সাধারণের মধ্যে অসাধারণ একজন— করোনাভাইরাস প্রতিরোধের যুদ্ধে সাধারণ চীনা বীরের গল্প
2020-11-20 14:44:26

সাধারণের মধ্যে অসাধারণ একজন— করোনাভাইরাস প্রতিরোধের যুদ্ধে সাধারণ চীনা বীরের গল্প

 

চীনে এখন এমন একটি কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব জনপ্রিয়। তা হল “আপনি মনে করছেন, জীবন অনেক প্রশান্ত ও সুন্দর, এর কারণ হল কেউ একজন আপনার জন্য ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে সামনে এগুচ্ছে’।

২০২০ সালে চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উত্সবের সময় আকস্মিক করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হয়। চীনের চিকিত্সকরা ভাইরাস প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়াতে কোনো দ্বিধা করেন নি, তারা যমের সঙ্গে লড়াই করেছেন। গণ-পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটি কমিউনিটিতে দিন-রাত টহল দিয়েছেন, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছেন। এসব ‘সাধারণ বীর’ হাসপাতাল, কমিউনিটি ও রাস্তায় মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লড়াইয়ে সাধারণ কিছু বীরের গল্প তুলে ধরবো।

 

১. যখন করোনাভাইরাসের মহামারি প্রথম চীনের উ হান শহরে শুরু হয়, তখন হয়তো অনেকের ধারণা ছিল, উহান শহর ত্যাগ করাই ভালো। কিন্তু এমন একজন নারী ছিলেন, তিনি প্রতিরোধক পোশাক পরে কোনো দ্বিধা না করে উ হানে যান। তিনি চিকিত্সকদের সাহায্য করে যমের হাত থেকে রোগীর জীবন ছিনিয়ে এনেছেন। তিনি নারী হলেও ২০ কেজি ওজনের অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে পরিবহন করেছেন। তিনি তরুণ রোগীদের সাহসিকতার সঙ্গে ভাইরাস প্রতিরোধে লড়াই করার উত্সাহ দিয়েছেন। তিনি বয়স্ক রোগীদের নিজের সন্তানের মত যত্ন নিয়েছেন।

তিনি হলেন ছাই চ্য ছিং। তিনি চীনের চ্য চিয়াং প্রদেশের চিয়াসিং শহরের দ্বিতীয় হাসপাতালের নার্সিং বিভাগের উপ প্রধান।

 

গত ২৫ জানুয়ারি, ছাই চ্য চিয়াং প্রদেশের প্রথম দফা চিকিত্সক দলের সঙ্গে উ হানে সহায়তা দিতে যান। তিনি উ হান শহরের চতুর্থ হাসপাতালে টানা ৫৭ দিন ধরে কাজ করেছেন। ছাই বলেন, ‘একজন আইসিইউ-এর পেশাদার নার্স হিসেবে যখন প্রয়োজন হবে, তখনই আমি যাবো’। তিনি বলেন, রোগীরা কষ্টের মধ্যে আছেন, তিনি তাদের জন্য আরো বেশি কাজ করতে চান। শুধু ব্যথা দূর করা এত সহজ নয়, বরং তাদেরকে শ্রদ্ধা ও যত্নও নিতে হয়।

 

ছাই-এর রোগীদের মধ্যে একজন ৯১ বছর বয়সী বৃদ্ধ ছিলেন। এই বৃদ্ধ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, বোঝা খুব মুশকিল। ভাষার সমস্যার কারণে এই বৃদ্ধকে ভালোভাবে সহযোগিতা করা যাচ্ছিল না। এ কারণে বৃদ্ধের মেজাজও খুব খারাপ থাকত। ছাই ধৈর্যের সঙ্গে এই বৃদ্ধের কথার অর্থ ও বিভিন্ন ইচ্ছা বোঝার চেষ্টা করেন এবং তার যত্ন নেন। যখন বৃদ্ধকে খাবার খেতে দেওয়া হয়, তখন নার্স ছাই দেখতে পান যে বৃদ্ধের কোনো দাঁত নেই। তাই তিনি খাবারের মধ্যে কিছু পানি দেন, খাবার নরম হওয়ার পর এবং শাকসবজি ছোট ছোট করার পর এই বৃদ্ধকে খাওয়ান। নার্স ছাই সিরিঞ্জ দিয়ে বৃদ্ধকে সয়ামিল্ক খাওয়ান। ধীরে ধীরে আস্থা তৈরি হলে এই বৃদ্ধ ভালোভাবে চিকিত্সকের সঙ্গে সহযোগিতা করা শুরু করেন।

