়াং তুং প্রদেশ থেকে লং সুয়ান গ্রামে আসেন, বিয়ের সূত্রে। স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী, নতুন বউ প্রথম কয়েক বছর পানি আনা-নেওয়ার দায়িত্ব পালন করে। পানি আনা-নেওয়ার পথ খুব খারাপ। একবার বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে যায় এবং তিনি পরে গিয়ে ব্যথা পান। তার হাত থেকে পানির ঘটা ছিটকে পড়ে। একদিনের কঠিন কাজ তার বৃথা হয়ে যায়। তিনি রাস্তার পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাইরে থেকে এখানে আসা সকল নতুন বউয়ের তার মতো এমন অভিজ্ঞতা আছে। তাদের অনেকে আবার এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাও করতেন।

যারা তাসি এলাকায় বাস করেন তাদের জন্য প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করা ছিল সবচেয়ে বড় একটি কাজ। লং হ্য গ্রামের বাসিন্দা চেন চিয়া থিয়ান  বাড়ির দুটি বড় জলের ট্যাঙ্কের দিকে ইশারা করে বলেন, “যখন আমি জন্মগ্রহণ করি, তখন এ দুটি জলের ট্যাঙ্ক এখানে ছিল।” ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন তিনি ভোরে পানি আনতে বাইরে যেতেন। গেল ৩০ বছরে তিনি দিনের পর দিন এ কাজ করে গেছেন। জলের ট্যাঙ্ক পূর্ণ না-হলে অন্য কাজ করা যেতো না।

পানির অভাব এতদঞ্চলের মানুষের অভিন্ন স্মৃতি। চিয়াং থুয়ান গ্রামের ৭৮ বছর বয়সী মেং কুই চেন স্মরণ করে বলেন, তার চাচা একবার পানি নিয়ে ফিরে আসছিলেন এবং বাড়ির সামনে দুর্ঘটনাক্রমে জল ছড়িয়ে পড়ে। তার খুব রাগ হয়েছিল। তিনি নিজের জুতা ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলেন। তখন এক বেসিন পানি দিয়ে প্রথমে সবজি ধোয়া হতো এবং তারপর সেই ধোয়া-পানি দিয়ে পা ধোয়া হতো। আবার সেই পা-ধোয়া পানি পশুকে পান করতে দেওয়া হতো। এক বেসিন পানি কয়েক বার ব্যবহার করা ছিল স্থানীয়দের অভ্যাস।

তাসি এলাকায় পানি-সমস্যা সমাধানের গল্প

পানি তাসি এলাকার মানুষের প্রত্যাশা এবং গ্রামের সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০ শতাব্দীর ৮০ দশকে  নেই রুয়ান নামের জায়গায় একটি ঝরণা ছিল এবং সেটা ছিল সারা গ্রামের একমাত্র পানির উত্স। নেই রুয়ানের মানুষ এ ঝরণার জন্য গর্বিত। আশেপাশের মেয়েরা প্রতিদিন এখানে পানি নিতে আসতো। তাই স্থানীয় মানুষের জন্য বউ পাওয়া ছিল সহজতর। একটি ঝরণা একটি গ্রামের ইতিহাসের স্বাক্ষী।

ছি পাই নং উপজেলা একটি ইয়াও জাতির অধ্যুষিত এলাকা এবং এখানে বাসিত ইয়াও জাতির মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম খারাপ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে। এখন শীতকালেও ছি পাই নংয়ের সব পাহাড় সবুজ রঙের। পাহাড়ে ছোট বা বড় আকারের জলের ট্যাঙ্ক দেখা যায়। ৬৭ বছর বয়সী মেং কুই খুয়ান বলেন, জলের ট্যাঙ্ক নির্মাণ ও সরক্ষণে সহায়তা দিয়েছে সরকার। আগে ঝুড়ি দিয়ে পানি আনা-নেওয়া করতে ৪ ঘন্টা লাগ। এখন এক মিনিটে এক বালতি জল নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা যায়। তাসি এলাকার দারিদ্র্যবিমোচন আসলে পানির প্রাপ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। কঠোর পরিস্থিতি সম্মুখীন হয়ে তা হুয়া জেলার সকল মানুষের প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ জেলায় নির্মিত হয় কেন্দ্রীভূত জল সরবরাহ প্রকল্প ১৩৪টি এবং পারিবারিক জলের ট্যাঙ্ক ৫২৯৩টি। মোট ৬৬ হাজার মানুষ এ থেকে উপকৃত হয়েছে।

