চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন
2020-10-28 12:06:02

 

চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন_fororder_1126631256_16031135299671n

সম্প্রতি চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশ করে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধির হার ৪.৯। প্রথম প্রান্তিকে অর্থনীতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৮ শতাংশ হ্রাস পায় এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আর তৃতীয় প্রান্তিকে বৃদ্ধির গতি আরও দ্রুত।

 

চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের অর্থনীতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং তৃতীয় প্রান্তিকের উপাত্ত প্রকাশিত হবার পর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসের অর্থনীতি প্রথমবারের মতো বৃদ্ধি পায়। ০.৭ শতাংশ বেশি না-হলেও, চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতার একটি প্রতীক এটি।

 

কিছুদিন আগে, বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধির পূর্বাভাস জুন মাসের ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করা হয়। জাতিসংঘ বাণিজ্য উন্নয়ন অধিবেশনের প্রতিবেদনেও বলা হয়,  বিশ্ব অর্থনীতি গুরুতর মন্দাবস্থায় পড়তে যাচ্ছে, তবে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধির প্রবণতা বজায় রাখবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখে এবং চীনের অর্থনীতিতে বৃদ্ধি ছাড়া অন্য ইতিবাচক সংকেতও পাওয়া যায়। চলতি বছের প্রথম তিন প্রান্তিকে  স্থির সম্পদে বিনিয়োগ, পণ্য রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণ ও মাথাপিছু নিষ্পত্তিযোগ্য আয়—এই তিনটি সূচক বেড়েছে।

চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন_fororder_1126631256_16031124062461n

জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর মুখপাত্র লিউ আই হুয়া বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি ও জটিল দেশ-বিদেশের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে চীনের নানান পর্যায়ের সরকার ও বিভাগগুলো বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় করছে।

বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও স্থিতিশীল ছিল। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে নতুন করে ৮৯ লাখ ৯০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সমান। সেপ্টেম্বর মাসে শহরে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৪, যা চলতি বছরের শুরু দিকের ৬.২ শতাংশের চেয়ে কম। পাশাপাশি মানুষের আয় বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক নিশ্চয়তা জোরদার হয়। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে মাথাপিছু অবসর পেনশন ও সামাজিক সহায়তা যথাক্রমে ৮.৭ শতাংশ ও ১২.৯ শতাংশ বেশি ছিল।

 

লিউ আই হুয়া মনে করেন, কর্মসংস্থানের চাপের মুখে নানান পর্যায়ের সরকার কর্মসংস্থানকে প্রথম স্থানে রেখে জীবিকা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। চীনের অর্থনীতি মাহামারির চাপ সামলে নিয়েছে এবং মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশ্বে এগিয়ে আছে।

 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব অর্থনীতি পূর্বাভাস প্রতিবেদন’-এ বলেছে, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতি সঙ্কুচিত হবে ৪.৪ শতাংশ; তবে চীন বিশ্বে একমাত্র অর্থনৈতিক সত্তা যার অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে।

 

মহামারির আঘাতে চীনের শিল্প রূপান্তর দ্রততর হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্য কোম্পানিগুলো মূলত দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে অর্ডার পায়: প্রদর্শনী ও মেলায় অংশগ্রহণ বা পুরাতন ক্লায়েন্টের সঙ্গে পরিচয়। মহামারি শুরুর পর চে চিয়াং প্রদেশের ই উর একটি বুনন কোম্পানি চালু করে আলিপাপা আন্তর্জাতিক ওয়াবসাইট এবং ওয়াবসাইট খুলে, পণ্য বাছাই, পণ্য পাঠানো ও ক্লায়েন্ট অর্জনসহ সবকিছু অনলাইনে করে। দু’মাসের মধ্যে তারা ৪০টিরও বেশি অর্ডার পায়।

টিজিটালাইজেশান ঐতিহ্যিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির জন্য কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। তবে একে এড়িয়ে যাওয়াও মুশকিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়ার ভয়। আসলে চীনের কোম্পানির রূপান্তর ও নবায়নের গল্প অসংখ্য। সম্প্রতি ১২৮তম কুয়াং চৌ বিনিময় মেলা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। ২৬ হাজারটি কোম্পানি এতে অংশগ্রণ করে এবং অনলাইনে প্রদর্শন করা হয় ২৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি নানা ধরনের পণ্য। আরও বেশী ঐতিহ্যিক বৈদেশিক বাণিজ্য কোম্পানিও ইন্টারনেটে মেলায় যোগ দেয়।

