চীনের মিন ছুয়ান বন খামারে তিন প্রজন্মের বন রক্ষাকারীর গল্প
2020-12-04 18:54:12

চীনের মিন ছুয়ান বন খামারে তিন প্রজন্মের বন রক্ষাকারীর গল্প

যদি একটি গাছের কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে আপনার মনে কেমন ছবি ভেসে উঠবে? হয়তো পাহাড়-পর্বতের মধ্যে উঁচু উঁচু বৃক্ষরাজি; হয়তো মরুভূমির মধ্যে এক টুকরো মরূদ্যান! তাই না?

 

তবে চীনের হ্যনান প্রদেশের মিছুয়ান জেলার বন খামারের লোকজনের কাছে, গাছ শুধু তাদের রক্ষাকারীই নয়, বরং তাদের নিজেদের জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে, তিন প্রজন্মের বন এলাকার মানুষ চীনের হলুদ নদীর তীর রক্ষা করেছেন, তাঁরা নিজের হাতে সেখানে একটি ‘সবুজ মহাপ্রাচীর’ নির্মাণ করেছেন।

 

৮৬ বছর বয়সী বৃদ্ধ খাং সিন ইয়ু হলেন মিন ছুয়ান বন খামারের প্রথম প্রজন্মের বন রক্ষাকারী। চলতি বছর হল বৃদ্ধ খাং মিন ছুয়ানের এই বন খামারে আসার ৬৫তম বার্ষিকী। যদিও তিনি এখন অবসর নিয়েছেন, তবে তিনি এখনও মাঝে মাঝে খামারে এসে তাঁর কাজের জায়গা ঘুরে যান। পুরানো দিনের চিরচেনা অভ্যাস এখনও ভুলতে পারেননি তিনি।

 

বৃদ্ধ খাং অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, তখন ছিল বসন্তকাল। হলুদ বালি বাতাসে ভেসে বেড়াতো, সূর্য দেখা যেত না। মানুষের মুখে, গলায় সবখানে বালি লেগে থাকত।

মাটির গুহা হল মিনছুয়ান বন খামারের প্রথম প্রজন্মের মানুষের অভিন্ন স্মৃতি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব দুর্বল ছিল। তাই খাং ও তাঁর সহকর্মীরা দিনের বেলা বনে চাষ করতেন, রাতে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা গুহায় শুয়ে থাকতেন। খাবার বলতে ছিল ভুট্টা দিয়ে তৈরি করা রুটি।

 

সি লি চুং হলেন খাং-এর শিক্ষার্থী। তিনি হলেন মিন ছুয়ান বন খামারের দ্বিতীয় প্রজন্মের বন রক্ষাকারী। আর মাত্র দুই বছর পর তিনিও অবসর যাবেন। তিনি জীবনের অর্ধেক সময় মিন ছুয়ান বন খামারে দিয়েছেন। এই বন খামার সম্পর্কে সি-এর বিশেষ অনুভূতি আছে।

 

প্রথম প্রজন্মের বন রক্ষাকারীর মতো বন তৈরির কাজ করা সহজ নয়। মিন ছুয়ান বন খামারের দ্বিতীয় প্রজন্মের বন রক্ষাকারী হিসেবে, সি-এর কাঁধেও ভারী দায়িত্ব চেপে বসে।

 

তিনি অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, যখন প্রথম এই বন খামারে আসি, তখন এখানের অবস্থা ছিল খুব কঠিন ও জরাজীর্ণ। তখন বিদ্যুত্ ছিল না, পথ ছিল না, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল না। বন রক্ষা ও টহলের জন্য আমি ও আমার সহকর্মীরা বনে নির্মিত ছোট ঘরে থাকতাম। সি আরো জানান, এই ঘরের জানালায় কোনো কাঁচ ছিল না; শীতকালে বনের প্রচুর ঠান্ডা বাতাস আসত; ঘরে বাতাস প্রতিরোধের কোনো জিনিস ছিল না। রাতে তারা শীতে প্রায় অসাড় হয়ে যেতেন!

