এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল নীতি হলো 'অসুস্থ রোগীদের চিকিত্সা করা এবং নৈতিকতা অনুশীলন করা'। তা থেকে বোঝা যায়, চিকিত্সকদের দায়িত্ব হলো পবিত্র চরিত্র নিয়ে রোগীদের প্রাণ উদ্ধার করা এবং তাদের চিকিত্সা করা।
ক্যাপিটাল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিএমইউ) মোট ১০টি শাখা একাডেমি ও একটি মাস্টার্স একাডেমি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে প্রাথমিক চিকিত্সা একাডেমি, জনস্বাস্থ্য একাডেমি, রাসায়নিক জীববিদ্যা ও মেডিসিন একাডেমি, চাইনিজ মেডিসিন একাডেমি, নার্সিং একাডেমি ও ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি স্থাপন করা হয়।
স্নাতক পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন, প্রাইমারি মেডিসিন, প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, মেডিসিন, ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন, ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ ট্রিটমেন্ট, নার্সিং ও মেডিকেল ল্যাবরেটরি প্রযুক্তিসহ ১৬টি প্রধান বিষয় রয়েছে।
ক্লিনিক্যাল মেডিসিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় প্রধান বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল নিয়ে গঠিত এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগত জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি ব্যাপক আকারে ব্যবহারিক জ্ঞানে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
৫ বছরের স্নাতক কোর্সের প্রথম আড়াই বছর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরের আড়াই বছর হাসপাতালে ইন্টার্নি করেন।
মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম আড়াই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরের সাড়ে চার বছর তারা হাসপাতালে ইন্টার্নি করেন। এভাবে তারা ব্যবহারিক কাজ সম্পর্কে দক্ষ হয়ে ওঠেন, যা পেশাগত কাজে তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং ভালোভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করে।
সিএমইউ'র অধিভুক্ত ২০টিরও বেশি হাসপাতাল এবং একটি ইন্সটিটিউট রয়েছে। এদের মধ্যে ১৬টি চীনের শীর্ষ পর্যায়ের হাসপাতাল। বিভিন্ন হাসপাতালের ৩৮টি ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজেদের উন্নতি করার সুযোগ প্রদান করে থাকে। একজন ডাক্তার হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তারা প্রতিদিন রোগীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বিভিন্ন রোগীদের চিকিত্সা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পাশাপাশি হাসপাতালে ইন্টার্নি করা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।এভাবে হাসপাতালে নানা ধরনের রোগীর সঙ্গে দেখা করা এবং তাদের অসুস্থতা সম্পর্কে জানা ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য অনুশীলনের একটি অতি ভালো সুযোগ।
চীনের সমাজ ও অর্থনীতি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সিএমইউ বিদেশের পেশাগত বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। বর্তমানে ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সিএমইউ।
স্নাতকরা স্বল্পকালীন স্কলার হিসেবে বিদেশ সফর করতে পারেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিদেশে ইন্টার্নি করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অতি জনপ্রিয় একটি বিনিময়ের পদ্ধতি।
নিয়মিত ও অত্যন্ত নিয়মশৃঙ্ক্ষলার মধ্যে পড়ালেখা ছাড়াও সিএমইউ'র শিক্ষার্থীদের জন্য নানা ধরনের অনুশীলন তত্পরতা আয়োজন করা হয়। প্রতি বছরের গ্রীষ্মকালে স্নাতক, মাস্টার্স ও ডক্টরেট পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা চীনের অন্তর্মঙ্গোলিয়া, ছিংহাই, চিয়াংসি ও কুইচৌর উপকণ্ঠ এলাকায় বিনা পয়সায় স্থানীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রোগীদের চিকিত্সা করে থাকেন।