ব্রিটিশ জাতীয় অর্থনীতি ও সমাজ গবেষণালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, মহামারি বিশ্ব ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ডিজিটাল অর্থনীতিসহ নানান নতুন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে চীন এগিয়ে যাচ্ছে, যা শুধু চীনের অর্থনীতির রূপান্তরের জন্য সহায়ক নয়, বরং বিশ্বের টেকসই উন্নয়নের জন্য চালিকাশক্তিও যোগাবে।

চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন_fororder_1126631256_16031135299811n

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের জিডিপিতে ভোগের অবদান ৪.৪ শতাংশ হ্রাস এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২.৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তৃতীয় প্রান্তিকে এ সূচক বেড়েছে ১.৭ শতাংশ। অর্থনীতি উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ চাহিদার অবদানও বাড়ছে। পাশাপাশি, চীনা বাজারের পুনরুদ্ধার থেকে উপকৃত হচ্ছে সারা বিশ্ব।

ফ্রান্সের বিশ্ববিখ্যাত বিউটি কোম্পানি ল'রিয়াল বলেছে, মহামারির সময়ে তাদের পণ্যের অনলাইনে বিক্রির পরিমাণ বেশ বৃদ্ধি পায় । বিশেষ করে চীনা বাজারে তারা লক্ষ্যণীয় সাফল্য অর্জন করে এবং তা কোম্পানির ব্যবসা  পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

মার্কিন কোম্পানি জনসন চীনে চিকিত্সা-সরঞ্জাম, ওষুধ ও ভোগ্যপণ্যসহ নানা ব্যবসায় নবায়ন ও ডিজিটালাইজেশান দ্রুততর করেছে এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনে তাদের ব্যবসা বেশ ভালো হয়েছে। বিশ্বের অন্য বাজারের তুলনায় চীনা বাজারে তারা এগিয়ে আছে। মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, চীনাদের ভোগ বৃদ্ধি ও চীনা অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কিছু মার্কিন কোম্পানিকে সাহায্য করেছে।

 

বস্তুত, বিশাল চীনা বাজারের পুনরুদ্ধার থেকে সারা বিশ্ব উপকৃত হতে পারে।

 

চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের অর্থনীতি কেমন হবে? অবশ্যই বড় ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ আছে। সারা বিশ্বের ওপর মহামারির নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়ছে এবং চীনের অর্থনীতিও পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং কোনো কোনো সূচক হ্রাসও পেয়েছে। কর্মসংস্থান পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা এবং মানুষের আয় বাড়ানো বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

চীনের তৃতীয় প্রান্তিকের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন_fororder_1126631256_16031128874271n

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন পরবর্তী সময়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেপ্টেম্বর মাসে ‘চীনা আন্তর্জাতিক পরিষেবা মেলা ২০২০’ বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়, যা মহামারির পর চীনে অনুষ্ঠিত প্রথম বড় আকারের অফলাইন আন্তর্জাতিক আর্থ-বাণিজ্যিক মেলা। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা এবং তার আকার গত বছরের তুলনায় আরও বড় হবে। পাশাপাশি চীন নতুন অবাধ বাণিজ্য এলাকা চালু করবে।

 

১-৮ অক্টোবর ৮দিনের জাতীয় দিবসের ছুটিতে দেশে মোট ৬০ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছে এবং পর্যটন খাতে আয় ৪৬৬ বিলিয়ান ৫৬০ মিলিয়ান ইউয়ান হয়েছে। হাই নান দ্বীপ শুল্কমুক্ত দোকানে বিক্রির পরিমাণ ১০০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়েছে। এ উপাত্তগুলো আবার প্রমাণ করে যে, চীনা বাজারের সুপ্ত শক্তি ও প্রাণশক্তি প্রবল। সিমেন্স গ্রেটার চীনের সিইও বলেন, একটি উন্মুক্ত চীন বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক। চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ গভীরতর হওয়ায় বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো আরও বেশি সহযোগিতার সুযোগ পাবে।

 

চাহিদা, উত্পাদন, বাজারের আস্থা ও প্রাণশক্তিসহ নানা দিক থেকে দেখলে, চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের অর্থনীতি বর্তমান উন্নয়নের প্রবণতা বজায় রাখতে পারবে। সারা বছরের অর্থনীতির উন্নয়নে তারা আশাবাদী বলে উল্লেখ করেন জাতীয় পরিসংখ্যন ব্যুরোর মুখপাত্র লিউ আই হুয়া। (শিশির/আলিম/রুবি)