ডাক্তার 'মা' সিং ইয়ুং মেই, আপনি স্বর্গে ভালো থাকুন
2020-10-23 14:27:14

ডাক্তার 'মা' সিং ইয়ুং মেই, আপনি স্বর্গে ভালো থাকুন

চীনের সিআন শহরের প্রথম হাসপাতালের দুই নং ভবনের ১৪ নং চিকিত্সা কক্ষে, চোখ পরীক্ষার যন্ত্র ও শিশু রোগীর ফাইল যথাযথভাবে রাখা আছে। শিশুদের জন্য পুতুল রাখার বড় ব্যাগ এক কোনায় পড়ে আছে। তবে শিশুদের চোখের আলো ফিরিয়ে আনা, শিশুদের 'মা'-এর মত আন্তরিক ডাক্তার সিং ইয়ুং সিন চিরদিনের মতো এই জগতের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন।

গত ৬ অক্টোবর ৪৯ বছর বয়সী ডাক্তার সিং মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি নিজের চোখ ও মরদেহ দান করে গেছেন। মাত্র চার দিন পর ১০ অক্টোবর, তাঁর চোখ আরেকটি রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। ওই রোগী আবারও রঙিন বিশ্ব দেখতে পারছেন।

ডাক্তার সিং একজন চিকিত্সক হিসেবে, জীবনের শেষ উপহার এই বিশ্বকে দিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন, 'সারা জীবন আমি আসলে একজন রোগী; তবে, আমি একজন ভালো ডাক্তারও হতে চাই'। তাঁর দুটি পরিচয় আছে। একটি হল ডাক্তার, আরেকটি হল রোগী। ডাক্তার হিসেবে তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিশু রোগীদের চিকিত্সা করেছেন, রোগী হিসেবে তিনি রোগের সঙ্গে সারা জীবন লড়াই করেছেন এবং কখনই রোগের কাছে নতি স্বীকার করেন নি।

চার বছর বয়সে সময় সিং-এর জন্মগত রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা সংক্রান্ত রোগের খবর পাওয়া যায়। তখন থেকে প্রতি কয়েক বছর পর পর তাঁকে হাসপাতালে কিছু সময় থাকতে হতো। ছোটবেলায় রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই একজন ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৮ সালে সিং চীনের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং তখন চীনের সিআন মেডিকেল ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তিনি জানতে পারেন যে তাঁর রোগের নাম হল: Allergic purpura । এ রোগের কারণ ও প্রতিকার এখনও সম্পূর্ণ জানা যায় নি এবং এই রোগে আক্রান্ত মানুষ খুব কমই আছে। সহজ কথায় বলতে গেলে, যদি সিং-এর রক্তের লোহিত রক্তকণিকা ভালোভাবে তাঁর রক্তনালীতে থাকে, তাহলে তিনি নিরাপদ থাকতে পারেন। তবে যদি লোহিত রক্তকণিকা রক্তনালী থেকে বের হয়ে যায়; যেমন- তিনি আহত হয়ে রক্ত ক্ষয় হলে তাঁর পুরো শরীরে অ্যালার্জি হয়। সবচেয়ে আশংকার ব্যাপার হল এর ফলে দাঁতকপাটি লাগে বা Edema সৃষ্টি হয়; যা করোটি-সংক্রান্ত নার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত মাত্র কয়েক ডজন রোগীর আছে। তাদের কেউই ৩০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারেন নি।

তবে এসব কঠিনতা সিংকে দমাতে পারে নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের পর তিনি হাসপাতালে এসে শিশুদের চোখ বিভাগে কাজ করা শুরু করেন। কারণ, আগে একজন ডাক্তার তাঁকে বলেছিলেন, বিরল এ রোগে কেউই ৪০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে নি। ৪০ বছর বয়স পার হবার পর সিং বলেন, আমি ইতোমধ্যে আমাদের মত রোগীদের মধ্যে, সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকা মানুষ, এখন একদিন বেশি বেঁচে থাকা আমার জন্য অতিরিক্ত অর্জন।

