আজকের টপিক: ছাংএ্-৫ চন্দ্রযানে অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার
2020-12-01 16:26:24

ডিসেম্বর ১: ছাংএ্য ৫ চন্দ্রযান ইতোমধ্যে সাফল্যের সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেছে। আজকের টপিক আসরে ছাংএ ৫ মিশনের জটিলতা ও এতে ব্যবহৃত অগ্রসর প্রযুক্তি নিয়ে আলাপ করবো।

ছাংএ্য ৫ চীনের নিজস্ব গবেষণায় তৈরি প্রথম মানববিহীন মহাকাশযান যেটি চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে আসতে সক্ষম। তার এর প্রধান লক্ষ্য হলো চাঁদে যেখানে আগে অন্বেষণ করা হয়নি সেখান থেকে নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা। এসব নমুনা পেলে চাঁদের জন্ম ও বিবর্তনের ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ছাংএ্য ৫ যদি তার মিশনে সফল হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর চীন হবে সফলভাবে চাঁদ থেকে মাটির নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসা সক্ষম বিশ্বের তৃতীয় দেশ।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাপোলো প্রজেক্ট’ মানুষের মাধ্যমে চাঁদ থেকে ৩৮০ কিলোগ্রাম নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মানববিহীন যানের মাধ্যমে তিন বারে মোট ৩০০ গ্রাম নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। এবার চীনের ছাংএ্য ৫ চন্দ্রযান ২ কেজি ওজনের নমুনা নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। কেন ২ কেজি? এ সংখ্যাকে ছোট করে দেখবেন না, কারণ ঠিক কতো ওজনের নমুনা নেওয়া যাবে তা নির্ভর করে ছাংএ্য ৫-এর ওজন ও কোন রকেটের মাধ্যমে সেটিকে মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছে, তার ওপর।

১.

আগের ছাংএ্য ৪ থেকে ভিন্ন এবারের চন্দ্রযান। ছাংএ্য ৫ চীনের মাঝারি ওজনের রকেট লংমার্চ ৩-এর মাধ্যমে নয়, বরং বড় রকেট লংমার্চ ৫-এর মাধ্যমে মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছে। এর মূল কারণ ছাংএ্য ৫-এর ওজন প্রায় ৮২০০ কেজি। কেবল লংমার্চ-৫ এত বেশি ওজনের যান নিয়ে মহাকাশে যেতে পারে।

ওজন ছাড়াও, ছাংএ্য ৫-কে বলা যায় চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল মহাকাশযানগুলোর একটি। এতে আরোহী অংশ, ল্যান্ডিং অংশ, রিটার্নার অংশ এবং আরবিটার অংশ—এই চারটি ভাগ আছে। এসব অংশের কোনো কোনো অংশের জন্য খুবই অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, চাঁদের নমুনা সংগ্রহ, চাঁদ থেকে আরোহন, অরবিটারের সঙ্গে তার সংযুক্তি এবং পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

২.

ছাংএ্য ৫-র চাঁদে ল্যন্ডিংয়ের স্থানও অনেক বিবেচনার পর বেছে নেওয়া হয়েছে। চাঁদের কক্ষপথের নির্দিষ্ট অংশে ছাংএ্য ৫-এর ল্যান্ডিং অংশ অরবিটার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং চাঁদের উত্তর-পশ্চিম দিকের ১৩০০ মিটার উঁচু আগ্নেয়গিরির মধ্যে ল্যান্ড করবে। এর আগে কোনো মানুষ বা অনুসন্ধানযান এখানে পৌঁছায়নি।

কেন এ জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে? বৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিবেচনা করলে এ অঞ্চলের ভৌগৌলিক বয়স কম, প্রায় ৩৭০ কোটি বছরের কাছাকাছি। এখানকার মাটির নমুনা সংগ্রহ করলে চাঁদের জন্ম বা বিবর্তন নিয়ে আরো বেশি তথ্য জানা যাবে। প্রযুক্তির দিক থেকে বিবেচনা করলে, অনুসন্ধানকারী যানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে। তা ছাড়া, আরোহী অংশ চাঁদ থেকে উড্ডয়নের পর রিটার্নার ও আরবিটার অংশের সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথে সংযুক্ত হবে। অরবিটার অংশের সাথে একই লেভেলে থাকলে জ্বালানির সাশ্রয় হবে।

৩.