সিএমইউতে রেডক্রস সোসাইটি ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থাসহ নানা ধরনের কমিউনিটি রয়েছে। চীনের রেডক্রস সোসাইটির আওতায় শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো সিএমইউ। প্রতি দুই বা তিন বছর পর পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও মানসিকতা আরো বেশি উন্নত হয়ে ওঠে।
শ্রোতাবন্ধুরা, এতক্ষণ আপনারা চীনের ক্যাপিটাল মেডিকেল সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য শুনলেন।
এখন আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রেসিডেন্ট, চীনের বিজ্ঞান একাডেমি ও ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির সদস্য অধ্যাপক উ চিয়ে পিংয়ের কিছু তথ্য তুলে ধরবো।
উ চিয়ে পিং ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে চীনের চিয়াংসু প্রদেশের ছাংচৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চীনের অতি বিখ্যাত ইউরোলজিস্ট। ১৯৩৭ সালে তিনি পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং ১৯৪২ সালে পেইচিং সিয়েহো মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিত্সা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলার হিসেবে কাজ করেন।
১৯৬৮ সাল থেকে তিনি চীন সরকারের চিকিত্সা দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌ এন নাইয়ের আহ্বানে তিনি বিশ্বের ৫টি দেশের নেতাদের রোগের চিকিত্সা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুকর্নো।
চীনের ইউরোলজির উন্নয়ন ও পুরুষদের পরিবার পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণে তিনি বিরাট অবদান রাখেন। তিনি বিশেষ ধরনের যক্ষ্মা রোগীদের চিকিত্সার জন্য নানান গবেষণা করেন এবং নিজের কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে চিকিত্সা পদ্ধতি খুঁজে বের করেন। পরে তিনি ভ্যাসেকটমি গবেষণা করার মাধ্যমে 'ভ্যাস স্টেরিলাইজেশন অ্যাক্ট' আবিষ্কার করেন। তার এই গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক চিকিত্সা বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্ব পায়।
চিকিত্সা বিষয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ১৫০টিরও বেশি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেন এবং ২১টি বই রচনা করেন। চিকিত্সা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি চীনের বিজ্ঞান প্রযুক্তি পুরস্কার, ফ্রান্স সরকারের পুরস্কারসহ জাপানের কাছ থেকেও পুরস্কার লাভ করেন।
ছোটবেলা থেকেই উ চিয়ে পিংয়ের চরিত্রে বুদ্ধিমত্তা ও একনিষ্ঠতার বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। তার বড় ভাই চীনের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক উ রুই পিং মি. উ চিয়ে পিংয়ের ছোটবেলার গল্প স্মরণ করে বলেন, 'শৈশব থেকেই তিনি খেলনাসহ বিভিন্ন কাজে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে থাকেন। এক ধরনের খেলনা খেলার পদ্ধতি না জানলে ভাত না খেয়ে তিনি তা নিয়ে গবেষণা করতেন। যেমন, একবার তিনি সাইকেল চালানোর সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে বল খেলা শুরু করেন। তাদের ছোট ভাই অবাক হয়ে তার এ খেলা উপভোগ করেন। তবে কয়েক সেকেন্ড পর তিনি সাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে যান এবং এতে হাতের হাড় ভেঙ্গে যায়। তা থেকে বোঝা যায়, দুষ্টু হলেও ছোটোবেলা থেকেই মি. উ চিয়ে পিং উদ্ভাবনী কাজের প্রতি ভীষণ আগ্রহী ছিলেন'।
মি. উ চি পিংয়ের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য ডাক্তারি পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তাদের বাবা ছিলেন স্থানীয় অঞ্চলের একজন ব্যবসায়ী। তিনি থিয়ানচিন ব্যবসা ব্যুরো ও তুলার সুতা কারখানার ম্যানেজার ছিলেন। তিনি তার সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে একদিকে যেমন ছিলেন ভীষণ মনোযোগী অন্যদিকে তেমনি ছিলেন অনেক আন্তরিক। তিনি তাদের জন্য চীনা ভাষা, ইংরেজি ও গণিত ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। তার স্বপ্ন ছিলো তার সন্তানরা সরকারী কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ী না হয়ে ডাক্তার হবেন, যাতে তারা অন্যদের সাহায্য করতে পারেন। অবশেষ উ চিয়ে পিং ও তার বড় ভাই বাবার স্বপ্ন পূরণ করেন এবং তারা শ্রেষ্ঠ ডাক্তারে পরিণত হন।