লং আন জেলায় পানির সংকট ছিল এমন ১৫টি গ্রামকে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করা হয় এবং অন্য জায়গা থেকে এ ৫টি অঞ্চলে পানি সরাবরাহ করা শুরু হয়। পাহাড়ে চাপ স্টেশন স্থাপন করতে চাইলে ইস্পাতের নল প্রয়োজন। সাধারণত ৪ জন মানুষ এ নলকে উঠাতে পারে, তবে পাহাড়ে উঠিয়ে নিতে ১১ জন লাগে। এমন কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে পানির সংকট দূর হয়। ২০১৮ সালে চেন চিয়া থিয়ানের জন্মস্থানে একটি জলের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০ হাজার মানুষের পানির সংকট দূর হয়। এখন তিনি এ কারখানায় কাজ করেন এবং পাহাড়ে পাইপ নেটওয়ার্ক ও সরঞ্জাম সংরক্ষণ করা তার নিয়মিত কাজ। তুং শান উপজেলায় ২০১৯ সালের চার মাসের কাজ শেষ হয়ে গেলে পানি পাহাড়ের নীচ থেকে উপরে তুলে আনা শুরু হয়। উত্স থেকে পাহাড়ের ওপর পর্যন্ত উচ্চতা ৫৩৭ মিটার। পাহাড়ে বাসিত মানুষ এখন বাড়িতে পরিষ্কার পানি খেতে পারেন।

পানি মানুষের জীবন পরিবর্তন করেছে। পানির জন্য দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে এবং আরও সুন্দর জীবনের প্রতি মানুষের আগ্রহও বাড়ছে। আগে স্থানীয়রা  পশুপালন করতে পারতেন না। কারণ ছিল পানির অভাব। এমনও হয়েছে যে, পানির অভাবে গবাদিপশু মারা যেত এন্তার। একসময় গ্রামবাসিন্দারা পশুপালন ত্যাগ করেন। এখন পানির সংকট দূর হয়েছে এবং গ্রামের মানুষও পশুপালন করা শুরু করেছে। পশুপালনের মাধ্যমে গ্রাম হয়েছে দারিদ্র্যমুক্ত।

পশুপালন ছাড়া চাষের শিল্পও উন্নয়ন হচ্ছে। চিয়াং থুয়ান গ্রামে তুঁত রোপণ এবং সেরিকালচার উন্নয়ন হয়েছে। ৩২ বছর বয়সী মেং ইং ছুও বলেন, আগে পানির অভাবের কারণে গাছপালা বেঁচে থাকতে পারতো না। তিনি তখন কুয়াং তুং প্রদেশে কাজ করে দু’পয়সা আয় করতেন। গত বছর পানির সমস্যা সমাধানের পর তিনি গ্রামে ফিরে এসেছেন এবং ৯০ মু জমি ভাড়া করেছেন। এখন তিনি তুঁত রোপণ করেন এবং অনুমান অনুযায়ী চলতি বছরে তার আয় ১ লাখ ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে। তা ছাড়া, স্থানীয় মানুষ ভেষজ, আখরোট এবং বিবিধ শস্য এবং মটরশুটিও চাষ করেন। যুবক-যুবতীরাও গ্রামে ফিরে আসছেন। ৪ বছর আগে ৩২ বছর বয়সী লান ইয়ান চুন ও তার ৪ জন বন্ধু গ্রামে ফিরে আসেন এবং দুটি মুর্গি চাষের খামার নির্মাণ করেন। এখন তাদের উদ্যোগে স্থানীয় ১৩০টি পরিবার মুর্গি চাষের কাজে অংশগ্রহণ করছে এবং তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল দরিদ্র পরিবার। পাহাড়ে ৫টি জলের ট্যাংক তাদের শিল্পকে সমর্থন দিয়েছে। মুর্গি চাষের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। লান ইয়ান চুন বলেন,  পানি না থাকলে আমাদের ব্যবসা সফল হতে পারত না। (শিশির/আলিম/রুবি)