ছাংএ্য ৫ আরোহী অংশ ও ল্যান্ডিং অংশ চাঁদের ওপরে নামার পর দুই পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। একটা হলো পৃষ্ঠতল থেকে সরাসরি নেওয়া এবং ড্রিল করে মাটির নিচ থেকে নমুনা বের করা।

নমুনা সংগ্রহ করার পর ছাংএ ৫ চাঁদ থেকে উড্ডয়ন করবে। পৃথিবীতে এ ধরনের উড্ডয়নের জন্য উৎক্ষেপণ কাঠামো লাগে। কিন্তু পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদ থেকে উড্ডয়নের সময় আগে থেকে তৈরি কোনো উড্ডয়ন কাঠামো থাকবে না। তাই সেখান থেকে উড্ডয়ন হবে কঠিন। ল্যান্ডিংস্থল যদি সমান না হয়, তাহলে সমস্যা। ছাংএ্য ৫-এর আরোহী অংশ চাঁদ থেকে মহাকাশের দিকে উড্ডয়ন করা যেন চাঁদ থেকে মানবহীন যান উৎক্ষেপণ করা।  

আরোহী অংশ কক্ষপথে ফিরে যাওয়ার পর নমুনাগুলো রিটার্নারের কাছে স্থানান্তরিত করতে হবে। তার পূর্বশর্ত হলো আরোহী অংশ এবং অরবিটার অংশকে রিটার্নারের সঙ্গে নিখুঁতভাবে সংযুক্ত হতে হবে। সেটা বেশ জটিল একটা প্রক্রিয়া। এ কাজে চীনের জিপিএস ও পেইচৌ নেভিগেশন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। চাঁদের অভিকর্ষ বলও নিখুঁতভাবে হিসাব করতে হবে এসময়।  

পরের চ্যালেঞ্জ হলো নমুনাকে অরবিটারের রিটার্নারে স্থানান্তরিত করা। এমন কাজ নির্ভুলভাবে করাও খুবই কঠিন ও জটিল। এ ধরনের কাজ মানবজাতির ইতিহাসে হবে প্রথম।  

নমুনা রিটার্নারে দেওয়ার পর, অরবিটার ও রিটার্নারের সংযুক্ত অংশ আরোহী অংশ থেকে বিছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে।  

৪.

চীনের চাঁদ অনুসন্ধান অভিযানের মধ্যে অনুসন্ধানকারী যান চাঁদের অভিকর্ষ থেকে বেরিয়ে মহাকাশে গিয়ে এবং নিরাপদভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসার ঘটনাও এবারই প্রথম ঘটবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তা চীনের অন্তঃমঙ্গলিয়ার সিজি ওয়াংছি অঞ্চলে ল্যান্ড করবে। কিন্তু কিভাবে তা করবে সেটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রথমত, সবসময় অনুসন্ধানকারী যান ও চাঁদকে চোখে চোখে রাখতে চীনে অনেক গভীর মহাকাশ তত্ত্বাবধান স্টেশন নির্মাণ করতে হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ছাংএ্য ৫ চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসার সময় প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার দূরত্বে রিটার্নারকে ছেড়ে দেবে। তারপর রিটার্নার প্রতি সেকেন্ডে ১১ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এমন দ্রুত গতিতে কিভাবে নিরাপদে ল্যন্ডিং করা যায়? এ সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা আধা-ব্যালিস্টিক জাম্পের উপায় বের করেন। রিটার্নার প্রথমবার পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার পর এর গতি কমে যাবে এবং সেটি বায়ুমন্ডল থেকে বেরিয়ে যাবে, তারপর আবার বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে। দ্বিতীয়বার প্রবেশের পর গতি প্রতি সেকেন্ডে ৭ কিলোমিটারে নেমে আসবে।

মানবজাতির মহাকাশ অভিযানের দিক থেকে দেখলে, চীনের চাঁদ অনুসন্ধান শুধু একটি অধ্যায়ের একটি দৃশ্য। চীনে চাঁদ অনুসন্ধানবিজ্ঞানীর কথার মতো চাঁদ ও পৃথিবীর বাইরে গ্রহ অনুসন্ধান মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্য, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের একটি ফল এবং মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের পাখা। (স্বর্ণা/আলিম/ছাই)