আকাশ: সুপ্রিয় শ্রোতা, সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানে। আপনাদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন ‘রোববারের আলাপন’। আপনাদের সঙ্গে আছি আলিম এবং শিয়েনান আকাশ।
আকাশ: বন্ধুরা, জীবন প্রসঙ্গে একটি কথা আমার অনেক ভাল লাগে, তা হচ্ছে: যদি মানুষ জীবনের সত্য চেহারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে, তারতরও সে জীবনকে ভালবাসে; আর যে শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বড় আশা ত্যাগ করে না, সে-ই প্রকৃত বীর। বড় ভাই, আপনি কী বলেন?
আলিম:...
চীনের সি ছুয়ান প্রদেশের একজন মাদাম, তিনি ৮৪ বছর বয়সী, আমি মনে করি, তিনি একজন বীর। বন্ধুরা, আজকে আমি এবং বড় ভাই আপনাদের সাথে তাঁর গল্প শেয়ার করব, কেমন?
চীনের সিছুয়ান-তিব্বত মহাসড়কে, সবচেয়ে উঁচু একটি তুষারে-ঢাকা পাহাড় আছে, যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫১৩০ মিটার উঁচু। এই পাহাড়কে বলা হতো ‘নিষিদ্ধ এলাকা’। আমাদের আজকের গল্পের এ মাদাম এ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বলেন: “এর চেয়ে আরও উঁচু পাহাড় আছে, আমি দেখতে চাই!”
এ সিছুয়ান-তিব্বত হাইওয়েতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকে ভ্রমণ করেছেন।কিন্তু তাদের মধ্যে প্রবীণদের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের আজকের গল্পের এ মাদাম, তিনি মোটরসাইকেলে করে তিব্বতে যান। উনার বয়স ৮৪ বছর। কোনো ট্রাভেল এজেন্সি তাকে তিব্বতে নিয়ে যেতে সাহস পায়নি!
একদিন তাঁর ছেলে, ৫৪ বছর বয়ষী জনাব সং চিয়ান হুই তাঁর আম্মু, ম্যাদাম চেং চিং ফেইকে প্রশ্ন করেন: “তোমার এ জীবনে কোথায় তুমি সবেচয়ে বেশি যেতে চাও?”
তিনি উত্তর দেন: “তিব্বত!”
ছেলে কোনোভাবে ভাবতে পারেনি যে, তার মা এমন উত্তর দেবেন। আম্মু ছোটবেলায় গ্রামে ছিলেন, বাইরের জগত তিনি খুবই কম দেখেছেন।
সবাই জানান যে, তিব্বত যাওয়ার এ রাস্তা অত্যন্ত সুন্দর। কিন্তু রাস্তার বহু জায়গা উঁচু-নিচু। কিন্তু আম্মু বলেন: “এটা হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এখন না গেলে আর কবে যাবো!’
তাঁর ছেলের সবচেয়ে বড় সখ হচ্ছে বাইরে কাজ করা। অনেক বিবেচনা ও দ্বিধার পর, ছেলে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, ৮৪ বছর বষয়ী আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করানো; ঠিক করেন, মা-কে নিয়ে মোটরসাইকেলে তিব্বত যাবেন!
কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষের পর, দু’জন সব প্রয়োজনীয় জিনিষ ও সামগ্রী নিয়ে মোটরসাইকেলে করে রওয়ান হলেন।
সাধারণত তিব্বতে গেলে উঁচু জায়গার কারণে প্রথম প্রথম অনেকের সমস্যা হয়। বিশেষ করে প্রবীণদের বেশি সমস্যা হয়।
তিব্বতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ শুরুর আগে, ছেলে মা-কে সংশ্লিষ্ট ঔষধ খাইয়েছেন। পথেও বার বার থেমে রেস্ট নিয়েছেন।
“আম্মু, মাথা ব্যথা আছে?”
“নেই”
“শরীরে কোনো সমস্যা বোধ করছেন?”
“না”
তিনি আগে আম্মুর সাথে আলোচনা করে একমত হন, যদি শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে ফিরতি পথে বাড়ি ফিরবেন।
তবে খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, ভ্রমণে আম্মুর কোনো সমস্যা হয়নি। রাস্তায় একবার ৫১৩০ মিটার উঁচু পাহাড়ের শীর্ষস্থান অতিক্রম করতে হয়েছে। তখনও আম্মু বলেন, “কোনো সমস্যা নেই!”
বন্ধুরা, যদি আপনি তিব্বত বা তিব্বতের মতো উঁচু স্থানে, যেমন নেপালে বেড়াতে যান, তবে দেখবেন শরীরে কিছু সমস্যা দেখা দেবে। কেউ কেউ শ্বাসকষ্টে ভোগেন। কারণ, উঁচু জায়গায় অক্সিজেন কম। এ বাস্তবতায়, আম্মুর পাশে একজন তরুণ বিশ্রাম নিচ্ছেন, তিনি আম্মুর সবুজ সতেজ অবস্থা দেখে অনেক অবাক হয়ে গেছেন। তিনি আম্মুকে প্রসংশা করে বলেন, “মা, তুমি গ্রেট!!”
