চলুন বেড়িয়ে আসি: ফ্রান্সের মন্ট সেন্ট মিচেল থেকে
2020-11-13 16:30:21

মন্ট সেন্ট মিচেল

চলুন বেড়িয়ে আসি: ফ্রান্সের মন্ট সেন্ট মিচেল থেকে

ভ্রমণপিপাসুদের কাছে ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহর ফ্রান্স। ফ্রান্সের শীর্ষ দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে মন্ট সেন্ট মিচেল অন্যতম। ফ্রান্সের নরমান্ডিতে অবস্থিত ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ মন্ট সেন্ট মিচেল অতীতে মূল ভূ-খণ্ডের একটি অংশ ছিল। প্রায় কয়েক’শ বছর আগে সমুদ্রের জোয়ারের ধাক্কায় চারপাশ বিলীন হয়ে মূল ভূ-খণ্ড থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের বুকে অবির্ভাব ঘটে ক্ষুদ্র এই দ্বীপের।

মূল ভূ-খণ্ডের সাথে এই দ্বীপটির প্রথম যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ১৮৭৯ সালে প্রথম সাথে দ্বীপটির যোগ-সূত্র স্থাপনের জন্য কাঠের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। যদিও জোয়ারের সময় মূল ভূ-খণ্ডের সাথে দ্বীপটির যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে দ্বীপটির সাথে যোগ-সূত্র স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে নতুন যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে , তা দিয়ে জোয়ারের সময়ও খুব সহজেই পৌঁছানো যায় দ্বীপে।

সুপারটাইডের সময় নতুন সেতুটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন মূল ভূ-খণ্ডের সাথে দ্বীপটির যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে সুপারটাইড কি? আসলে সুপারটাইড হচ্ছে বড় ধরণের জোয়ার। প্রতি ১৮ বছর পর পর দেখা মিলে সুপারটাইড নামক ভয়ংকর এই জোয়ারের। শেষ-বারের মত ২০১৫ সালে দেখা গিয়েছিলো ভয়ংকর এই জোয়ারের। মূলত সূর্যগ্রহণের দরুণ চন্দ্র , সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যকার মিলিত মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলেই সুপারটাইড নামক ভয়ংকর এই জোয়ারের সৃষ্টি হয়। ভয়ংকর এই জোয়ারের উচ্চতা দাঁড়ায় ৪৬ ফুট,  যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। আপাত দৃষ্টিতে ভয়ংকর মনে হলেও প্রকৃত ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এই জোয়ার যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।    

প্রকৃতির আপন নিয়মে এখানে জোয়ারের পরেই আসে ভাটার খেলা, তবে দূর্লভ এই ভাটার খেলা জমে উঠে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ অস্বাভাবিক নিয়মে। অস্বাভাবিক নিয়মেই সুপারটাইড-এর পর ভাটার পানি খুব দ্রুত গড়িয়ে যায় সমুদ্রে , আর রেখে যায় বিস্তীর্ণ ধু-ধু বালুকাবেলা। এভাবেই প্রতি ১৮ বছর পর পর এখানে জেগে উঠে বিস্তীর্ণ বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। সাগরের বুকে হঠাৎ জেগে উঠা বিরল এই বালুকাময় সৈকতে দু-পাক হেঁটে আসার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই ছুঁটে আসেন এখানে। স্বল্প সময়ের জন্য জেগে ওঠা এই সৈকতটি আবার অচিরেই হারিয়ে যায় সাগরের বুকে।    

উত্তরীয় ফ্রান্সের উপকূলে অবস্থিত ছোট্ট এই দ্বীপটির চারপাশে ছুঁটে  চলা উত্তাল সমুদ্র আর তার বিশাল গর্জন পর্যটকদের অন্যতম এক আকর্ষণের বিষয়। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশির মাঝে ছোট্ট এই দ্বীপটি যেন উঁকি দিচ্ছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত। হয়তো এজন্যই মন্ট সেন্ট মিচেল-এর জনপ্রিয়তা ফ্রান্সের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের চেয়ে ভিন্ন। মন্ট সেন্ট মিচেল দ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে অদ্ভুদ এক কাল্পনিক দূর্গ। যদিও এই দূর্গটি আশ্রম নামেই বেশ পরিচিত। অষ্টম শতকের শুরুর দিকে ছোট্ট একটি আশ্রম তৈরী করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে পুনস্থাপন করা হয়। এই আশ্রমটি ছাড়াও মন্ট সেন্ট মিচেল-এ পাহাড়ের উপর আরো বেশ কিছু দালানকোঠা দেখতে পাওয়া যায় , যেগুলোর বেশির ভাগই ১৩ শতকে গথিক নির্মাণ রীতিতে বানানো হয়েছে। এসব দেখতেই প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক পাড়ি জমায় এই দ্বীপে। এত সব পর্যটকের ভীড়েও দ্বীপটিতে রয়েছে কিছু স্থায়ী বাসিন্দা। এ দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটকরাই এদের জীবন-যাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।

