সংবাদ পর্যালোচনা: আরসিইপি চুক্তির বিভিন্ন দিক
2020-11-28 18:16:43

দীর্ঘ আট বছর চেষ্টার পর অবশেষে গঠিত হয়েছে বিশ্বের ১৫টি দেশ ও অঞ্চলের সমন্বয়ে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ র্পাটনারশিপ (আরসিইপি) চুক্তি। আসিয়ান জোটের ১০টি দেশের সঙ্গে এই চুক্তিতে রয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ভারতের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ‘সস্তা চীনা পণ্যে তাদের বাজার ছেয়ে যাবে’ এমন অজুহাতে গতবছর তারা আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়। বিশ্ব বাণিজ্যে এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।

 

রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপি চুক্তি স্বাক্ষরকারী ১৫টি সদস্যদেশের জনসংখ্যা, সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের পরিমাণ বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে, এই চুক্তির অঞ্চলটি হলো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা। এটি যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও বড়।

 

চলমান মহামারীর প্রেক্ষাপটে চীন বিশ্বের একমাত্র বড় দেশ- যার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাই অনেক বিশ্লেষক বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে আসিয়ান জোটের দেশগুলো যে চরম অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই অবাধ বাণিজ্য চুক্তিতে সই করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।

 

অল্প কিছুদিন আগে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঘোষণা করেন যে, আগামী ১০ বছরে চীন সারা বিশ্ব থেকে ২২ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করবে। তিনি বলেছিলেন “চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার এবং এই বাজার আরো বড় হবে।" চীনের বাজারকে আরো উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সি।

 

আরসিইপি চুক্তিতে মোট ২০টি অধ্যায় আছে। এতে পণ্য বাণিজ্য, সেবা বাণিজ্য ও পুঁজি বিনিয়োগসহ বাজারে অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও রয়েছে বাণিজ্যের সুবিধাকরণ, মেধাস্বত্ব, ই-কমার্স, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নীতিমালা এবং সরকারি ক্রয়সহ বিভিন্ন নীতিগত বিষয়।

 

আরসিইপি চুক্তির কারণে এ অঞ্চলের গ্রাহকরা আরো কম দামে উচ্চ গুণগত মানের পণ্য কিনতে পারবেন। ভ্রমণও আরো সুবিধাজনক হবে। জনগণের যাতায়াত আরো স্বাধীন ও সুবিধাজনক হবে।  শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ আরো ভালো হবে এবং আরো বেশি মুনাফা অর্জন করা যাবে। আরো বেশি পুঁজি আকর্ষণ করা সম্ভব হবে।

 

আশা করা হচ্ছে এ চুক্তির ফলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে জোট এলাকায় এক-এক করে বেশিরভাগ আমদানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক উঠে যাবে এবং পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির একত্রীকরণের কাজ বেগবান হবে। টেলিযোগাযোগ, মেধাসত্ত্ব, ব্যাংক ও বীমার মত আর্থিক সেবা, ই-কমার্স এবং পেশাদারি সেবার মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোও এই চুক্তির আওতায় রয়েছে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো 'রুলস অব অরিজিন' অর্থাৎ কোন দেশে থেকে পণ্য আসছে তার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে। এসব সদস্য দেশগুলোর অনেকেরই নিজেদের মধ্যে ইতিমধ্যেই অবাধ বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, কিন্তু তাতে রুলস অব অরিজিন সম্পর্কিত নানারকম বিধিনিষেধও রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরসিইপি দেশগুলো বিশেষ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, যা আসিয়ান জোটের সদস্যদের নতুন এই বাণিজ্য চুক্তিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে।

যেমন, চুক্তি স্বাক্ষরের পর নিউজিল্যান্ড থেকে তৈরি উল শুল্ক ছাড়াই চীনে প্রবেশ করতে পারবে এবং চীন থেকে ফেব্রিক তৈরি করার পর তা শুল্ক ছাড়াই থাইল্যান্ডের গার্মেন্ট কারখানায় পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। এতে শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে গার্মেন্ট কারখানার উত্পাদন ও পরিবহন খরচ বিপুলভাবে কমে যাবে।

 

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে আসিয়ানের দশটি দেশের উদ্যোগে প্রথম এই চুক্তিটির প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ প্রস্তাবের স্বাক্ষরে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল শুল্ক ও শুল্কহীন পণ্যের বাধা কমানোর মাধ্যমে সমন্বিত বাজারের অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলের চুক্তি গঠন করা। তারপর গত আট বছরে ধরে চীনের উৎসাহ ও উদ্যোগে এটি বাস্তবে রূপ নেয়। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার, বিবিধ কাঠামো এবং সর্বাধিক উন্নয়নের সম্ভাবনাসহ একটি অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল বাস্তবে রূপ নিল।