“আমার ২০৩৫ সাল, স্বপ্ন নয়- সত্যি”
2020-11-13 16:33:17

সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনে সার্বিক সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়নের লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রত্যেক চীনা মানুষ যেন ‘চীন’ নামের একটি বিশাল জাহাজে চড়ে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে, চীনারা কেমন  ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করছে? সম্প্রতি সাংবাদিকরা বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের কাছে গিয়ে তাদের মনের কথা এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শুনেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাদের মনের কথাগুলো তুলে ধরব।

 

 

১. ৯ বছর বয়সী বাস্কেটবল খেলোয়াড় মা মিং ইয়াং

 

মা মিং ইয়াং উত্তর-পূর্ব চীনের হেই লুং চিয়াং প্রদেশের হারবিন শহরের হুংছিয়াং প্রথম প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় গ্রেডের একজন ছাত্রী। সে লেখাপড়ায় অনেক ভালো। দ্বিতীয় গ্রেডের সময় তার উচ্চতার কারণে ক্রীড়া শিক্ষক তাকে স্কুলের বাস্কেটবল দলে নেন এবং তখন থেকে সে বাস্কেটবল প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। প্রতিদিন সকালে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সবাই ব্যায়াম করে; কিন্তু ছাত্রী মা স্কুলে বাস্কেটবল চর্চা করেন। কঠোর প্রশিক্ষণ ও পরিশ্রমের পর এক বছর পর সে হুংছিয়াং প্রথম প্রাথমিক স্কুলের মেয়েদের বাস্কেটবল দলের একজন সদস্য হিসেবে প্রতিযোগিতার মাঠে উঠতে পেরেছে। তাদের দল ২০২০ সালে হেইলুংচিয়াং প্রদেশের প্রাথমিক স্কুলের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হয়।

 

ছাত্রী মা ভালোভাবে পিয়ানো বাজাতে পারে, এখন সে পিয়ানো পরীক্ষার ৮টি ধাপ পার করেছে। এ ছাড়া সে উপস্থাপনা, সাঁতার কাটা ও ভালো স্কেটিং করতে পারে। এখন ছাত্রী মা বাস্কেটবলকেও গভীরভাবে ভালবেসেছে। প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে স্কুলের বাইরে পেশাদার সংস্থায় গিয়ে বাস্কেটবল চর্চা করে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্বন্ধে মা বলে, আমি আশা করি, ভবিষ্যতে আমি চীনের জাতীয় বাস্কেটবল দলের একজন সদস্য হবো। বাস্কেটবল চর্চার পাশাপাশি আমি লেখাপড়া করতে চাই; যাতে ভবিষ্যতে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি। ১৫ বছর পর অর্থাত্ ২০৩৫ সালে আমার জীবন আরো চমত্কার হয়ে উঠবে বলে আশা করি।

 

মা বলে, ২০৩৫ সালে আমার বয়স হবে ২৪ বছর। তখন আমি হয়ত মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া করবো। সকালে গবেষণাগারে গবেষণা করব, বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের বাস্কেটবল লিগের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবো। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর আমি বিদেশে যেতে পারব। অথবা, আমি চীনের হয়ে প্রতিযোগিতার মাঠে স্বপ্নের বিজয় ছিনিয়ে আনবো।

 

২. ৩৩ বছর বয়সী কৃষক ছাও ইউ চুং: নতুন প্রজন্মের কৃষক

 

২০১৮ সালে ছাও ইউ চুং বড় বড় শহর থেকে চীনের শানতুং প্রদেশের কেং দিয়ান গ্রামে ফিরে যান। তিনি হলেন গ্রামে ই-কমার্স পরিচালনা এবং অনলাইনে দোকান স্থাপনকারী প্রথম কৃষক। তিনি গ্রামের সবচেয়ে বেশি শাকসবজি ও ফল চাষ করে থাকেন। তিনি নিজের শাকসবজির একটি ব্র্যান্ডও তৈরি করেছেন। এর নাম ‘তুও ইউয়ান’। গত বছরের জুন মাসে, ছাও ইউ চুং চীনের বিখ্যাত অনলাইন কেনাকাটা প্ল্যাটফর্ম-পিনতোতো’তে স্টোর খোলেন। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে তিনি প্রায় ১৭ হাজার কেজি টমেটো বিক্রি করেছেন। তিনি গ্রামের কৃষকদের বাইরে পণ্য বিক্রি করা এবং যোগাযোগের নতুন পথ সৃষ্টি করেছেন। কৃষক ছাও ইউ চুং-এর কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে তাঁর চাষ করা ফল গাছে এখন ফসল হচ্ছে। ধারণা করা যায়, তাঁর কাজ আরো সমৃদ্ধ হবে।