 

নার্স ছাই প্রত্যেক রোগীকে অনন্য শ্রদ্ধা ও সাহায্য দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি সবসময় বসন্তের উষ্ণ বাতাসের মত মনোভাব দিয়ে প্রতিটি রোগীর যত্ন নেন এবং প্রত্যেককে সক্রিয় ও আশা যোগান।

 

এই ৫৭ দিন ছাই-এর কাছে কেমন গুরুত্বপূর্ণ? জবাবে ছাই বলেন, আমার জন্য তা এক ধরনের প্রশিক্ষণ। আমি এ অবস্থা থেকে অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছি। আমি বুঝতে পেরেছি, অনেকেই আমাদেরকে ‘সাদা কাপড়ের অ্যাঞ্জেল’ বলে ডাকে, এর পিছনে অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম রয়েছে।

 

২. ‘আমি অন্যকে সাহায্য দেওয়ার সময় কখনই প্রতিদানের কথা ভাবি নি, আমি কখনই কল্পনা করতে পারি না যে, এ কারণে আমি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পুরস্কার পেতে পারি’। চীনের চ্য চিয়াং প্রদেশের ওয়েন লিং শহরের যুবক ছেন হাই চিয়ান গত সেপ্টেম্বর মাসে বেইজিংয়ে গণ-মহাভবনে দেশের করোনাভাইরাস মহামারির প্রতিরোধে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং পুরস্কৃত হন। পুরস্কার পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিন তিনি নিজের কাজে ফিরে যান। তিনি হলেন ওয়েন লিং শহরের এক মেশিন কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মী।

 

যুবক ছেন দেখতে খুবই সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু যখন চীনে করোনাভাইরাসের মহামারি সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় ছিল, তখন তিনি ছয় জন ইউরেমিয়া রোগীর জন্য প্রায় এক মাস ধরে সেবা দিয়েছেন।

 

৩১ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ছেন বাসা থেকে বের হতেন। তিনি ইউরেমিয়া রোগীর নির্ধারিত স্থান থেকে তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। ইউরেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্তের বৃক্ক ডায়ালাইসিস করতে হয়। একবার করতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এসব রোগীর ডায়ালাইসিস অপেক্ষা করার সময় ছেন আবারও যারা বাসায় কোয়ারেন্টিনে আছেন, তাদেরকে সেবা দিতেন, তিনি ডেলিভারি ভাই-এর মত স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাসায় বই পাঠাতেন। এ ছাড়া তিনি চিকিত্সক ও টহল কর্মীদের বিতরণ করতেন।

 

অন্যকে সাহায্য করা ছেনের জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে তিনি স্থানীয় দাতব্য সংস্থায় অংশ নেওয়ার পর তাঁর অধিকাংশ বিশ্রামের সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সবসময় প্রথমে আসেন এবং সবার শেষে যান। তিনি সবসময় সবচেয়ে ভারি ও কষ্টের কাজটি করেন।

তিনি সবসময় গণকল্যাণকর কাজে অংশ নেন, এই পথে তিনি কখনই থেমে যান নি। তিনি বলেন, সময় থাকলে আমি নিশ্চয়ই এ পথে আরো এগিয়ে যাবো।

 

৩. গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের থিয়ান চিন শহরের শতাধিক চিকিত্সক হু পেই প্রদেশের এন সি রাজ্যে গিয়ে সেখানের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে সাহায্য করেছেন।

থিয়ান চিন শহরের চিকিত্সক দলের প্রধান চাং হুং এবং তাঁর সহকর্মীরা স্থানীয় লোকজনের স্বাস্থ্য রক্ষায় অনেক চেষ্টা করেছেন।

এন সি রাজ্যে ৬টি জেলা এবং দুটি শহর আছে। চাং হুং এবং তাঁর দল এসব জায়গায় গিয়ে চিকিত্সা, জীবাণুমুক্তকরণ, জ্ঞানের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন। পাহাড়ি পথ খুব আঁকাবাঁকা ও আবহাওয়া ঠান্ডা। চাং হুং বলেন, প্রতিদিন কুয়াশার মধ্য দিয়ে, পায়ের নিচে বরফ মাড়িয়ে সামনে এগিয়েছেন। এ অবস্থায় পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে বেরান। তিনি এন সি রাজ্যের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে ৫৭ দিন ধরে কাজ করেছেন।

 

