ভাইরাসের বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাব: মোকাবিলার চীনা উপায়
2020-12-02 10:42:25

ভাইরাসের বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাব: মোকাবিলার চীনা উপায়

সম্প্রতি বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ৬ কোটি ছাড়িয়েছে। কোন কোন দেশ আবার চালু করেছে লকডাউন। উহানের পর চীনের হেই লং চিয়াং প্রদেশের হার্বিন, চিলিন প্রদেশের হুলান, বেইজিং, সিনচিয়াংয়ের উরুমুছি, লিয়াও নিং প্রদেশের তা লিয়ান, শানতুং প্রদেশের ছিংতাও, শাংহাই, আনহুই প্রদেশ ও থিয়ান চিন শহরে পর্যায়ক্রমে ভাইরাসের বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাবও দেখা যায়। এ ধরনের আঞ্চলিক মহামারি যেন ছোট শিখার মতো, প্রতিরোধ না-করলে বড় আকারের আগুন সৃষ্টি হতে পারে।

হঠাত্ করে শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি, যা ১৯১৮ সালের ফ্লু প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুতর সংক্রামক রোগ তথা প্যান্ডামিক। এটি সবচেয়ে কঠিন ভাইরাস। মহামারি প্রতিরোধের প্রথম উপায় হল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সকল মানুষকে ভাইরাস পরীক্ষা করা। ১১ জুন, বেইজিংয়ে একজন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হন এবং টানা ৫০ দিন কোন রোগী না-পাওয়ার রের্কড সৃষ্টি হয়। বেইজিংয়ের স্থায়ী লোকসংখ্যা ২.১ কোটি এবং এতো বড় এক শহরে ভাইরাসকে ট্র্যাকিং করা সহজ একটি কাজ নয়। সংশ্লিষ্ট সকল মানুষকে পরীক্ষা করা ভাইরাসের সঙ্গে রেসিংয়ের প্রথম পদক্ষেপ। ২০ দিনের মধ্যে বেইজিংয়ে ১.১ কোটি মানুষকে ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকেন্দ্র ৭৫টি থেকে ১৯৪টিতে উন্নীত করা হয়। শীর্ষসময়ে ৪৮৫টি অস্থায়ী কেন্দ্রে ৩৪২৪টি টেস্ট স্পট স্থাপন করা হয়। প্রতিদিন ১২ লাখেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করা যায় এসব স্পটে। আবার ছিংতাও শহরে, ১১ অক্টোবর রাতে নিশ্চিত রোগী পাওয়া যায় এবং তখন থেকে সারা শহরে ব্যাপক পরীক্ষা কার্যক্রম চালু হয় এবং ১২০ ঘন্টা পর ১৭ অক্টোবার রাত ১২টার কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ১ কোটির বেশি নমুনা পরীক্ষা শেষ করা হয় এবং সব লক্ষণহীন রোগী খুঁজে পাওয়া যায়। তাই কমিউনিটিতে ভাইরাসের বড় আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি।

তবে অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যার পরীক্ষা করা সহজ একটি ব্যাপার নয়। উহানে যখন মহামারি মাত্র শুরু হয়, তখন নিউক্লিক অ্যাসিড পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সন্দেহজনক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতো না। নিউক্লিক অ্যাসিড পরীক্ষা দ্রুত না-করা হলে মহামারির প্রতিরোধ ও ঠেকানো সম্ভব না। তাই চীন সরকার পরীক্ষার সংখ্যা ও মান বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরুতে টেস্ট কিটের অভাব ছিল এবং প্রতিদিন ১০ হাজারটি টেস্ট করা যেতো। চীনা উত্পাদনের দক্ষতা টেস্ট কিটের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। পাশাপাশি পরীক্ষা সংস্থার কর্মীরা দিন-রাত কাজ করেন। শুরুতে হুলান শহরে যখন মহামারি দেখা যায় তখন চীনা রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সিপিসি সম্পাদক উ কুই চেন পরীক্ষাগারের কর্মীদের নিয়ে ২৪ ঘন্টার মতো কাজ করেছেন। সর্বোচ্চ একদিনে তারা মোট ৩৮০০টি নমুনা পরীক্ষা করেন, যা সাধারণ দিনের তুলনায় ৫ গুণ বেশি।

আবার সিন চিয়াং কাশি শহরে জরুরি অবস্থায় ২৫০০ জন পেশাদার ব্যক্তি নিয়ে গঠিত একটি অস্থায়ী দল সু ফু জেলায় যান এবং সরার জেলার ২ লাখ ৪৫ হাজার জনকে পরীক্ষা করেন। তারা ৪ দিনে ৪৭.৫ লাখ মানুষের ভাইরাস পরীক্ষা শেষ করেন।

