চীনের গোল্ডেন রুস্টার অ্যাওয়ার্ড ১৯৮১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে প্রতিষ্ঠিত হয়। চীন ফেডারেশন অফ লিটারারি ও আর্ট সার্কেল এবং চাইনিজ ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী অ্যাওয়ার্ড বিতরণী কার্যক্রম এটি। একে চীনা চলচ্চিত্রের ‘বিশেষজ্ঞ পুরস্কার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
চলতি বছরের ৩৩তম গোল্ডেন রুস্টার অ্যাওয়ার্ড আগের চেয়ে একটু ভিন্ন ছিল। এ বছর তরুণদের চলচ্চিত্রের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে তরুণ পরিচালকদের চলচ্চিত্র তুলে ধরা, পুঁজি আকর্ষণ করা এবং সহযোগিতার প্লাটফর্ম স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি, এ বছর থেকে চীনের গোল্ডেন রুস্টার চলচ্চিত্র উত্সব প্রতিবছর চীনের সিয়ামেন শহরে আয়োজনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
চার দিনব্যাপী ৩৩তম গোল্ডেন রুস্টার চলচ্চিত্র উত্সব ২৮ নভেম্বর রাতে শেষ হয়েছে। এ নিয়ে সিয়ামেন শহর দ্বিতীয়বারের মতো গোল্ডেন রুস্টার চলচ্চিত্র উত্সবের আয়োজন করলো। চার দিনের মধ্যে নানা ধরনের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী, ফোরাম ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানসহ নানা বৈচিত্র্যময় কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। চলচ্চিত্র মহলের বিশেষজ্ঞদের মতে, সিয়ামেন শহরে অনুষ্ঠিত গোল্ডেন রুস্টার চলচ্চিত্র উত্সবের আকার ও আকর্ষণ শক্তি প্রতি বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত শাংহাই চলচ্চিত্র উত্সব এবং এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বেইজিং চলচ্চিত্র উত্সবের মতো। চলচ্চিত্র উত্সব আয়োজনকারী চীনের সব দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলোর মধ্যে সিয়ামেন শহর অন্যতম।
সিয়ামেন বড় শহর নয়, অন্য কথায় বলা যায়, এটি খুব ছোট একটি শহর। সিয়ামেন শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি সিয়ামেন দ্বীপে অবস্থিত। চীনের শহরগুলোর মধ্যে দ্বীপে অবস্থিত কেন্দ্রীয় এলাকা তা খুব বিরল। সিয়ামেন দ্বীপের আয়তন মাত্র ১৫৮ বর্গকিলোমিটার। যা মহানগরী বেইজিংয়ের ছাওইয়াং জেলার এক তৃতীয়াংশ। তবে ছোট এই দ্বীপে চীনের চলচ্চিত্রের নতুন শক্তি দেখা দিয়েছে।
চীনের সব উপকূলীয় শহরগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সিয়ামেনের যোগাযোগ খুব বেশি দিন আগের নয়। সিয়ামেন শহরের চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শুরু হয় ১৯১৮ সালে।
সেই সময় মেন্স ক্রিস্টিয়ান অ্যাসোসিএশন বিদেশ থেকে মুভি এনে সদস্যদের বিনামূল্যে দেখাতো। প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মূলত খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা হতো। তাতে বিদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও দেখা যেতো।
১৯২২ সালে সিয়ামেনের প্রথম সিনেমা হল খোলা হয়। তারপর কয়েক বছরে দেশি-বিদেশি ফিল্ম সিয়ামেনে প্রদর্শিত হয়। এতে অনেক ব্যবসায়ী চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বাণিজ্যিক সুযোগ বুঝতে পারেন। সিনেমা হল নির্মাণে তাঁরা কিছু পুঁজিও বিনিয়োগ করেছিলেন। ১৯২৯ সাল পর্যন্ত সিয়ামেনে মোট ১৩টি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ‘Burning Paradise in Hell’ এবং ‘The hero in northeast’সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় নির্বাক চলচ্চিত্র সিয়ামেন শহরে ধারণ করা হয়।
১৯২৯ সালে প্রথমবারের মতো সিয়ামেনে আবির্ভূত হয় সবাক চলচ্চিত্র। তারপর সিয়ামেনের চলচ্চিত্র শিল্প দ্রুত গতিতে উন্নত হতে থাকে। ১৯৩৮ সালের মে মাসে সিয়ামেন জাপানি বাহিনী দখল করে নেয়। সিয়ামেনের সবচেয়ে বিখ্যাত সিমিং থিয়েটারে বাধ্যতামূলকভাবে জাপানি কোম্পানির তৈরি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হতো। আর অন্যান্য সিনেমা হল বলপ্রয়োগে বন্ধ করা হতো।
