চলুন বেড়িয়ে আসি: অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে
2020-12-04 15:15:23

চলুন বেড়িয়ে আসি: অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে

বলা হয়ে থাকে মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়ার এমন একটি শহর যে জাতি, বর্ণ, ভ্রমণের বাজেট নির্বিশেষে সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে বসে আছে ইয়ারা নদীর পাশে। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক মানুষ এখানে বাস করছে। উচ্চতর শিক্ষা, জীবিকা ও ঘুরবার জন্য প্রতি বছর বিশ্বের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে থাকে। কসমোপলিটন এই শহরটি সহজ নেভিগেশন, রাস্তার ধারের মন জুড়ানো ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে এবং স্ট্রিট মার্কেটের জন্য টুরিস্টদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়।

 

মেলবোর্নের দর্শনীয় স্থান

মেলবোর্ন সিটি সার্কেল ট্রাম : মেলবোর্ন  শহর কম খরচে প্রায় পুরোটা ঘুরে দেখবার এক অনন্য উপায় হলো এর সিটি সার্কেল ট্রামে চড়া। এটি যেমন এক অনন্য অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দেয় তেমনি প্রফেশনাল গাইডের বর্ণনার সাথে বিনা খরচে শহরের অনেক জায়গা দেখা যায়। এইসব ট্রাম থেকে সুবিধামতো এর যেকোন স্টপে ওঠানামা করা যায় ফলে নিজস্ব ঘুরবার প্ল্যানে কোন বাধা পরেনা।

 

ফ্লিন্ডারস স্ট্রিট স্টেশন :

মেলবোর্নের দক্ষিণে অবস্থিত ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনটি শহরটির প্রাচীন ও জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক গুলোর একটি। মেলবোর্নের মানুষের মুখে হরহামেশা একে অন্যকে বলতে শোনা যায় ‘তোমার সাথে ঘড়ির নিচে দেখা করবো’। এই কথাটি ফ্লিন্ডার স্টেশনের দালানে লাগানো ঘড়ির সারিকে নির্দেশ করে বলা হয়ে থাকে। ট্রেনে যাতায়াত এর উদ্দেশ্য বাদেও শুধুমাত্র স্টেশনটি দেখতে এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়।

পেঙ্গুইন প্যারাড :

অস্ট্রেলিয়ার ওয়াইল্ড লাইফের এক অনন্য নিদর্শন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাতির পেঙ্গুইন। প্রতিদিন সূর্য ডুববার সময় সাগর থেকে হাজার হাজার এই ছোট পেঙ্গুইনের মিছিল উঠে আসে বালিতে নিজের ঢিবিতে ফিরবার জন্য আর তাই দেখতে মানুষ পরিবার নিয়ে ভীড় করে মেলবোর্নের সাগর পাড়ে ফিলিপ আইল্যান্ডে।

গ্রেট ওশন রোডের ১২টি পাথরের স্তম্ভ :

পোর্ট ক্যাম্পবেল ন্যাশনাল পার্কের প্রধান আকর্ষণ হলো ১২ টি দৈত্যাকার পাথরের স্তম্ভ যা দক্ষিণের সাগরের উপর যেন কোন যাদুবলে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোকে বলা হয় টুয়েলভ এপস্টেলস। প্রায় ১০-১২ মিলিয়ন বছর আগে থেকে লাইমস্টোন এর এই পাথরের পাহাড় দক্ষিণের সমুদ্রের ঢেউ ও প্রবল বাতাসে ক্ষয়ে বর্তমানে এই ৪৫ মিটার উঁচু স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই পাথরের স্তম্ভে রঙ বদলানোর খেলা দেখা যায়।

পাফিং বিলি : পাফিং বিলি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে পুরনো এবং সংরক্ষিত বাষ্পচালিত ট্রেন। এই ট্রেনটি বর্তমানে পর্যটনের কাজে ব্যবহৃত হয় যা বেল্গ্রেভ এর জংগল থেকে গেম্ব্রুক পর্যন্ত ২৫ কিমি রাস্তা ঘুরিয়ে দেখায়। এই ট্রেনটিতে ফার্স্টক্লাস এর সাথে সাথে এলিগেন্ট ডাইনিং ও নাইট ট্রাভেলের ব্যবস্থাও রয়েছে। মেলবোর্ন থেকে বেল্গ্রেভ পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে সেখানকার স্টেশনে নেমে নীল রঙের লাইন ধরে গেলেই পাফিং বিলির দেখা পাওয়া যাবে।