পাশাপাশি, চীনে কোন একটি জায়গায় মহামারি দেখা দিলে, গোটা দেশ তাকে সাহায্য করে। সেখানে অস্থায়ী পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অন্যান্য অঞ্চলের পরীক্ষা সংস্থাও এতে যোগ দেয়। পরীক্ষার দক্ষতা প্রতিদিন ৩০০টি নমুনা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজারটিতে এবং ফলাফল পাওয়ার সময় ৬ দিন থেকে কমে আসে ৩-৬ ঘন্টায়। চীনা জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের পরিচালক মা সিয়াও ওয়ে বলেন, পরীক্ষার দক্ষতা উন্নয়নের কারণে সম্প্রতি চীনে কয়েকটি জায়গায় মহামারি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

ভাইরাসের বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাব: মোকাবিলার চীনা উপায়

পরীক্ষা ছাড়া, রোগীদের বিছিন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। মহামারি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেবল রোগীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে—এমন লোকদের বিচ্ছিন্ন করা যথেষ্ট নয়। ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ আছে—এমন লোকদেরকেও কোয়ারিন্টিনে রাখা জরুরি। বেইজিংয়ের সিনফাতি বাজারে শুরু হওয়া ওই বারের মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, একজন রোগী নিশ্চিত হলে ১০০টি রুম প্রস্তুত করতে হবে। কোয়ারিন্টিনের জন্য জায়গা ও হাসপাতাল প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হয়। অসাধারণ ও সবচেয়ে কঠোর প্রতিরোধব্যবস্থা খুব কম সময়ের মধ্যে অনুমোদন নিয়ে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে মাহামারি হয় সেখানে রাস্তা, কমিউনিটি, এমনকি এক একটি ভবন প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এলাকায় ভাগ করা হয় এবং সরকারি কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা দিন-রাতে নির্দিষ্ট এলাকায় কাজ করেন।

১২ অক্টোবর রাতে, ছিং তাও শহরে ১২জন কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর হয় এবং একজনের অবস্থা খুবই গুরুতর হয়। পরের দিন জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন আরও ৩ জন উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ছিংতাওয়ে পাঠান এবং তারা ৪ জন রোগীর চিকিত্সার দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি আরোগ্য রোগীদের রক্তরস বা প্লাজমা ৯০০০ এমএল পাঠানো হয়। উহান থেকে ছিং তাও পর্যন্ত বেইজিং সিয়ে হ্য হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ তু বিন প্রায় সব গুরুতর রোগীর চিকিত্সার কাজে অংশ নেন। তিনি বলেন, “আমরা হাল ছেড়ে দিতে পারি না। এক একজন রোগী সুস্থ হওয়া মানে আমাদের চিকিত্সার মান আরও উন্নত হওয়া।” আরোগ্য রোগীর রক্তরস বা প্লাজমা গুরুতর রোগীর চিকিত্সায় বেশ কাজে লাগে এবং চীন পরীক্ষামূলক বা বিতর্কিত ওষুধ ব্যবহার করে না। প্রতিরোধ, চিকিত্সা ও আরোগ্যসহ নানান পর্যায়ে চীন ঐতিহ্যিক ওষুধ বেশ ব্যবহার করে। প্রাচীন চীনা ওষুধ এতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার উপাত্ত থেকে জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল থেকে চীনে হাসপাতালে ভর্তি কোনো কোভিড-১৯ রোগী মারা যাননি।

পরীক্ষা, কোয়ারিন্টিন ও চিকিত্সা ছাড়া, ভাইরাসকে  ট্র্যাক করাও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। যখন ছিং তাও শহরে মহামারি হয় তখন শানতুং প্রাদেশিক সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশেষজ্ঞদলের উদ্যোগে ৩০ জন মহামারী-সংক্রান্ত পেশাদার ব্যক্তি ও ৮০০ জন পুলিশ ৭২ ঘন্টার মধ্যে মোট ১০ হাজার ঘন্টার ভিডিও বিশ্লেষণ করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার রুট খুঁজে বের করেন।

পাশাপাশি চীন প্রথমবারের মতো আমানিকৃত কোল্ড চেন খাবারের প্যাকেজ থেকে জীবিত ভাইরাস আবিষ্কার করে এবং প্রমাণ করে যে, ভাইরাসযুক্ত প্যাকেজ স্পর্শ করলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া সম্ভব।

মহামারিকে জয় করতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। বর্তমানে চীনে তৈরি ৫টি টিকার নানান দেশে তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিকেল ট্রায়াল  চলছে। চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবে বিশ্বে তার প্রবণতা শেষ হয়নি। বিদেশ থেকে ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধ করা পরবর্তী পর্যায়ে চীনের প্রতিরোধকাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হবে। (শিশির/আলিম/রুবি)