৬৫৬০ হেক্টরেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ক্ষুদ্র এই দ্বীপটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। ১৯৭৯-সালে মন্ট সেন্ট মিচেল- কে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত প্রদান করে। এর পর থেকেই মন্ট সেন্ট মিচেল- এর পরিচিতি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পরে গোটা বিশ্বে , আর বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে মানুষ দলে দলে পারি জমাতে থাকে এই দ্বীপে। ঐতিহাসিক দিক থেকেও ক্ষুদ্র এই দ্বীপটির গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। আজ থেকে প্রায় শত শত বছর আগে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা ক্ষুদ্র এই  দ্বীপটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। উদাহরণস্বরূপ , শতবর্ষের যুদ্ধের সময় বহু বার চেষ্টা করেও এই দ্বীপটিকে কোনো ভাবেই দখলে আনতে পারে নি ইংরেজরা। কালের পরিক্রমায় এমনই বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দ্বীপটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের বুকে , জানান দিয়ে যাচ্ছে নিজ স্বতন্ত্র পরিচয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

মন্ট সেন্ট মিচেল -এর অবস্থান ও যাতায়াত ব্যবস্থা

উত্তরীয় ফ্রান্সের উপকূলে নরমান্ডি -তে অবস্থিত এই দ্বীপে যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ ভালো। স্থল পথের বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে খুব সহজেই এই দ্বীপে যাওয়া যায়। এই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন ট্রেন নেই। তাই আপনি চাইলে খানিকটা পথ ট্রেনে গিয়ে বাকিটা পথ অন্য কোন যানবাহনে চড়ে যেতে পারেন। তবে মন্ট সেন্ট মিচেল -এ পৌঁছনোর সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম হচ্ছে গাড়ি কিংবা মোটর-সাইকেল। তাছাড়া বাসে  চড়ে খুব সাচ্ছন্দেই ভ্রমণ করা যায় অপরূপ দ্বীপ। 

মন্ট সেন্ট মিচেল খোলা ও বন্ধের সময়সূচী

জুলাই ও আগস্ট মাসে মন্ট সেন্ট মিচেল প্রতিদিন সকাল ৯.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭.০০ টা  পর্যন্ত খোলা থাকে।

মার্চ ও অক্টোবর এই দুই মাস (বিদ্যালয় ছুটির দিন ব্যতীত) মন্ট সেন্ট মিচেল প্রতিদিন সকাল ৯:৩০ থেকে দুপুর ১২:৩০ পর্যন্ত এবং দুপুর ২:০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬:০০ পর্যন্ত খোলা থাকে।

নভেম্বর , ডিসেম্বর , জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে (বিদ্যালয় ছুটির দিন ব্যতীত) এই দ্বীপটি সকাল ১০:০০ টা থেকে দুপুর ১২:৩০ টা পর্যন্ত এবং দুপুর ২:০০ টা থেকে বিকেল ৫:০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

বছরে দুই দিন অর্থাৎ ২৫ -শে ডিসেম্বর এবং ১লা জানুয়ারী এখানকার পর্যটন দপ্তরটি বন্ধ থাকে।

বিঃদ্রঃ উক্ত সময়সূচী গুলো শর্ত সাপেক্ষে যেকোন সময় পরিবর্তিত হতে পারে। কাজেই এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা সংগৃহীত সঠিক সময়সূচী সম্পর্কে জেনে নিন।   

 

 

সতর্কতা

  • মন্ট সেন্ট মিচেল -এ সমুদ্র বেশ উত্তাল। এখানকার সমুদ্র এতটাই উত্তাল যে , মন্ট সেন্ট মিচেল ইউরোপের সর্বোচ্চ জোয়ার প্রবাহ দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাই মন্ট সেন্ট মিচেল -এ সমুদ্র তীর ঘেঁষে হাঁটার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। তাছাড়া এখানকার সমুদ্র মাঝে মাঝে ভয়ানক রূপ ধারণ করে , ফলে সমুদ্রের তীরবর্তী ঢেউ-গুলো বেশ বিপদজনক হয়ে উঠে। এমন অবস্থায় কোনভাবেই সমুদ্রের তীরে যাবেন না। সমুদ্রের তীরে যাওয়ার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে নিন।
  • মন্ট সেন্ট মিচেল -এ পর্বতে আরোহনের ধাপগুলো কিছুটা দুর্গম (খাড়াই), তাই পর্বতে আরোহনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
  • মন্ট সেন্ট মিচেল দ্বীপে বালির উপর দিয়ে হাঁটা বেশ বিপদজনক। সুতরাং বালির উপর দিয়ে হাঁটা পরিহার করুন।
  • মন্ট সেন্ট মিচেল ভ্রমণে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিশ্চিত করতে এই দ্বীপ সম্পর্কে অভিজ্ঞ কাউকে সাথে রাখুন এবং কর্তৃপক্ষের দেয়া সকল নির্দেশনা গুলো মেনে চলুন।