ডাক্তার 'মা' সিং ইয়ুং মেই, আপনি স্বর্গে ভালো থাকুন

যারা সিংকে চিনেন, তারা জানেন, সিং-এর চিকিত্সা কক্ষে অসংখ্য মানুষ তার শিশু রোগীকে নিয়ে আসেন, শুধুমাত্র তাঁর সুনামের জন্য। প্রত্যেক বার সিং সবার পরে চিকিত্সা কক্ষ থেকে বের হন। ছোট শিশুদের পরিমাণ বেশি হলেও তিনি কখনই বিরক্ত হন না এবং রাগ করেন না। তিনি ঝামেলামুক্ত ও হাসি মুখে প্রতিটি শিশুর চিকিত্সা করেন। ছোট শিশুরা তাঁকে ভালোবাসে 'মা' বলে ডাকে। ছোট ও দুষ্টুমিভরা শিশুদের ভালোভাবে চিকিত্সা দেওয়ার জন্য ডাক্তার সিং-এর একটি 'ম্যাজিকাল বক্স' আছে। তাঁর টেবিলে একটি ছোট বাক্স এবং একটি বড় ব্যাগ আছে। ভিতরে হল তাঁর সংগ্রহ করা নানা জিনিস। বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও পুতুল; এটি যেন রূপকথার বাক্স!

ডাক্তার সিং সবসময় বলেন, শিশুদের চোখের ডাক্তার এক বিশেষ পেশা। ভালোবাসা ধৈর্য, সাবধানতা এবং সন্তানের মতো যত্ন করতে হয়। শিশুদের ভালো চোখের জন্য সিং সবসময় চেষ্টা করেছেন। ছোট শিশুদের চোখ পরীক্ষার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ডাক্তার সিং সবসময় কার্টুন দেখেন, যাতে শিশুদের পছন্দের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে পুতুল কিনেন। তিনি বলেন, শিশুদের বয়স যত, আমার বয়সও তত। শুধুমাত্র ভালোভাবে শিশুদের সম্পর্কে জানলে ভালোভাবে তাদের সঙ্গে বিনিময় করা সম্ভব। কিছু শিশু সাদা ইউনিফর্ম পরা ডাক্তারদের ভয় পায়। এমন ক্ষেত্রে সিং নিজের ইউনিফর্ম খুলে ফেলেন। তিনি ছোট ছোট খেলনা নিয়ে চিকিত্সা কক্ষের বাইরে এসে বন্ধুর মত শিশুদের কাছে যান, তাদের সাথে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।

প্রতিটি শিশুকে ডাক্তার সিং আদর করে 'বেবি' বলে ডাকেন। বিদেশের অনেক শিশু রোগীও তাঁর কাছে চিকিত্সা নিতে চীনে আসে। ডাক্তার সিং উষ্ণ হৃদয়ে প্রতিটি শিশুর চিকিত্সা দেন এবং তাদের যত্ন নেন। সেই সঙ্গে তিনি একটি উইচ্যাট গ্রুপও খুলেছেন, যাতে চিকিত্সার পর প্রতিটি শিশু রোগীর অবস্থা তত্ত্বাবধান করা যায়, শিশুর বাবা মা'র প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় এবং তাদের আরও সেবা দেওয়া যায়। কেউ কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি নিজেও একজন রোগী। তাহলে সবসময় কেন এত কঠোরভাবে চিকিত্সার কাজ করছেন।

সিং হাসতে হাসতে বলেন, পছন্দের কারণেই। তিনি শিশুদের পছন্দ করেন, এই পেশাকে পছন্দ করেন। তাঁর কাজ হল ভালোবাসা দিয়ে 'দেখার সামর্থ্য' বাড়ানো।

ডাক্তার 'মা' সিং ইয়ুং মেই, আপনি স্বর্গে ভালো থাকুন

এক শিশু রোগীর মা বলেন, প্রতিদিনের প্রথম রোগী থেকে শেষ রোগী পর্যন্ত সিং-এর মনোভাব একইরকম। ধৈর্যের সঙ্গে সিং প্রত্যেক শিশুর চিকিত্সা করেন। বহু বছর ধরে সিং নিজের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তাই অসুস্থ অবস্থায় চিকিত্সা সেবা দেওয়া তাঁর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। মাঝে মাঝে তাঁর খুব ব্যথা হয়, তিনি হুইলচেয়ারে বসে, পাইপ দিয়ে অক্সিজেন ব্যবহার করে শিশু রোগীদের চিকিত্সা দেন।