 

২০ শতাব্দীর ৮০ দশকে, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হয়। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বন খামার রূপান্তর পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। মিন ছুয়ান বন খামারের কাছে হ্যনান প্রদেশের অন্যান্য বন খামারগুলোর গাছ কাটা, বনভূমি ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক চাপ কিছুটা কমানো হয়। তবে, বেতন খুব কম হওয়ায় কিছু কিছু বন খামারের কর্মীরা চলে যায়। তবে সি’র সঙ্গে দ্বিতীয় প্রজন্মের মিন ছুয়ান বন খামারের কর্মীরা মনের জোরে টিকে আছেন।

 

তিনি মনে করেন, মিন ছুয়ান বন খামারের প্রথম প্রজন্মের বন রক্ষাকারীরা অনেক কঠিন অবস্থায় গাছের চাষ করেছেন। এখন তা বড় হয়ে বনভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ কঠিনতায় বন নষ্ট হবে না।

তিনি আরো বলেন, প্রবীণদের চেষ্টা ছাড়া এখানে অসীম বনভূমি তৈরি হতো না।

 

জনাব চাই ওয়েন চিয়ে ২০০৫ সালে মিন ছুয়ান বন খামারে যান। তিনি হলেন মিন ছুয়ান বন খামারের তৃতীয় প্রজন্মের কর্মী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে অনেক সহপাঠী চাকরির খোঁজে বাইরে যায়। তবে আমার মনে হয়, বনে থাকলেই কেবল আমার মনে শান্তি খুঁজে পাবে। তিনি বলেন, বন খামার আমার দাদার বাসা, আমার বাবার মাসা, তাই আমারও বাসা।

 

দ্বিতীয় প্রজন্মের বন রক্ষাকারী সি বলেন, আমাদের চেয়ে, তরুণ কর্মীদের বন পরিচালনার চিন্তাধারা বেশ আধুনিক এবং তাদের পেশাদার জ্ঞান আছে। আগে পরিসংখ্যান ও পরীক্ষা করতে, ঝড়-বৃষ্টি-বাতাস মাথায় নিয়ে আমাদের বাইরে যেতে হতো। এখন তরুণ কর্মীরা ডিজিটাল ম্যাপ উদ্ভাবন করেছেন, এর মাধ্যমে তারা তাত্ক্ষণিকভাবে বনের বিভিন্ন অবস্থা- বিশেষ করে অগ্নিকান্ডের অবস্থা তত্ত্বাবধান করা যায়। এমনকি মোবাইলফোন দিয়ে বনে টহলও বাস্তবায়ন করা যায়।

 

তৃতীয় প্রজন্মের বন রক্ষাকারী চাই বলেন, আমরা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রবীণ কর্মীদের উন্নয়নের চেতনা লালন করতে চাই, আমাদের মিন ছুয়ান বন খামারটি আরো সুন্দর এবং আরো ভালোভাবে তৈরি করতে চাই। এটাই হল আমাদের বরাবরের লক্ষ্য।

 

বন খামার উন্নয়নের মাধ্যমে এখন মিন ছুয়ান বন খামার  বাতাস ও বালি প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পর্যটনেও ভূমিকা রাখছে। প্রত্যেক ছুটিতে বন খামারে অনেক পর্যটক প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে ছুটে আসছে।

ভবিষ্যতে মিন ছুয়ান জেলা হোয়াংহ্য বা হলুদ নদীর তীরে আরও ৩৬ হাজার মু (এক মু ৬৬৬ বর্গমিটার) এলাকায় প্রাকৃতিক বনভূমি নির্মাণ করবে। হলুদ নদীর পাশে একটি প্রাকৃতিক করিডোরের নকশা তৈরি করা হয়েছে, যা এই বনভূমি উন্নয়নের নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।