 

ছাও বলেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন মোটামুটি কৃষির আধুনিকায়ন বাস্তবায়ন করবে। তাই নতুন প্রজন্মের কৃষকের উচিত তাড়াতাড়ি নতুন প্রযুক্তি শেখা এবং নতুন চিন্তাধারা পোষণ করা। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের গ্রামে ৮০ জনেরও বেশি তরুণ-তরুণী বড় বড় শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছেন। গ্রামে তরুণ-তরুণীর প্রাণচাঞ্চল্য বেড়েছে। নতুন প্রজন্মের কৃষকরা আমাদের বাবা মা’র প্রজন্ম থেকে একদম ভিন্ন। আমরা গ্রাম পুনরুদ্ধারের সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি।

 

তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলেন, ২০৩৫ সালে আমার প্রাকৃতিক ফল ও শাকসবজির বাগানে ফলের সুগন্ধ পাওয়া যাবে। হয়ত, ৪৮ বছর বয়সে আমি নাশপাতি গাছের নিচে পর্যটকদের সঙ্গে চা পান করবো, গ্রামের পরিবর্তন নিয়ে আড্ডা দেবো। তখন হয়ত ফল বাগানে, ড্রোন অর্গানিক সার দিচ্ছে, ফল গাছের রোবট ফলের অবস্থা যাচাই করছে, দেশ-বিদেশে থেকে ফল কেনার অর্ডার আসছে। তখন, বিগ ডেডা সেন্টার একটি নির্দেশ দিয়ে গুদামের রোবট অর্ডার অনুযায়ী ফলগুলো বাছাই করে প্যাকেজ করবে এবং চালকবিহীন ডেলিভারি গাড়িও চলে আসবে।

 

৩. তিব্বতের শিক্ষা কাজে সহায়তাকারী স্কুলের প্রধান ওয়াং ইয়ু সুং: গ্রামের শিশুদের শ্রেষ্ঠ মানের শিক্ষা দে

 

ওয়াং ইয়ু সুং হলেন চীনের হুপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ মাধ্যমিক স্কুলের উপ প্রধান। তাঁর বয়স ৪৪ বছর। ২০১৭ সালের মে মাসে, হুপেই প্রদেশের শিক্ষা বিভাগ তাঁকে তিব্বতের শিক্ষা কাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য সেখানে পাঠায়। তিনি তিব্বতের শাননান শহরের শাননান প্রথম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। মেয়াদ শেষ হলে তিনি আবারও তিব্বতে থাকার আবেদন জানিয়েছেন। এখন তিনি তিব্বতের তুংহুই মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান। তিব্বতে সহায়তা দেয়ার কাজে তিনি স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি তিব্বতের ‘তাঁবু স্কুলের’ অনুন্নত চেহারা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন। এখন দৈনন্দিন শিক্ষা ও পরিচালনার কাজ ছাড়া তিনি তিব্বতের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিনিময়ের আয়োজনও করেছেন। যাতে তারা আরো বেশি শিখতে পারে।

 

স্কুলের প্রধান ওয়াং বলেন, যখন আমি প্রথমে তিব্বতে আসি, তখন আমি দেখতে পাই যে, অনেক শিশু তাঁবু দিয়ে তৈরি করা জরাজীর্ণ ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করছে। তা দেখে আমি খুব মর্মাহত হয়েছি। তাই আমি এখানে আরও বেশি দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, ২০৩৫ সালে শহর ও গ্রামের উন্নয়নের পার্থক্য ও নাগরিকের জীবনযাপনের মানের পার্থক্য অনেক কমে আসবে। তখন তিব্বতের শিশুদের জীবনযাপনের মান, শিক্ষার মানও আরো ভালো হবে, গ্রামের শিশুরা উচ্চ এবং শ্রেষ্ঠ মানের শিক্ষা লাভ করবে।

 

ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওয়াং বলেন, তখন আমার বয়স হবে ৫৯ বছর। তখন আমার উহান শহরে ফিরে যাওয়ার কথা। আমার চুল সাদা হয়ে যাবে, তবে আমি ক্লাসরুমে কাজ করতে চাই। মাঝে মাঝে তিব্বতে আমার পুরোনো ছাত্রছাত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাকে ভিডিও কল দেবে। সবাই নতুন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা জানাবে। তখন যোগাযোগব্যবস্থা আরো সুবিধাজনক হবে। খুব তাড়াতাড়ি উহান থেকে তিব্বতে যাওয়া যাবে। আমি ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে তিব্বতে যাবো, সেখানের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন দেখবো।