চীনা জাতির জাপানি আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধের পর সিয়ামেনের সিনেমা হলের সংখ্যা অনেক কম ছিলো। শুধু তাই নয়, সিনেমা হলের সরঞ্জামও অনেক পুরনো এবং বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। সিয়ামেনের প্রাবাসী চীনাদের প্রচেষ্টায়, বিশেষ করে- ‘হ্যদ্য চলচ্চিত্র শিল্প কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কোম্পানি সিয়ামেনের সিনেমা হল পুনর্নির্মাণে সাহায্য করে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সিয়ামেনে সিনেমা হলও চালু হয়।
১৯৪৮ সালের শেষ দিকে সিয়ামেনের ওপর অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ছোট বড় সিনেমা হলগুলো ক্রমশ বন্ধ হতে থাকে এবং শুধুমাত্র তিনটি হল চালু থাকে।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সিয়ামেনের সিনেমা হলের সংখ্যা ১১টিতে পৌঁছায়। তা ছাড়া, আরো ১০টি প্রদর্শন দলও প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রদর্শন হলের উদ্যোগে যথাক্রমে ‘শিশু চলচ্চিত্র সপ্তাহ’, ‘তরুণ চলচ্চিত্র সপ্তাহ’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ১০ম বার্ষিকীতে নতুন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাস’সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। বলা যায়, সিয়ামেনের উদ্যোগে বড় আকারের চলচ্চিত্র কার্যক্রম আয়োজনের ইতিহাস ছয় দশকের কিছু বেশি সময়ের।
সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হলে সিয়ামেনের চলচ্চিত্র শিল্প দ্রুত গতিতে উন্নত হতে থাকে। ১৯৭৯ সালে সিয়ামেন শহরে মোট ৩৩৩টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল।
সিয়ামেনকে গোল্ডন রুস্টার অ্যাওয়ার্ড বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজনের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাত্ করে নেওয়া হয়েছে- এমনটি নয়। সিয়ামেনের নিজেরও কিছু প্রাধান্য আছে।
সিয়ামেনের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ সুন্দর এবং আবহাওয়া অনেক আরামদায়ক। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৫ সালের পর প্রতি বছর মোট ২০০ বা ৩০০টি চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক সিয়ামেনে ধারণ করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক খাতে সিয়ামেন সরকার সমর্থনের মাত্রা বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সিয়ামেন শহরে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক শিল্প উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা গৃহীত হয়। এতে ‘চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক প্লাসের’ ধারণা উত্থাপন করা হয়। এই ধারণা অনুযায়ী চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক শিল্প এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্প, ফ্যাশন ও পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমন্বয় করে পুরো শিল্প চেইনের উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারীর অবস্থা গুরুতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে চীনা চলচ্চিত্রের এগিয়ে যাওয়ার গতি এক মুহূর্তের জন্যও থামে নি। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে সারা দেশের বক্সঅফিসের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩৫.১ কোটি ইউয়ান। সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করেছেন মোট সাড়ে ১৬ কোটি দর্শক। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে গোটা চীনের বক্সঅফিসের মোট আয় হয়েছিল ৮৬১.৬ কোটি ইউয়ান।
(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)