 

হিলসভিল স্যাঙ্কচুয়ারি :

ইয়ারা রেঞ্জের পাদদেশে অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীদের প্রায় ২০০ টি প্রজাতি ও নানারকম গাছ গাছড়া নিয়ে এই স্যাংকচুয়ারিটি  গড়ে উঠেছে। এমু, কোয়ালা, প্লাটিপ্লাস, তাস্মানিয়ান ডেভিল সহ অনেককিছু এখানে রোজ দেখা যায় এবং প্রতিদিন বেলা ১২ টা এবং আড়াইটায় শিকারি পাখি নিয়ে একটি শো পর্যটকদের জন্য দেখানো হয়।

 

ইউরেকা স্কাই ডেক ৮৮ :

দক্ষিণে সবচেয়ে উঁচু এই জায়গাটি থেকে মেলবোর্ন শহরের প্রায় অনেকাংশ খালি চোখে দেখা যায়। স্কাই ডেকটি ৩০০ মিটার উঁচু থেকে একটি আপাদ মস্তক কাঁচে ঘেরা ঘর থেকে আপনাকে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কগুলো দেখবার সুযোগ করে দিবে।

ইয়ারা ভ্যালি :

ইয়ারা ভ্যালি মেলবোর্নের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে পর্যটকদের পদধূলির আশায়। এখানে আছে ওয়াইন তৈরির কারখানা, আঙুরের ক্ষেত, গ্রাম, বুটিক জিনিসের দোকান, ফসলের মাঠ। ভ্যালির মানুষজনের সহজ সরল জীবন দেখবার ও নিখাদ আতিথেয়তা পাবার সুযোগ মেলবোর্ন ঘুরতে আসলে কেউ হারাতে চায় না আর তাই ইয়ারা ভ্যালির অমলিন সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে সকলে ছুটে যায় পৃথিবীর নানাকোণ থেকে।

মেলবোর্ন ভ্রমণের সময়

সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর অর্থাৎ মেলবোর্নের বসন্তকাল এবং মার্চ থেকে মে মাস অর্থাৎ যখন মেলবোর্নে হেমন্ত আসে, এই সময়গুলো ঘুরবার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এই দুই সময়ে শহরটি পায়ে হেঁটে বা সাইকেল ঘুরবার জন্য বা নেহাত পার্কে বসে বারবিকিউ করবার জন্য সহনীয় তাপমাত্রায় থাকে।

কীভাবে যাবেন

বিমানে করে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মেলবোর্নে যাওয়া যায়, এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। পাসপোর্টের মেয়াদ ও অন্যান্য কাগজপত্র সঠিক ও যথাযথ থাকলে দ্রুত অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস থেকে আবেদন সাপেক্ষে ই-ভিসা পাওয়া সম্ভব।

মেলবোর্নে ভ্রমণের জন্য অস্ট্রেলিয়ার টুরিস্ট ভিসা আবশ্যক। এক্ষেত্রে টুরিস্ট ভিসা আবেদনের জন্য লাগবে কমপক্ষে ৬ মাসের মেয়াদ থাকা পাসপোর্ট। সাথে পুরাতন যত পাসপোর্ট আছে এবং পূর্বে কোথাও ভিসা আবেদন বাতিল হলে সেই দেশের কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা চিঠি। অস্ট্রেলিয়ান ভিসার ফিল আপ এবং ভিসা আবেদনকারীর স্বাক্ষর করা ফর্ম।এছাড়া লাগবে বর্ডার ছাড়া, সাদা ব্যকগ্রাউন্ডে তোলা দুটি পাসপোর্ট সাইজ সদ্য তোলা ছবি। এয়ারলাইন ও হোটেল রিসারভেশন, অস্ট্রেলিয়ায় কেউ থাকলে তার কাছ থেকে পাওয়া ইনভিটেশন লেটার, এনওসি লেটার, গত ৬ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও স্যালারি স্লিপ এবং পেশাগত জায়গার সমস্ত প্রকার প্রমান ভিসার সাথে জমা দিতে হয়।