১৭ মার্চ এন সি রাজ্যে করোনাভাইরাসের আর কোনো রোগী পাওয়া যায় না। চিকিত্সা কাজে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের পর চিকিত্সাকর্মীরা আবারও এন সি রাজ্যের অফিস ও কারখানার উত্পাদনকাজ শুরু করেন। এন সি রাজ্যের চা শিল্পে ৮ লাখেরও বেশি শ্রমিক রয়েছে। কিছু চা শ্রমিক সবেমাত্র দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে তাদের জীবনে আবারও সমস্যা শুরু হয়। চীনে একটি কথা আছে: ছিংমিং উত্সবের আগের চা পাতার দাম, তেলের দামের চেয়েও বেশি’। যদি সময় মত চা পাতা না তোলা হয়, তাহলে চা উত্পাদনের পরিমাণ অর্ধেক হ্রাস পাবে।

করোনাভাইরাসের অবস্থা যাচাই করার পর চাং হুং সিদ্ধান্ত নেন যে, কর্মীদের নিয়ে স্থানীয় চা শ্রমিকদের সাহায্য করতে হবে।

 

৪. আবারও রওনা!

সার্স থেকে চীনের ওয়েন ছুয়ান জেলার ভয়াবহ ভূমিকম্প, তারপর চলতি বছর করোনাভাইরাসের মহামারি। চীনের শাংহাইযের রুই চিন হাসপাতালের উপপ্রধান ছেন আর চেন যথাক্রমে ২০ বারেরও বেশি চীনের গুরুত্বপূর্ণ ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন।

 

২৮ জানুয়ারি বিকালে তিনি হু পেই প্রদেশে সহায়তাকারী তৃতীয় দফা চিকিত্সক দলের প্রধান হিসেবে শাংহাইয়ের ৪০টিরও বেশি হাসপাতালের শ্রেষ্ঠ চিকিত্সকদের নিয়ে গঠিত এক দলের নেতৃত্ব দিয়ে উ হান শহরে যান। রওনা দেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, আমরা একসাথে যাবো, নিশ্চয় একসাথে ফিরবো। যা অনেককে মুগ্ধ ও উত্সাহিত করেছে।

 

চিকিত্সাকালে ছেন আর চেন এবং তাঁর সহকর্মীরা সর্বপ্রথম মানসিক সংকট সমাধানের দল গঠন করেছেন, রোগীদের শ্রেণীবিন্যাস করার পর তাদের অবস্থা অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন, প্রত্যেকের জন্য একটা বিশেষ চিকিত্সার প্রস্তাব প্রণয়ন করেছেন। তাঁরা মোট ৩৩২জন গুরুতর রোগীর চিকিত্সা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হলেন ১০৩ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা।

 

চিকিত্সার কাজ ছাড়া ছেন আর চেন আরেকটি কাজকে খুব গুরুত্ব দেন, তা হলো- হাসপাতালের ভিতর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা। তিনি বলেন, আমাদের দলে কাউকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া যাবে না। একজন সদস্য আক্রান্ত হলে, আমরা সবাই ভাইরাস প্রতিরোধের লড়াইয়ে হেরে যাবো। এজন্য প্রত্যেক চিকিত্সককে তাঁর সামনে প্রতিরোধমূলক পোশাক পরার পরীক্ষায় পাস করতে হয়, যাতে প্রত্যেকের নিরাপত্তা রক্ষা করা যায়।

 

ছেন আর চেন একটি কাপড় সাংবাদিককে দেখান। এতে ১৪৮টি নামের স্বাক্ষর রয়েছে। এটি হল ৫৫ দিনের কর্তব্য সম্পন্ন করার পর সবার জন্য রাখা একটি সুন্দর স্মৃতি।

ছেন আর চেন বলেন, এক ধরনের শক্তি আছে, তার নাম ঐক্য। চীনা জনগণ বীরের মত, আর এই গর্ব চীনা জনগণের। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, রুই চিন হাসপাতালে শাংহাইয়ের প্রথম গণস্বাস্থ্য আকষ্মিক বিপর্যয়কর ঘটনা মোকাবিলায় চিকিত্সক দল গঠিত হয়। ছেন আর চেন বলেন, আমাদের উচিত নিরাপদ থাকার সময় বিপদের কথা মনে রাখা। করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধের কাজ নিয়মিত করা। এই কাজ ভালোভাবে করতে হবে। যাতে আমাদের অর্জিত সব সাফল্য রক্ষা করা যায়।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)