 

৪. ৫৫ বছর বয়সী সোয়াট প্রধান চাং পাও কুও: সবাই স্থায়ী সুখী জীবন পাবে

 

১৯৯৯ সালে চাং পাও কুও Explosive Ordnance Disposal (EOD) বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে চীনের শানতুং প্রদেশের জিনান শহরের পুলিশ ব্যুরোতে যোগ দেন। তিনি ব্যুরোর প্রথম এবং একমাত্র পেশাদার ইওডি কর্মী। তিনি এখন জিনান শহরের পুলিশ ব্যুরোর সোয়াট দলের উপ প্রধান। তিনি দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, বিস্ফোরক তুলে নেওয়ার কাজ থাকলে আমি প্রথমে যাব। যদি আমি না থাকি, তাহলে যার সিপিসি সদস্য হওয়ার বয়স বেশি- সে যাবে। পুলিশের দায়িত্ব পালনের দীর্ঘ জীবনে, তিনি বহুবার মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছেন- আবার ফিরেও এসেছেন। তিনি সাফল্যের সঙ্গে ১১০ বারেরও বেশি বিস্ফোরক পদার্থ তুলে এনেছেন। তাঁকে দেশের পুলিশ ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের বীর হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।

 

চাং বলেন, তাঁর মেয়ে ২০১৯ সালে চীনের গণ-নিরাপত্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। চাং বলেন, ২০৩৫ সালে নিরাপদ চীন নির্মাণ আরো উচ্চ মানে পৌঁছাবে। আমার মেয়ে তখন জননিরাপত্তা রক্ষাকারী পুলিশ হবে। তখন সমাজের আইন পরিচালনা ব্যবস্থা আরো ভালো হবে। অপরাধের হার আরো কমে আসবে। আমি আশা করি, আমার মেয়ে এমন যুগে জীবনযাপন করতে পারবে।

 

চাং আশা করে বলেন, ২০৩৫ সালে আমি অবসরে যাবো, প্রতিদিন আমি নাতিকে নিয়ে জিনান শহরে ঘুরে বেড়াবো, তখন রাস্তায় টহল দেবে রোবট পুলিশ। আমার শিক্ষার্থীরা স্মার্ট নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে বসে রোবট পুলিশের পাঠানো বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করবে।

 

৫. ৭৯ বছর বয়সী শিল্পী থিয়ান লিয়ান ইউয়ান: বর্তমানের ঐতিহ্য শিল্প, বর্তমানের বড় বাজার

 

থিয়ান লিয়ান ইউয়ান ঐতিহ্যবাহী শিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। ৯ বছর বয়স থেকে তিনি চীনের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা শিখতে শুরু করেন। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করে লোকজন বলে, তাঁর মুখ থেকে পুরো পৃথিবীর কাজ শোনা যায়। তিনি চীনের রাষ্ট্রীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধিত্ব উত্তরাধিকারী হিসেবে শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন। চলতি বছর তাঁর বয়স হবে ৭৯ বছর। এরপরও তিনি এখন বেইজিংয়ে ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শত বছর বার্ষিকীর’র জন্য অনুষ্ঠান তৈরি করছেন।

 

তিনি বলেন, চীনের ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে পিংসু (বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সঙ্গে কথা বলা এবং সুর দেওয়া) প্রাচীন এক ধরনের শিল্প। যা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমি বিশ্বাস করি, ২০৩৫ সালে যখন চীন সংস্কৃতি খাতের একটি বড় দেশ হবে, তখন আমার পিংসু শিল্প আরো রূপান্তরিত হবে, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের মঞ্চ আরো বড় হবে।

তিনি বলেন, ২০৩৫ সালে আমার বয়স ৯৪ বছর হবে। তখন যদি আমার শারীরিক অবস্থা ভালো থাকে, তখনও আমি মঞ্চে উঠে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করবো।

 

চীনের ঊনবিংশ কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০৩৫ সালে চীনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও বহুমুখী শক্তি ব্যাপকভাবে উন্নত হবে। চীন একটি ‘সংস্কৃতি, শিক্ষা, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্যকর দেশে’ পরিণত হবে। ২০৩৫ সালে চীনের সাফল্য আসবে প্রত্যেক চীনার পরিশ্রমের হাত ধরে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)