সিয়েহো মেডিকাল কলেজে ভর্তি হবার পর মি. উ চিয়ে পিং দেখতে পান, কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকই আমেরিকান। তারা শুধু ইংরেজি ভাষায় ক্লাস নেন। সেসময় প্রতি বছর সারা চীন থেকে মাত্র ২০ বা ৩০ জন শিক্ষার্থীকে এ ক্লাসে ভর্তি করার জন্য বাছাই করা হতো। তবে কঠোর পড়াশোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পারতেন না। কিন্তু মি. উ চিয়ে পিং অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করেন। স্নাতক ডিগ্রি বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে সহপাঠীদের নিয়ে উপস্থিত হন এবং কলেজের বৃত্তিও লাভ করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার হন। তার শিক্ষক ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তিনি উ চিয়ে পিংকে যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার হিসেবে চাকরি দেওয়ার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালান। তবে মি. উ স্বদেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে চীনে ফিরে আসেন।
১৯৫১ সালে তিনি উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের উদ্ধার করেন। ১৯৬২ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্নোর রোগ চিকিত্সা করার জন্য উ চিয়ে পিংকে বাছাই করেন।
তিনি মি. সুকর্নোর বাম কিডনির পাথর নির্মূল করে চার মাস ধরে তাকে চিকিত্সা করেন। ভিয়েনা চিকিত্সক দল মনে করেছিলেন প্রেসিডেন্ট মি. সুকর্নোর বাম কিডনি শুধু অপারেশনের মাধ্যমেই চিকিত্সা করা সম্ভব। তবে উ চিয়ে পিংয়ের চিকিত্সায় তিনি অপারেশন ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ কারণে ইন্দোনেশিয়ার সরকার মি. উ চিয়ে পিংকে দেশটির জাতীয় পদক প্রদান করে। আর তখন থেকে প্রেসিডেন্ট সুকর্নোও তাকে আত্মীয় এবং বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
২০১১ সালের মার্চ মাসে মহান চিকিত্সক উ চিয়ে পিং মৃত্যুবরণ করেন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াংসহ চীন সরকারের নেতৃবৃন্দ উ চি পিংয়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাকে চির বিদায় জানান।
সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, এখন আপনাদের জন্য রয়েছে একটি গান। গানটির নাম 'কখনো পরিত্যাগ করে না'। গেয়েছেন চীনের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শিল্পী লিউ হুয়ান।
চীনের ডাক্তারদের জন্য এ গানটি রচনা করা হয়। গানের কথা বাংলায় অনুবাদ করলে প্রায় এমন, আগে ভেবেছিলাম মানুষের জীবনযাপনের গল্পে কোনো আকর্ষণীয় বিষয় নেই, তবে হঠাত্ দেখি তুমি জীবন ও মৃত্যুর সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছো,আজকের প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিট জীবনের জন্য কঠোর পরীক্ষা, ভালোবাসার নামে প্রতিশ্রুতি দেই,কখনো ভালোবাসায় আস্থা পরিত্যাগ করবো না, কখনো জীবনের মর্যাদা পরিত্যাগ করবো না....
প্রিয় শ্রেতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়। আজকের 'বিদ্যাবার্তা' অনুষ্ঠানের সময়ও ফুরিয়ে এলো। এবার বিদায়ের পালা। তবে আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের কোনো মতামত বা পরামর্শ থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা ben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
রেডিওয়ের মাধ্যমে আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে বা শুনতে মিস করলে বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে শুনতে পারবেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা হলো www.bengali.cri.cn।
এবার তাহলে বিদায়। সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। থাকুন সুস্থ ও আনন্দে। আগামী সপ্তাহে একই দিনে একই সময়ে আবারও কথা হবে। চাই চিয়ান। (সুবর্ণা/টুটুল)