এ সমস্ত কাগজপত্রের সাথে ভিসা অফিসারকে উদ্দেশ্য করে একটি কভার লেটার দিতে হয় যাতে আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য, ব্যায়ভার, দেশে ফেরত আসবার নিশ্চয়তা, থাকবার ব্যবস্থা ইত্যাদি বর্ণনা করে ভিসার আবেদন করতে হয়। সমস্ত কাগজপত্র ঠিক থাকলে এবং কোন প্রকার তথ্য গোপন না করলে দ্রুত ভিসা পাওয়া সম্ভব। এখানে টুরিস্ট ভিসা ফি ৯০৪০ টাকা তবে সাথে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ক্লায়েন্ট অনুযায়ী বায়োম্যাট্রিক কালেকশন এর জন্য সাথে আরও প্রায় ৩০০০ টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হয়।

কোথায় থাকবেন

যারা শহরের কোলাহল পছন্দ করেন তাদের জন্য মেলবোর্ন সিবিডি তে থাকা ভাল। এখানকার হোটেলগুলো একটু খরচ সাপেক্ষ যদিও কিন্তু সিবিডি থেকে বুরক স্ট্রিট, কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেট, ইউরেকা স্কাইডক, রয়াল বোটানিক গার্ডেন হেঁটে ঘোরা সম্ভব। সিবিডি থেকে ২ কিমি দূরে ডকল্যান্ড নামে জায়গাটি টুরিস্টদের থাকার জন্য আকর্ষণীয়। এই জায়গাটি ইতিহাদ স্টেডিয়াম ও ফেডারেশন স্কয়ারের কাছে অবস্থিত। শহরের কোলাহল এখানে অনেকটা কম এবং বিশ্রাম নেবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। বাজেট হোস্টেল, মিডবাজেট হোটেল, লাক্সারি হোটেল সব রকমের আবাসন এর ব্যবস্থা এখানের য়েছে। মেলবোর্নের ভিতরে আরেকটি মহল্লা হলো প্রাহরান। যারা নাইট লাইফ পছন্দ করেন এই জায়গাটি তাদের জন্য নানা বাজেটের হোটেল এবং হোস্টেল নিয়ে বসে আছে।

যারা হোটেলে না থেকে শহর থেকে একটু দূরে মহল্লা গুলোতে থাকতে চান তারা গামট্রি এবং এয়ার বি আন বি নামক ওয়েবসাইটে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এছাড়া নিজের বাজেট অনুযায়ী হোটেল খুঁজবার জন্য বুকিং ডট কম, ট্রিপ এডভাইসর, মাইট্রিপ ডট কম ইত্যাদি ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

কিছু টিপস

মেলবোর্নে প্রতি মাসেই কোন না কোন উৎসব লেগে থাকে। আপনি যখনই ভ্রমণ করুন না কেন, যাবার আগে সেই উৎসব গুলোর স্থান দেখে গেলে ভ্রমণের তালিকায় নতুন কিছু দেখবার ও উপভোগ করবার সম্ভাবনা বাড়বে।

মাইকি কার্ড কিনে সহজেই মেলবোর্নের পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট যেমন বাস ও ট্রেনে চড়ে পকেটের সাশ্রয় করে ঘোরাঘুরি করা সম্ভব। এই কার্ড এর মূল্য ৬ ডলার এবং যেকোন রিটেইল শপ বা ট্রেন স্টেশনে এই কার্ড কিনতে পাওয়া যায়।

মেলবোর্ন শহর ঘোরার সবচেয়ে ভাল উপায় হলো হেঁটে ঘুরে বেড়ানো। যদি কোন এক্সপার্ট গাইডের সাথে আপনি ঘুরতে চান শহরের অনেক জায়গাতেই দেখবেন ফ্লুরোগ্রিন কালারের টিশার্ট পরা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে যাদের গায়ে লেখা ‘I am free walking tour guide’,তারা আপনাকে বিনাপয়সায় শহর হেঁটে ঘুরে দেখাবে।

সমস্ত খাবার দোকান ও অন্যান্য দোকান বেশী রাত করে খোলা থাকেনা তাই ঘুরতে গেলে এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ায় খাবার আনার ব্যাপারে প্রচন্ড কড়াকড়ি সুতরাং যেকোনো খাবার বিমানে ভ্রমণের সময় সাথে থাকলে তা এয়ারপোর্টে ডিক্লেয়ার করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে ডিক্লেয়ার না করলে ২০০ থেকে ১০০০ ডলার জরিমানা হতে পারে।