সাক্ষাত্কারে সিং-এর সহকর্মী, সিআন শহরের প্রথম হাসপাতালের শিশুদের চোখ বিভাগের উপ পরিচালক সুং জিন সিন আর্দ্র কণ্ঠে বলেন, ডাক্তার সিং ২০১৬ সালে আমাদের হাসপাতালে কাজ শুরু করেছেন, পাঁচ বছর হয়েছে। তিনি আমাদের হাসপাতালে শিশু চক্ষু বিভাগ স্থাপন করেছেন তিনি চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিশু চক্ষু রোগীদের চিকিত্সার জন্য দোলনা স্থাপন করেছেন।

ডাক্তার সুং জানান, নতুন চিকিত্সকের শিক্ষাদানে ডাক্তার সিং খুব আন্তরিক। তিনি তাঁর সব জ্ঞান ও বহু বছরের অভিজ্ঞতা সহকর্মীদের শিখিয়েছেন। সবাই সিং-এর কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য ও অস্ত্রোপচারের কৌশল শিখতে পেরেছে। এখন তারাও বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

দৈনন্দিনের চিকিত্সা কাজের পাশাপাশি ডাক্তার সিং নিজ হাসপাতালের শিশু চোখের রোগীদের দল নিয়ে ঘন ঘন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে যান। তাঁরা বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুদের চোখের যত্ন নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট জ্ঞান শেখান। সেই সঙ্গে ডাক্তার সিং দাতব্য কাজে খুব সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি সবসময় দলের কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুদের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন।

সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিং-এর শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। তাঁর পায়ের ত্বকে বড় অংশে পচন ধরে। একে বলা হয় নিক্রোসিস। তাঁর হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণ দেখা যায়। গত জানুয়ারি মাসে, তাঁর কোমরের ব্যথা ও জ্বর হয়। এমন খারাপ শরীর নিয়ে তিনি হুইলচেয়ারে বসে অক্সিজেনে শ্বাস নিতে নিতে শিশুদের চোখ পরীক্ষা করেন।

অল্প সময় পর রোগ আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। সিং তখন আইসিইউতে ভর্তি হন। হাসপাতাল বার বার তাঁর সংকটাপন্ন অবস্থার নোটিশ দিতে থাকে।

এমন অবস্থায়ও ডাক্তার সিং নিজের শিশু রোগীদের জন্য কিছু করতে চান। তিনি ও তাঁর স্বামী ২০১৭ সালে বিনামূল্যে চোখ দান করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্বামীকে নিজের মরদেহ গবেষণার কাজে দান করার জন্য অনুরোধ করে যান। সিং-এর সহকর্মী বলেন, সিং হলেন সিআন শহরের ১৬৬তম চক্ষুদানকারী ব্যক্তি।

৫ জুলাই আইসিইউ-তে চিকিত্সাধীন ডাক্তার সিং রোগীদের জানিয়ে দেন, এবারের গ্রীষ্মকালের ছুটিতে, 'মা' সিং আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।

ছয় মাস চিকিত্সার পর গত ৬ অক্টোবর, সিং চিরদিনের মত চোখ বন্ধ করেন। তাঁর চিকিত্সায় সুস্থ হওয়া অসংখ্য শিশুদের না জানিয়ে তিনি না-ফেরার দেশে চলে যান। অসংখ্য গুণগ্রাহী, ভক্ত, অনুরাগী ও সহকর্মীদের কাছ থেকে চির বিদায়ের দেশে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার দিন পর একজন রোগী ডাক্তার সিংয়ের দান করা চোখ দিয়ে এ পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। তাঁর মরদেহ, তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়-সিআন মেডিকেল ইন্সটিটিউটে দান করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল গবেষণার কাজ করতে পারেন।

মৃত্যুর আগে সিং কথা বলতে পারছিলেন না, তিনি একটি কাগজে স্বামীকে কিছু কথা লিখে দেন। "আমার রোগের অবস্থা খুব গুরুতর। চিকিত্সার সম্ভাবনা থাকলে চিকিত্সা করো, যদি কোনও আশা না থাকে, তাহলে চিকিত্সা করার দরকার নেই। শুধুই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আমার শুধু একটি অনুরোধ আছে, আমি খুব কষ্টকর মৃত্যু চাই না, আমি মর্যাদার সঙ্গে মারা যেতে চাই। আমার মরদেহ ও চোখ দানের কথা ভুলে যেও না।"

'মা' সিং চলে গেছেন, বেঁচে থাকার সময় তিনি চিকিত্সার ক্ষমতা দিয়ে শিশু রোগীদের এই বিশ্বের সৌন্দর্য দেখায় সাহায্য করেছেন; মৃত্যুর পরও তিনি অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)