আম্মু প্রতিদিনের ভ্রমণ শেষ করার পর, হোটেলে শরীরচর্চা করেন। এর উদ্দেশ্য পেটের পেশী শক্তিশালী করা। তিনি একটানা ৫০টি sit-up শেষ করতে পারেন!
ভ্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁরা চলতিপথে অনেক সুন্দর জায়গা দেখেছেন। রাস্তায় আম্মু একজন শিশুর মতো আচরণ করেছেন কখনও কখনও। যেমন তাঁদের মোটরসাইকেল যখন একটি গাড়িকে ওভারটেক করে, তিনি অনেক আনন্দিত হন, হাসাহাসি করেন, বলেন, “দেখ, আমরা একটা গাড়ি ওভারটেক করছি!”এ ছাড়া আম্মু তরুণতরুণীর মতোই মোবাইলের মাধ্যমে অনেক দৃশ্যের ছবি তুলতে থাকেন। অনেকে বলেন, সারা জীবনে কমপক্ষে একবার তিব্বতে যাওয়া উচিত। আগে আম্মু এ কথা বেশি বুঝতেন না। তিনি এ সুন্দর জায়গায় এসে দেখেন তুষার পাহাড়, তৃণভূমি, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, লেক, মন্দির... এবং ভীষণ আনন্দিত হন।
অনেকে বলেন, ভ্রমণ করতে করতে মানুষ তরুণ হয়ে যায়। আম্মু অনেক সময় ছোট বাচ্চার মতোই আচরণ করছিলেন। কিন্তু আসলে ভ্রমণে, রাস্তায় তাঁরাও বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু আম্মু বলেন: “১০০ বছর বয়সেও আমি এখানে আসতে পারব!”
তাদের গল্প শুনে, কেউ কেউ অনেক প্রশংসা করেন, কেউ কেউ ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “এতে আপনি আম্মুকে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন নাকি তাকে নিয়ে বিপদে পড়তে যাচ্ছেন!?” ৮৪ বছর বয়সের আম্মু বলেন, “জীবন হচ্ছে অল্প দিনের। আফসোস করার কোনো মানে হয় না!”
সারা পথে অনেকে আম্মুর সাহস ও ছেলের মায়ের প্রতি ভক্তি দেখে প্রশংসা করেন। কেউ কেউ তাদের সঙ্গে ছবি তোলেন।
স্থানীয় গ্রামের অধিবাসীরা আম্মুকে চা ও গুরুর মাংস খাইয়েছেন, তাঁর গল্প শুনেছেন। একটি ঘটনা ছেলেকে অনেক মুগ্ধ করেছে। একবার বৃষ্টির সময়, একজন তিব্বতী মেয়ে আম্মুকে বর্ষাতি পরিয়ে দেন। আম্মু সিছুয়ান আঞ্চলিক ভাষা বলেন, এ মেয়ে তিব্বতী আঞ্চলিক ভাষা বলে। তাঁরা পরস্পরের কথা না-বুঝলেও এই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে।
তাদের বাসা থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা যেতে মোট ২০০০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়। অনেক কষ্ট শেষে অবশেষে তারা লাসায় অবস্থিত পোতালা প্রাসাদে গিয়ে হাজির হন। প্রাসাদের দরজায় পৌঁছানোর পর আম্মু বাচ্চার মতই লাফিয়ে ওঠেন। তিনি অনেক খুশি!
তাঁরা দুজন ১৫ দিনে মোট ৫০০০ কিলোমিটার মোটরসাইকেলে ভ্রমণ করেছেন। তাঁরা তাদের জম্মস্থানে ফিরে আসার পর, তাদের গল্প খুব দ্রুত মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। একজন অদ্ভুতভাবে আম্মুকে প্রশ্ন করেন: ‘আপনি এর পর আর কোন উঁচু জায়গায় যেতে চান? আর রেকর্ড গড়তে চান?”
আম্মু উত্তর দেন: “তিব্বতে যাওয়া হচ্ছে আমার সারা জীবনের স্বপ্ন, আমি ওখানে গিয়েছি রেকর্ড গড়ার জন্য নয়!” বন্ধুরা, আম্মুর জবাব কেমন হয়েছে?
বন্ধুরা, আম্মুর দৈনন্দিন জীবন আপনাদেরও পছন্দ হবে। তিনি নিজে ইলেক্ট্রিক অর্গান, আরহু, গিটার, হারমোনিকা, ভায়েলিন ইত্যাদি বাজানো শিখেছেন। তা ছাড়া তাঁর একটি note book আছে, যার ভিতরে আছে তার নিজের লেখা কবিতা।
আকাশ: বড় ভাই, এ আন্টির গল্প আমাকে অনেক অণুপ্রাণিত করেছে ও উৎসাহিত করেছে। একটি কথা মনে আসছে: আমাদের নিজ ভাগ্য আসলে আমাদের নিজেদের হাতে।